সিকিম আমাদের কাছের সুইজারল্যান্ড

একসময় সিকিম যাওয়ার অনুমতি ছিল না। এখন বাংলাদেশিদের জন্য সিকিমের দরজা খুলেছে। ছবি: লেখক
একসময় সিকিম যাওয়ার অনুমতি ছিল না। এখন বাংলাদেশিদের জন্য সিকিমের দরজা খুলেছে। ছবি: লেখক

সিকিম যাওয়ার ইচ্ছা বহুদিনের। সময়, সুযোগ হচ্ছিল না। বাংলাদেশ, মিয়ানমার, চীন ও পাকিস্তানের নাগরিকদের সিকিম ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা ছিল। কিন্তু বর্তমান সরকারের কূটনৈতিক তৎপরতায় বাংলাদেশি নাগরিকেরা শর্ত সাপেক্ষে সিকিম ভ্রমণ করতে পারেন। তারপর থেকেই সিকিম যাওয়ার আনুষ্ঠানিক পরিকল্পনা শুরু। অবশেষে চার দিনের ছুটি নিয়ে রওনা হলাম।

এবার ভ্রমণে পরিবারের অনুমতি নিতে হয়নি। কারণ, ওদের সঙ্গে নিয়েই যাত্রা শুরু করলাম। পরিবারের সঙ্গে বেড়ালে বাড়তি প্রশান্তি মেলে। ছুটি খুব কম হওয়ায় হিসাব করে চলতে হয়েছে। বেনাপোল বর্ডার দিয়ে বিকেল পাঁচটায় ইমিগ্রেশন করে বনগাঁ থেকে ট্রেনে কলকাতার শিয়ালদহ স্টেশনে পৌঁছাই রাত নয়টায়। আগে থেকেই শিয়ালদহ-শিলিগুড়ি ট্রেনের টিকিট অনলাইনে কাটা ছিল। দার্জিলিং মেইল, স্লিপার এসি। অনলাইনে কাটার জন্য ২ হাজার রুপি করে নিয়েছে প্রতি সিট। রাত ১০টায় ট্রেন। রাতের খাওয়া সেরে সাড়ে ৯টায় ট্রেনে উঠলাম। যথারীতি ১০টায় ট্রেন ছাড়ল। প্রতিটি সিটের জন্য পরিচ্ছন্ন সাদা বেডশিট, বালিশ, কম্বল আছে। খুবই চমৎকার। কিছুক্ষণ সবাই গল্প করে ১১টায় যাঁর যাঁর স্লিপারে ঘুমাতে যাই। সারা দিন অফিস করে রওনা দিয়েছি, তাই যথেষ্ট ক্লান্ত। চমৎকার ঘুম হলো। ভোরে ঘুম থেকে উঠে পরিচ্ছন্ন বাথরুমে প্রয়োজনীয় কাজ সেরে সকাল আটটায় শিলিগুড়ি পৌঁছাই।

আমরা তিন পরিবারের মোট সাতজন বড়, তিনজন ছোট। আমরা দুই পরিবার কলকাতা হয়ে এবং এক পরিবার বুড়িমারী হয়ে আসায় আমাদের শিলিগুড়িতে তাদের জন্য কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়েছে। বেলা একটার দিকে আমরা সিকিমের রাজধানী গ্যাংটকের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করি। গ্যাংটক পৌঁছাতে যেহেতু রাত হবে, তাই শিলিগুড়ি থেকেই হোটেলসহ টোটাল ভ্রমণের একটা প্যাকেজ নিয়ে নিই। মাহিন্দ্র বুলেরো গাড়িতে আমরা ১০ জন যাত্রা শুরু করি। শিলিগুড়ি থেকে দুই ঘণ্টার পর পৌঁছাই রংপো সিকিম বর্ডারে। এখান থেকেই সিকিম ভ্রমণের অনুমতি নিতে হয়।

সিকিমের আকর্ষণীয় স্থান লাচুং, উমথাম, গুদংমারলেক। অসম্ভব সুন্দর পাহাড়ি রাস্তা, মন কেড়ে নেবে। ছবি: লেখক
সিকিমের আকর্ষণীয় স্থান লাচুং, উমথাম, গুদংমারলেক। অসম্ভব সুন্দর পাহাড়ি রাস্তা, মন কেড়ে নেবে। ছবি: লেখক

সিকিম যাওয়ার জন্য ভারতীয় ভিসার সঙ্গে সিকিম প্রশাসনের অনুমতিপত্র লাগবে, যাকে ‘ইনার লাইনার পারমিট (আইএলপি) বলে’। সিকিম যাওয়ার ইনার লাইন পারমিট ঢাকার যমুনা ফিউচার পার্কের ভিসা সেন্টার থেকে অথবা শিলিগুড়ি SNT-Sikkim Nationalised Transport থেকে অথবা সিকিম ঢোকার চেকপোস্ট রংপো থেকে নেওয়া যায়। রংপো থেকে নেওয়াটাই সবচেয়ে সুবিধাজনক। পাহাড়ের কোল ঘেঁষে ছোট্ট একটা অফিস। পাসপোর্ট-ভিসার ফটোকপি এবং এক কপি পাসপোর্ট সাইজের ছবি দিলেই ৩০ মিনিটের মধ্যেই পারমিশন পেয়ে যাই। পারমিশন নিয়ে যাত্রা শুরু করি। তিন ঘণ্টা পর গ্যাংটক পৌঁছাই। রাত নয়টা নাগাদ গ্যাংটক সাড়ে পাঁচ হাজার ফুট উচ্চতায় হোটেলে পৌঁছাই। যাওয়ার পর হোটেল থেকে শুরু করে সব ক্ষেত্রেই ইনার লাইন পারমিটের ফটোকপি লাগে এবং যখন ট্যুর শেষ করে ফিরব, তখন ইনার লাইন পারমিটের মূল কপি রংপো চেকপোস্টে জমা দিয়ে পাসপোর্টে গ্যাংটক ঢোকার সময় যে সিল দিয়েছিল, সেই সিলের মধ্যে ডিপাচার ডেট এন্ট্রি করে আসতে হবে। সিকিম ভ্রমণের জন্য অবশ্যই কোনো ট্যুর অপারেটরের সঙ্গে থাকতে হবে। এটাই সিকিম প্রশাসনের নিয়ম। ইচ্ছা করলেও ট্যুর অপারেটর ছাড়া ভ্রমণ করতে পারবেন না। আমরা যেহেতু আগেই ট্যুর অপারেটর ঠিক করেছি, তাই কোনো সমস্যা হয়নি। সেই অপারেটর হোটেলে এসে পারমিটসহ ভিসা পাসপোর্টের ফটোকপি, ছবি নিয়ে গেলেন। সিকিম ঢোকার সময় নিতে হয়েছিল ইনার লাইনার পারমিট আর বিভিন্ন অঞ্চল ভ্রমণের জন্য নিতে হবে Protected Area Permission, যা অপারেটররাই আয়োজন করে দেয়। সে জন্য পাসপোর্টের ইনফরমেশন পেজ এবং ভিসা পেজের ১০ কপি ফটোকপি ১০ কপি পাসপোর্ট সাইজের ছবি নিয়ে গিয়েছিলাম। ইনার লাইন পারমিটসহ Protected Area Permission-এর জন্য ফটোকপি এবং ছবি লাগবে। ইনার লাইন পারমিট পাওয়ার পর রংপো থেকে ইনার লাইন পারমিটের ১০ কপি ফটোকপি করে ফেলেছি।

শীত কখনো মাইনাসে নেমে যায়। ছবি: লেখক
শীত কখনো মাইনাসে নেমে যায়। ছবি: লেখক

পরদিন সকালে এক রাত দুই দিনের প্যাকেজে Protected Area Permission, থাকা, খাওয়া, গাড়িসহ ১৪ হাজার রুপি দিয়ে রওনা হই নর্থ সিকিমের লাচুং শহরের দিকে। নর্থ সিকিমকে স্থানীয়রা সুইজারল্যান্ডের সঙ্গে তুলনা করে। নর্থ সিকিমের আকর্ষণীয় স্থান লাচুং (৮৮৫৮ ফুট), উমথাম (১১৮০০ ফুট), গুদংমারলেক (১৭৮০০ ফুট)। অসম্ভব সুন্দর পাহাড়ি রাস্তা। যেখানে পাহাড় আর মেঘ খেলা করে প্রতিনিয়ত। পথে অনেক ঝরনা। হাজার হাজার ফুট উঁচু থেকে পানি পড়ছে। কখনো খুব কাছে, কখনো দূরে। কখনো পুরো রাস্তা মেঘে ঢাকা মনে হবে গাড়িতে চড়ে আকাশে উড়ে যাচ্ছি। ৮ হাজার ফুট উচ্চতায় কোথাও ঝরনার পাশে বসে রেস্তোরাঁ গরম মম, পাকুড়া কফি খেতে খেতে প্রকৃতির রাজ্য হারিয়ে যাওয়া। এক পাশে সুউচ্চ মেঘে ঢাকা পাহাড়, অন্য পাশে হাজার ফুট নিচু। এ এক অন্য রকম অনুভূতি। মেঘ ছাড়া পাহাড়ের সৌন্দর্য নেই। একে অপরের পরিপূরক। পাহাড় আর মেঘের মিতালিতে স্বর্গীয় রূপ ধারণ করেছে প্রকৃতি। ছবি তুলতে তুলতে সন্ধ্যায় পৌঁছায় মনোমুগ্ধকর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত ৯ হাজার ফুট উচ্চতায় ছোট্ট শহর লাচুং। চারপাশে আকাশচুম্বী পাহাড়। ফেব্রুয়ারি মাস হওয়ায় পাহাড়ের চূড়াগুলো বরফে মোড়ানো। রাতে তাপমাত্রা ছিল মাইনাস থ্রি। ভীষণ ঠান্ডায় পরিবার নিয়ে জড়োসড়ো। আগের দিন স্নোফল হওয়ায় রাস্তায় বরফ জমে ছিল। হোটেলটা খুব একটা ভালো ছিল না। রাতের খাবার শেষে বাচ্চাদের ঘুম পাড়িয়ে বড়রা কয়েকজন বের হলাম। প্রচণ্ড শীত। সেদিন ছিল পূর্ণিমা। আমার বহুদিনের ইচ্ছা ছিল পূর্ণিমা রাতে বরফের পাহাড় দেখা। ইচ্ছা পূরণের জন্য হাঁটতে অনেক দূর গেলাম। নির্জন চারদিক। চাঁদের আলোয় পাহাড়ের বরফঢাকা চূড়া চকচক করছিল। কারও মুখে কোনো কথা নেই। অপলক তাকিয়ে থাকা পাহাড়ের পানে। কিছুক্ষণ নিজেকে হারিয়ে ফেললাম। হাঁটতে হাঁটতে একটা বরফ গলা নদীর তীরে বসলাম। ঠান্ডায় জমে যাওয়ার অবস্থা (মাইনাস ৩)। পরে রুমে এসে ঘুম। পরদিন সকালে যাব ১২ হাজার ফুট উচ্চতায় উমথাম।

সকালে উঠে দেখি এ এক অন্য রকম সকাল। ঝলমলে রোদ নীল আকাশ। পরিচ্ছন্ন সকাল। ঝলমলে রোদ থাকায় তাপমাত্রা প্লাস ১-এ এসে দাঁড়াল। পাহাড়ের চূড়ায় সূর্যের আলো পড়ায় চূড়াগুলো সোনার পাহাড়ে পরিণত হয়েছে। সকালে পুরি-সবজি খেয়ে বের হলাম উমথামের উদ্দেশে। পাঁচ কিলোমিটার যেতেই শুরু হলো বরফ। সাদা আর সাদা, যেন পাহাড়গুলোর ওপরে কেউ সাদা রং ঢেলে দিয়েছে। পাইনগাছগুলোর ওপর বরফের আবরণ মনে হচ্ছে শিল্পীর ছোঁয়া। কিছুদূর যাওয়ার পর রাস্তা বন্ধ। বরফের আস্তর এত মোটা যে গাড়ি যাওয়া অসম্ভব। আমরা এখানেই নামলাম। অনেক পর্যটক এখানে। সবাই বরফের ওপর চলার জন্য ৫০ রুপি করে রাবারের গামবুট ভাড়া নিলাম। গামবুট পায়ে দিয়ে সবাই বাঁধনহারা হয়ে গেল। কেউ দৌড়ে পাহাড়ে উঠছে, কেউ বরফ ছোড়াছুড়ি করছে। ছোটরা বরফের আইসডল বানাতে ব্যস্ত। দৌড়াদৌড়ি আর আনন্দের উত্তেজনায় ঠান্ডা খুব একটা মনে হচ্ছে না। চলছে ছবি তোলা আর ভিডিও। এ এক অদ্ভুত ভালো লাগা। ঘণ্টাখানেক পর গামবুটগুলো ফেরত দিয়ে রওনা হলাম গ্যাংটকের পথে। আফসোস থাকল বরফের জন্য উমথাম যেতে না পারার। ১২ হাজার ফুট থেকে ফিরতে হলো। সন্ধ্যার পরে গ্যাংটক হোটেলে পৌঁছালাম। ঠান্ডা আর ভ্রমণের ধকলে সবাই ক্লান্ত। পরিবারকে হোটেলে রেখে আমরা বের হলাম গ্যাংটক শহর দেখার জন্য। পরেরদিন ইস্ট সিকিম যাওয়ার protected area permit-এর জন্য ট্যুর অপারেটরকে পাসপোর্ট, ভিসা, ছবি ও পারমিটের ফটোকপি দিতে হবে। এম জি মার্গ গ্যাংটকের সেন্টার। অনেক দোকান, মল, হোটেল। এটা ওয়াকিং রোড। মহাত্মা গান্ধীর সুন্দর একটা স্ট্যাচু। কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে ঢুকলাম ডেলটিং ডেলজং নামের ক্যাসিনোতে। ২ হাজার ৫০০ রুপি এন্ট্রি ফি। বিনিময়ে বুফে ডিনার, আনলিমিটেড সারা রাত হুইস্কি, হরেক রকম জুস, কাবাব, কাটলেট সব আনলিমিটেড, সঙ্গে ৫০০ রুপির তিনটা কয়েন ক্যাসিনোর জন্য। বেলা তিনটা থেকে সকাল সাতটা পর্যন্ত খোলা থাকে ক্যাসিনো। এক পাশে রিমিক্স নৃত্য চলছে। রাত একটার দিকে ক্যাসিনো কর্তৃপক্ষ গাড়িতে করে হোটেলে নামিয়ে দিল।

চারপাশে আকাশচুম্বী পাহাড়। আর পাহাড়ের চূড়াগুলো বরফে মোড়ানো থাকে। ছবি: লেখক
চারপাশে আকাশচুম্বী পাহাড়। আর পাহাড়ের চূড়াগুলো বরফে মোড়ানো থাকে। ছবি: লেখক

পরেরদিন সকাল নয়টায় বের হলাম। সাংগু লেক (১২৩১৩ ফুট), বাবা মন্দির (১৩১২৩ ফুট), নাথুলা (১৪১৪০ ফুট) যাব। ৭ হাজার রুপি দিয়ে গাইড গাড়ি ঠিক করলেন। গাইড বললেন নাথুলার পারমিশন হয়নি। নাথুলা চীনের বর্ডার। বাবা মন্দির ১২ হাজার ফুট উচ্চতায়। অতিরিক্ত স্নোফলের কারণে রাস্তা বন্ধ। শুধু সাংগু লেকের উদ্দেশে বের হলাম। পাহাড়ে আবহাওয়া খুব দ্রুত বদলায়। সেদিন আবহাওয়া খুব খারাপ। পুরো রাস্তা মেঘে ঢাকা। গাড়ি চলতে পারছে না। প্রচুর গাড়ি। হাজার হাজার ফুট উঁচুতে পাহাড় কেটে রাস্তা বানানো। মেঘে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। বাঁকা রাস্তা। বরফে ঢাকা রাস্তা, পিচ্ছিল। ভয়ংকর অবস্থা। খুব আস্তে আস্তে এগোচ্ছে। ধীরে ধীরে আবহাওয়া আরও খারাপ হচ্ছে। আমরা সবাই ভীত ছিলাম। ১১ হাজার ২২০ ফুট উঠতেই চালকের কাছে খবর এল স্নোফলের কারণে রাস্তা বন্ধ। আমার মনটা খারাপ হলেও সবাই খুশি হলো, অতিরিক্ত বরফের কারণে রাস্তা পিচ্ছিল হওয়ায় ভয়ে ছিলেন তাঁরা। চীনের সীমান্ত হওয়ায় রাস্তায় বিপুল সেনাসদস্য। সেনারাও বললেন, রাস্তা বন্ধ। গাড়ি ঘুরিয়ে সব পর্যটককে ফেরত পাঠালেন গ্যাংটক।

মূলত ফেব্রুয়ারিতে বরফের কারণে ভ্রমণ কঠিন হয়ে পড়ে। এপ্রিল-মে অথবা অক্টোবর-নভেম্বর মাস উপযুক্ত সময়। কালক্ষেপণ না করে রংপো বর্ডারে পারমিটের মূল কপি জমা দিয়ে পাসপোর্টের সিলে EXIT ডেট এন্ট্রি করে চলে এলাম দার্জিলিং। রাতে দার্জিলিং থেকে পরের দিন শিলিগুড়ি। আগেই স্লিপার ট্রেনের টিকিট কাটা ছিল। রাত আটটায় পাহাড়ি এক্সপ্রেসে ঘুমিয়ে কলকাতার হাওড়া স্টেশনে। নিউমার্কেটে কিছু কেনাকাটা করে শিয়ালদহ থেকে ট্রেনে করে বনগাঁ হয়ে বেনাপোল হয়ে যশোর। অবশেষে অনেক দর্শনীয় স্থান বাকি রেখেই চলে আসতে হলো। আক্ষেপ রয়ে গেল। আটজনের টিম হলে জনপ্রতি ২০ হাজার রুপি দিয়েই সুন্দরভাবে ঘুরে আসা সম্ভব সিকিম।

মারুফ হোসেন, ব্যাংকার