সংকটময় পরিস্থিতিতে মোবাইল সাংবাদিকতা চর্চা

কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার রোহিঙ্গা আশ্রয়কেন্দ্রে শরণার্থীদের মোবাইল ফোনে ভিডিও সাক্ষাৎকার ধারণ করা হচ্ছে। কুতুপালং, উখিয়া, কক্সবাজার, ২৬ অক্টোবর। ছবি: জুয়েল শীল
কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার রোহিঙ্গা আশ্রয়কেন্দ্রে শরণার্থীদের মোবাইল ফোনে ভিডিও সাক্ষাৎকার ধারণ করা হচ্ছে। কুতুপালং, উখিয়া, কক্সবাজার, ২৬ অক্টোবর। ছবি: জুয়েল শীল

তথ্য আদান-প্রদানে মোবাইল ফোন বা স্মার্টফোন সাংবাদিকতা গণমাধ্যমের জন্য একটি অপরিহার্য উপকরণ হয়ে উঠেছে। বদলে যাওয়া এই সাংবাদিকতার যুগে একজন সাংবাদিক শুধু তাঁর মোবাইল ফোনটি ব্যবহার করেই ছবি ও ভিডিও ধারণ, সম্পাদনা এবং অনলাইনে পরিবেশনের কাজটি করে ফেলবেন, এমন প্রত্যাশা করা হয়।

মোজো (মোবাইল সাংবাদিকতা) সাংবাদিকতার গতিপথ পাল্টে দিয়েছে। সংবাদ প্রবাহকে করেছে সহজ এবং সুলভ। মোবাইল ফোন সাংবাদিকতা নিয়ে এর আগে প্রকাশিত একাধিক প্রবন্ধে এই বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করেছি।

সাংবাদিকতার নানান কাজে মোবাইল ফোন ব্যবহার করা হচ্ছে। মোবাইল ফোন খুব সহজে ব্যবহারের উপযোগী ও আকারে ছোট হওয়ায় বড় ধরনের কোনো ঘটনা কিংবা সংকটময় পরিস্থিতিতে মোবাইল ফোন সাংবাদিকতার ব্যবহার অতুলনীয়। ২০১৮ সালে রাশিয়ায় অনুষ্ঠিত ফিফা বিশ্বকাপ গিয়ে মোবাইল ফোন সাংবাদিকতাকে বিভিন্নভাবে প্রয়োগ করার সুযোগ পেয়েছিলাম। প্রথম আলোর অনলাইনের জন্য স্টেডিয়াম থেকে স্টোরি লেখা, ছবি পাঠানো, ফেসবুকে লাইভ করা, ইনস্টাগ্রাম ও টুইটারে পোস্ট দেওয়ার কাজ করতে হয়েছে।

সংকটকালীন সময়ে মোবাইল ফোন সাংবাদিকতা কতটা কাজে আসতে পারে, তা আরও কাছ থেকে জানতে পেরেছি ২০১৭ সালে। রোহিঙ্গা সংকট ও পার্বত্য এলাকায় পাহাড় ধসের খবর সংগ্রহের জন্য ওই বছর উখিয়া, টেকনাফ ও রাঙামাটি গিয়েছিলাম। সরেজমিনে বাস্তব পরিস্থিতি নিয়ে প্রথম আলোর প্রিন্ট ও অনলাইনের জন্য প্রতিবেদন লেখার পাশাপাশি ডিজিটাল ভিডিও স্টোরি তৈরি করতে হয়। খবর সংগ্রহের সরঞ্জাম হিসেবে সঙ্গে ছিল আইফোন ৬এস প্লাস, বাব ইন্টারভিউ মাইক্রোফোন এবং শোল্ডারপড এস১ গ্রিপ। এর আগেও ঢাকায় জলাবদ্ধতা, কীর্তনখোলা নদীভাঙন, ২০১৯ সালে বুড়িগঙ্গা নদীতে লঞ্চের ধাক্কায় নৌকাডুবি, ২০১৭ সালে সিরাজগঞ্জের বন্যা—এমন সব ঘটনার খবর সংগ্রহ, পাঠানো ও প্রচারের কাজে শুধু মোবাইল ফোন ব্যবহার করি। সংকটাপন্ন এলাকায় খবর সংগ্রহের কাজে পরিস্থিতির সঙ্গে আপনাকে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করতে হয়। সেখানে যতটা সম্ভব হালকা সরঞ্জাম বা বোঝামুক্ত যাওয়া যায় তত ভালো। আর এই ভাবনা থেকে সাংবাদিকদের জন্য স্মার্টফোন হতে পারে প্রধান হাতিয়ার। প্রতিকূল পরিস্থিতিতে মোবাইল ফোন সাংবাদিকতার চর্চা করার বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে এর কিছু সুবিধা ও অসুবিধার দিকগুলো নিচে দেওয়া হলো—

• অসুবিধা
১. পরিবেশের তাপমাত্রা
উন্মুক্ত রৌদ্রোজ্জ্বল পরিবেশে মোবাইল ফোনে টানা ভিডিও ধারণের সময় ফোনের অভ্যন্তরীণ তাপমাত্রা ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। সাধারণত ফোনের নিজস্ব অ্যাপ ছাড়া অন্য কোনো অ্যাপ যেমন—ফিল্মিক প্রো বা সিনেমা এফভি-ফাইভ অ্যাপ দিয়ে ভিডিও ধারণ করলে ফোনের অভ্যন্তরীণ তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেতে থাকে। যদি পরিবেশের তাপমাত্রা ৩০-৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা তার বেশি হয়, তা হলে হঠাৎ অতিরিক্ত তাপের জন্য অ্যাপ ক্রাশ করে ভিডিও ধারণ বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এমনকি সাক্ষাৎকার রেকর্ডের মাঝামাঝি সময়ে ফোন বন্ধ হয়েও যেতে পারে।

২. ব্যাটারির স্থায়িত্ব
দুর্যোগপূর্ণ এলাকার খবর সংগ্রহের জন্য সাংবাদিককে দিনের বেশির ভাগ সময় ঘটনাস্থলে থাকতে হয়। সাধারণত খুব ভোরে কাজের জন্য বের হয়ে সূর্যাস্তের আগে ফিরে আসেন তাঁরা। এই লম্বা সময় পর্যন্ত মোবাইল ফোনের ব্যাটারির স্থায়িত্ব থাকে না। এ সমস্যা কাটিয়ে ওঠার জন্য আলাদা একটি পাওয়ার ব্যাংক ব্যাকআপ হিসেবে রাখতে হয়।

• সুবিধা
৩. গল্পের কাছে যাওয়া
কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার রোহিঙ্গা হিন্দু শরণার্থীশিবিরে খবর সংগ্রহ করতে গিয়ে আমি দেখেছি, মোজো কীভাবে সাংবাদিককে গল্পের খুব কাছে নিয়ে যেতে পারে। যাদের সঙ্গে কথা বলেছি, তাদের সঙ্গে ভিন্ন একটি অনুভূতি তৈরি করে (প্রথম আলো, ২৭ অক্টোবর ২০১৭)। শরণার্থীশিবিরের লোকজনের সঙ্গে যখন কথা বলি, তাদের সবাই সাবলীলভাবে উত্তর দেন। মোবাইল ফোনের ডিভাইসের কারণেই হয়তো তা সম্ভব হয়েছিল। বড় টিভি ক্যামেরার সামনে তারা এতটা সাবলীলভাবে কথা বলতে পারত না। এ ধরনের পরিবেশ বা পরিস্থিতিতে খুব সহজে তথ্য সংগ্রহ এবং গল্প বলার জন্য মোজো হতে পারে কার্যকর কর্মপ্রণালি।

৪. নিরাপত্তা ও তৎপরতা
প্রতিকূল পরিস্থিতিতে বড় টিভি ক্যামেরা কিংবা ভারী ট্রাইপড বহন করা বেশ কষ্টসাধ্য। সে জন্য মোবাইল ফোন সাংবাদিকতার কর্মপ্রণালি হতে পারে আদর্শ সমাধান।

২০১৭ সালের ১৩ জুন ভয়াবহ পাহাড়ধসে রাঙামাটির মনিঘোনা গ্রামের ২২টি পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর মধ্যে সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত ১২টি আর আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত ১০টি। একই পরিবারের তিনজনসহ ছয়জন নিহত হন (প্রথম আলো, ৩০ অক্টোবর ২০১৭ )। পাহাড়ধসে মনিঘোনা গ্রামের বাসিন্দাদের খোঁজ নিতে পাহাড়ি উঁচু-নিচু পথ ধরে অনেকটা হেঁটে আমাদের পৌঁছাতে হয়েছিল ওই গ্রামে। সেদিন বৃষ্টিও হচ্ছিল, এমন পরিবেশে সাংবাদিকতার কাজে হালকা সরঞ্জাম নিয়ে যাওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। পাহাড়ি দুর্গম পরিবেশে নিজেকে নিরাপদে রাখার পাশাপাশি একই সঙ্গে ব্যয়বহুল বড় ক্যামেরা কিংবা ট্রাইপড বহন করা এবং সেগুলোর নিরাপত্তা বজায় রাখা অনেক সময় কঠিন কাজ হয়ে দাঁড়াতে পারে।

তা ছাড়া আপনাকে প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে দিনের কাজ শেষ করে খবর পাঠাতে হবে। মোবাইল ফোন সাংবাদিকতায় একজন সাংবাদিককে একই সঙ্গে একাধিক কাজ করতে হয়। চলতি পথে হাঁটতে হাঁটতে খবর টাইপ করে আর তার সঙ্গে ভিডিও যুক্ত করে অফিসে পাঠাতে হবে। সাংবাদিকতার কাজে মোবাইল ফোনের এই কৌশল অবলম্বনের জন্য মোবাইল ফোন সাংবাদিকতাকে আমি ‘জার্নালিজম অন দ্য গো’ বলে থাকি।

৫. বহুকৌনিক
মোজো আপনাকে মাল্টি-অ্যাঙ্গেল বা বিভিন্ন কৌনিক অবস্থান থেকে ভিডিও ধারণ করার সুযোগ করে দেয়, যা একটি সংকটজনক পরিবেশে অনেক বড় ব্যাপার এবং আপনার গল্পকে আরও সমৃদ্ধ ও চাঙা করে নতুন মোড় দেয়। মোবাইল ফোনের ডিভাইসটি আপনি খুব সহজেই বিভিন্ন কৌনিক অবস্থান থেকে পরিচালনা করতে পারেন। মানবিক গল্প তৈরিতে যা সাংবাদিককে দারুণভাবে সাহায্য করে থাকে।

জামিল খান: সহকারী অধ্যাপক, মিডিয়া স্টাডিজ অ্যান্ড জার্নালিজম বিভাগ, ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশ (ইউল্যাব)