ঢাকাকে বাঁচাতে হবে

ঢাকায় বের হলেই মাথায় রাখতে হয় যানজটের বিষয়টি। প্রথম আলো ফাইল ছবি
ঢাকায় বের হলেই মাথায় রাখতে হয় যানজটের বিষয়টি। প্রথম আলো ফাইল ছবি

বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে প্রায় অর্ধশতাব্দী হতে চলেছে। এত বছর পার হয়ে যাওয়ার পরও আমরা অনেক দিক দিয়েই পিছিয়ে। সঠিক পরিকল্পনা নিয়ে না এগোনোর কারণেই হয়তো আমাদের এই দুর্দশা। সবচেয়ে বাজে অবস্থায় রয়েছে আমাদের প্রিয় রাজধানী। রাজধানী ঢাকা অপরিষ্কার, বসবাসের অনুপযোগী, অপরিচ্ছন্ন, অসুখী শহরের তালিকায় প্রথম দিকে। স্থিতিশীলতা, স্বাস্থ্যসুবিধা, সংস্কৃতি, পরিবেশ, শিক্ষা, অবকাঠামোসহ ৩০টি মানদণ্ডের বিবেচনায় ঢাকার স্থান তলানিতে।

ঢাকার সবচেয়ে বড় সমস্যা জনবসতি। ঢাকায় প্রতি বর্গকিলোমিটারে ৪৬ হাজার মানুষ বসবাস করে। সরকারি হিসাবে এমন হলে আসল হিসাব খুবই করুণ। প্রতিদিন বহু মানুষ ঢাকায় আসছে জীবিকা কিংবা পড়ালেখার জন্য। অফিস, ব্যাংক, পোশাক কারখানা, ইন্ডাস্ট্রিজ অনেক কিছুই ঢাকামুখী হওয়ায় ঢাকার এ দশা। বিভিন্ন জরিপে ঢাকার নাজুক অবস্থার কথা উঠে এসেছে বারবার। সর্বশেষ জাতিসংঘের হ্যাবিটেট প্রতিবেদনে ঢাকাকে বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ শহর হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

অনেকেই হয়তো বাধ্য হয়ে ঢাকায় আসছে, কিন্তু ঢাকা যে কতটা বসবাসের উপযোগী, তা এখানকার বাসিন্দারা খুব ভালোভাবেই জানে।

ঢাকা শহরে রাস্তাঘাটের অবস্থা আসলে একটা মেগাসিটির মতো কখনোই না। এত বাজে রাস্তাঘাট কোনো শহরেই নেই। রাস্তা অপেক্ষাকৃত সরু বিভিন্ন জায়গায়। অনেক রাস্তা খানাখন্দে ভরা। আর বিভিন্ন কারণে খোঁড়াখুঁড়ির কারণে রাস্তা হয়ে যায় জঘন্য। রাস্তার সঙ্গে ড্রেনের সংযোগ একদম নিবিড়। সামান্য বৃষ্টি হলেই কোনটা রাস্তা কোনটা নর্দমা তা বোঝা কঠিন হয়ে যায়। রাস্তা তো যেমন–তেমন, এর চেয়েও বেশি খারাপ হচ্ছে রাস্তার ট্রাফিক সিস্টেম। ট্রাফিক সিস্টেমেও মনে হয় বিশ্বে বাংলাদেশ জঘন্য। এত বেশি যানজট সম্ভবত বিশ্বের আর একটি শহরে কারণ যানজটে ঢাকা বিশ্বে দ্বিতীয়। ঢাকা শহরে কর্মব্যস্ত দিনগুলোয় ১০ মিনিটের রাস্তা দেখা যায় ঘণ্টাখানেক লাগে। মাঝেমধ্যে এই সময়টা চলে যায় অনুমানের বাইরে। এত অসহনীয় যানজটের অন্যতম কারণ হচ্ছে ট্রাফিক সিস্টেমের অভাব, আমাদের আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল না হওয়া। যত্রতত্র গাড়ি চালানো, ট্রাফিক রুল না মানা আর সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে ব্যক্তিগত গাড়ি। পাবলিক পরিবহন যদি ভালো হতো, তাহলে ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহার বন্ধে নিয়ম করা যেত। কিন্তু আমাদের যে পাবলিক পরিবহন, তাতে মানুষ না ঠেকলে উঠতে চায় না। গাড়ির অবস্থা ভালো না, অতিরিক্ত ভাড়া আদায় এবং পরিবহনশ্রমিকদের কর্তৃক যাত্রী হয়রানির কারণে মানুষ পাবলিক সার্ভিসে উঠতে চায় না। শহরের মধ্যে বিভিন্ন জায়গায় রেলক্রসিং থাকাও যানজটের কারণ। সড়ক দুর্ঘটনায়ও ঢাকা এগিয়ে। বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকাণ্ড সঠিক পরিকল্পনা মেনে না করার ফলে রাস্তায় জ্যাম সৃষ্টি হয়। মেট্রোরেলের কাজ করা হচ্ছে রাস্তায় ব্যারিকেড তৈরি করে। এর কারণে রাস্তায় জ্যাম হচ্ছে, তবে কাজ শুরু করার আগে এসব কেন ভাবা হলো না কে জানে! তবে মেট্রোরেল চালু হয়ে গেলে যানজট নিয়ন্ত্রণে আসবে বলে ধারণা করা যায়।

ঢাকায় কোনো কোনো এলাকায় যানজটের কারণে ঘণ্টাখানেক ধরেও বসে থাকতে হয়। প্রথম আলো ফাইল ছবি
ঢাকায় কোনো কোনো এলাকায় যানজটের কারণে ঘণ্টাখানেক ধরেও বসে থাকতে হয়। প্রথম আলো ফাইল ছবি

আমাদের ঢাকা নগরী হিসেবে গড়ে ওঠার আগে এর কোনো সঠিক পরিকল্পনা ছিল না। বাড়িঘর কোথায় হবে, স্কুল–কলেজ কোথায় হবে, ইন্ডাস্ট্রি কোথায় হবে, তা পূর্বনির্ধারিত না। শহরের বিভিন্ন জায়গায় আগুন লাগলে গাদাগাদি অবস্থার কারণে আগুনের ভয়াবহতা বেশি হয়। পুরান ঢাকার অবস্থা একদম যাচ্ছে তাই।

ঢাকা শহরে যত্রতত্র গড়ে উঠছে কলকারখানা। এর জন্য আরও বেশি মানুষ আসছে ঢাকায়। জনবসতি দিন দিন বেড়েই চলছে। কলকারখানার বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় নেই কোনো সঠিক পদ্ধতি। এর কারণে দূষিত হচ্ছে পরিবেশ, একদম মরতে বসেছে ঢাকার আশপাশের নদী-খালসমূহ। নাগরিক সুবিধার দিক দিয়েও অবস্থা খুব ভালো না। গ্যাস নিয়ে প্রায়ই সমস্যা দেখা যায়। ওয়াসার পানির অবস্থা বলতে গেলে তো ইতিহাসের বই লিখতে হয়।

ঢাকায় একটানা বৃষ্টি হলে অনেক সড়কে পানি জমে যায়। প্রথম আলো ফাইল ছবি
ঢাকায় একটানা বৃষ্টি হলে অনেক সড়কে পানি জমে যায়। প্রথম আলো ফাইল ছবি

ঢাকাকে বাঁচাতে আমাদের আসলে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে এগোতে হবে। প্রথমে রাজধানীকে বিকেন্দ্রীকরণ করা দরকার। কলকারখানা, কেন্দ্রীয় অফিসগুলো সরিয়ে নিতে হবে অন্যত্র। বিকল্প রাজধানী হিসেবে দাঁড় করা যেতে পারে অন্য কোনো শহরকে। একটা দেশে যে একটিই রাজধানী থাকতে হবে, এমন কোথাও বলা নেই। বাণিজ্যিক ও প্রশাসনিক হিসেবে রাজধানী দুটি করা যেতে পারে। ঢাকার আশপাশের কিছু এলাকা আছে, যা এখনো ব্যবহার করা হয়নি, সেগুলোকে ব্যবহার করে রাজধানীকে বর্ধিত করা যেতে পারে। পদ্মা সেতু হয়ে গেলে যাত্রাবাড়ী থেকে মাওয়া পর্যন্ত গড়ে ওঠাতে হবে নতুন নগরী। ঢাকার আরেক পাশ পূর্বাচলেও পরিকল্পনা করে এগোতে হবে। জেলা শহরগুলোয় ঢাকার সব সুযোগ-সুবিধা দেওয়া দরকার। যাতে যেকোনো কারণেই মানুষের ঢাকায় আসতে না হয়। আমাদের সবার দায়িত্ব ঢাকা শহরকে পুরোপুরি মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচানোর। এগিয়ে আসতে হবে সবাইকে।

*মাহবুব নাহিদ: রম্য লেখক, আশকোনা, ঢাকা