গানের বুলবুলি

জন্মান্ধ আছর আলীর জীবন চলে গান গেয়েই। ছবি: লেখক
জন্মান্ধ আছর আলীর জীবন চলে গান গেয়েই। ছবি: লেখক

এক মধ্যদুপুরে যেন কারও কোমল গলায় করুণ মরমি বিচ্ছেদের সুর কানে এসে বাজছিল আমার। হঠাৎ দেখি কেশরগঞ্জ বাজারের ছাপরাঘরটার নিচে হাতের ঢোলটা বাজিয়ে বাজিয়ে গান গাইছে একটা ছেলে, পাশে মন্দিরা হাতে চল্লিশোর্ধ্ব লোকটা গানে তাল দিচ্ছেন। এটি ছিল আসর জমানোর প্রথম গান, মানুষ হেঁটে যাচ্ছে, কেউ কেউ আলাপের খেই হারিয়ে কৌতূহলী দৃষ্টি ফেলছে আসরে। পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া পথচারী থমকে দাঁড়াচ্ছে, কেউ মুচকি হাসছে আবার কেউবা আমার মতোই এগিয়ে যাচ্ছে আসরে গানের সুরে সুরে। গলা ছেড়ে গাইছে ছেলেটা; তার আঙুলের আঘাতে ঢোলের প্রতিটা শব্দ হৃদয় কাটছে।

গানের শিল্পী আছর আলী সরকার। সরকার টাইটেলটা অবশ্য বংশগত না, আছর আলী তার ওস্তাদ ফরমান আলী সরকারের কাছ থেকে পেয়েছে।

জানা যায়, ময়মনসিংহের চৌরাস্তা নামক এলাকায় বাড়ি আছর আলী সরকারের। জন্ম থেকেই অন্ধ সে। পাশে বসে থাকা আধেক পাগল বাবা ইমান আলী। সংসারে বলতে মা-বাবা আর আছর আলী। আছর আলী কখনো নেদুর বাজার, কখনো মটের বাজার, মুক্তাগাছা, কালিবাড়ি, ফুলবাড়িয়া, কেশরগঞ্জ, আছিমসহ প্রত্যন্ত গ্রামগঞ্জে গান গেয়ে সারা দিনে পায় ১৫০ থেকে ২০০ টাকা, কোনো দিন ৫০০ টাকাও জোটে তার কপালে।

সারা দিন গান গেয়ে এ কয়টা টাকা দিয়েই বাবা–ছেলে মিলে চাল–ডাল–তরিতরকারি কিনে সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরেন।

আছর আলী জানায়, সেই পাঁচ বছর বয়স থেকেই পার্শ্ববর্তী মটের বাজার এলাকার বাউলশিল্পী ফরমান আলীর কাছে তালিম নিতে চলে যায় আছর; ওস্তাদ ফরমান আসরে গান গাওয়ার পাশাপাশি দাঁতের মাজনও বিক্রি করতেন। শুধু ওস্তাদ না, ফরমাল আলী সরকারকে বাবা বলেই শ্রদ্ধা করে সে। তাঁর কাছেই গানের হাতেখড়ি, তালিম আছর আলীর।

এরই মধ্যে সময় বয়ে চলে নদীর বহমান স্রোতের মতো। সেদিনের সেই পাঁচ বছরের শিশু আছর এখন কৈশরে। এদিকে আসর কিংবা দাঁতের মাজন বেচার ছলে গান গেয়ে দিন আর চলে না ওস্তাদ ফরমান আলী সরকারের। ফরমান আলী তাই জীবিকার তাগিদে দোতরা ছেড়ে পাড়ি জমান ঢাকার কোনো এক পোশাক কারখানায় দারোয়ানের চাকরি নিয়ে।

যাওয়ার সময় শিষ্য আছর আলীর মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছিলেন, ‘যাইরে পাগলা, আমার কাছে আইছিলি হেই ছোড; অহন বড় হোইছছ, সবি বুঝছ, অহন নিজের রুটি–রুজি নিজে করতে শিখ।’

ওস্তাদ ফরমান আলীর দোয়া নিয়ে সেই থেকে পথেই আছে ‘গানের বুলবুলি’ বাউলশিল্পী আছর আলী সরকার।
গান নিয়েই আগামী দিনগুলোতে অনেক স্বপ্ন দেখে সে। নতুন নতুন গান বাঁধবে, গাইবে, মস্ত বাউল হবে বড় হয়ে সে—পালাগান গাইবে। আসর উপচে পড়বে শ্রোতার ভিড়ে। এই জীবনে সব থেকে বড় চাওয়া কী? এমন এক প্রশ্নের জবাবে আছর আলী সরকার বলে, ‘আমার মতন অন্ধ মাইনষ্যের আবার কিয়ের চাওয়া–পাওয়া? তয় একবারের লাইগা মায়রে স্বপ্নে খুব দেখতে ইচ্ছা করে, মায় কেমন দেখতে। আব্বার লাইগা চিন্তা অয়- হে তো পাগল মানুষ; কোনো দিন কামাই কইরা একটা টেকাও মার থাই দিল না।’

আছর আলী সরকার জানায়, ‘মেবাই (মিয়াবাই) অহন আর মানুষ আগের মতো আসরে গান শুনতে আসে না। সংসারের খরচ চালাইতে হিমশিম খাই, তবু উপরে আল্লাহ আর ওস্তাদের দোয়ায় মালিক চালায়তাছে।’

মুঠোফোনে আছর আলী সরকারের ওস্তাদ ফরমান আলীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘আছর আলী সরকার আমার সন্তানের মতো, অমি অরে পালছি। শুধু সংসারের মায়ায় পইরা গান ছাড়ছি, আছরকেও এতিম কইরা এই ঢাহা চইল্যা আছি। আমার গান তো শেষ, দোয়া করি আছর মেলা বড় হোক।’

আমি বরাবরই এমন জীবনের গল্প শোনার পর, শেষে চুপ হয়ে যাই—কিছুই যেন বলবার থাকে না। আমরা হয়তো সত্যি জানি না এই জন্মান্ধ আছর আলী কত দিন এমন আসর জমাবে, কত দিন চলবে এভাবে তার জীবনযুদ্ধ।
আজ বিশ্ব প্রতিবন্ধী দিবসে এই অসাধারণ বিরল প্রতিভাবান দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিল্পী আছর আলী সরকারের জন্য রইল ভালোবাসা।

*ইমতিয়াজ আহমেদ। [email protected]