মনের প্রলেপ

ইংরেজিতে যাকে বলে ‘পারফেক্ট লাইফ’, তা কি বাস্তবে সম্ভব? জীবন কি নিস্তরঙ্গ হয়, হয় না। চড়াই-উতরাই, ভালো-মন্দ, আলো-কালো, হাসি-কান্না, ঝড়-জল—সব সামলেই জীবন। আর চাওয়া বা না চাওয়ার কঠিন মুহূর্তগুলো যখন আসে, তখন তাঁকে মোকাবিলা করে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার নিরন্তর দায়িত্ব পালন করে চলার সবচেয়ে বিশ্বস্ত সিপাহি ‘মন’।

বস আপনার টগবগে উৎসাহে এক বালতি পানি ঢেলে দিয়ে বলেছেন, কী করেছেন? আপনাকে দিয়ে কিচ্ছু হবে না। সরকারি গেজেটেড কর্মকর্তা বন্ধুর সাফল্য দেখিয়ে পরিচিতজনেরা বলেছেন, কী করলি জীবনে? যে ছিল আপনার ভালোবাসার ধন, সে এখন অন্য কারও সঙ্গী। ছোট্ট দুটি পা, ফোকলা দাঁতের হাসির স্বপ্নে বিভোর আপনি, কিন্তু মা বা বাবা হওয়ার স্বপ্নটা অধরা। আপনার কোলজুড়ে এসেছে যে সন্তান, সে স্বাভাবিক নয়। হঠাৎ কোনো দুর্ঘটনায় হারালেন খুব কাছের প্রিয়জনকে। এমনই কোটি সমস্যা কোটি মানুষের। প্রতিটির রূপ, রস, স্বাদ, গন্ধ ভিন্ন। আর সেই ছোট থেকে মাঝারি, মাঝারি থেকে বড় বা বড় থেকে বিশাল সমস্যাগুলোকে অতিক্রম করে যাওয়ার সুযোগ নেই। ওদের সঙ্গে যুদ্ধ করেই এগিয়ে যেতে হয়। আর সেই যুদ্ধে আপনাকে টিকিয়ে রাখতে আর কেউ নয়, দূর হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে আপনারই মন।

এই যে মন আপনার সব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে চলেছে, তার জন্য আপনি কী করেছেন? নিত্য সব অবসাদ, ক্লেদ, বিষণ্নতা গিলে আপনার মন আপনাকে সজীব রাখছে, তাহলে মনের জন্য আপনার কিছু না করাটা কি যুক্তিসংগত?

পরিবারের বা কর্মক্ষেত্রের কোনো বিষয় নিয়ে মনে জমতে শুরু করল ক্ষোভ। এরপর আপনি ফেসবুকের মিথ্যা দুনিয়া নিয়ে পড়লেন। হাসি হাসি খুশি খুশি নৈতিকতা আর মিথ্যা সাধুত্বে ভরা আনন্দপূর্ণ জীবনের উপস্থাপন দেখে আপনি ভাবলেন, আমার চেয়ে অভাগা আর কে আছে? মনের যে ক্ষোভের শুরু, সেখানে আরও বারুদ জমা করলেন। এরপর বিস্ফোরণ তো হবেই। অথচ মনের ক্ষোভের যখন শুরু, তারপর মনকে শান্ত করতে, ওকে পরশ বোলাতে একটু পদক্ষেপ নিলে পরের বারুদটা জমার সুযোগই তৈরি হতো না।

সমাজ, পারিপার্শ্বিকতা—সব মিলিয়ে একটা অস্থির সময়ের মধ্য দিয়ে হেঁটে চলেছি আমরা। যেখানে আমাদের মনের জন্য নেই কোনো অবসর। অথচ মনের জন্য কিছু করা কি খুব কঠিন?

রাতের শেষে ভোরকে সকাল হতে দেখা এক বিস্ময়। ইট-কাঠ-পাথরের এই নগরীতে প্রথম বৃষ্টির পর ধুয়ে যাওয়া সবুজ পাতাদের দেখা এক আনন্দ। রাতের অন্ধকারে আকাশের দিকে একাকী ১০টি মিনিট তাকিয়ে থাকাও একটা আশ্রয়। প্রকৃতির অসাধারণ শক্তি। সে কখনো বঞ্চিত করে না। হোক না নগরে অথবা জঙ্গলে। আপনার বিক্ষিপ্ত মনের হাজারো সমস্যার পাশাপাশি দিন না প্রকৃতিকে একটু আশ্রয়। চোখটাকে একটু ঘুরিয়ে মনের জন্য প্রকৃতি থেকে নিয়েই দেখুন কিছু নির্যাস। মন সজীব হতে বাধ্য।

প্রকৃতি তো আছেই। আপনার কাছের সম্পর্কগুলোও কিন্তু হতে পারে মন থেকে বিষণ্নতা উপড়ে ফেলার মাধ্যম। পরিবারের ছোট্ট সদস্যটির অযৌক্তিক কথায় কিছুক্ষণ হারিয়ে যাওয়া। মাকে কারণে অকারণে জড়িয়ে ধরা—এমন অজস্র দাওয়া থাকে আপনার হাতের কাছেই। কেবল নিজের মতো করে তাকে একটু মনের কাছে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্বটা নিয়েই দেখুন। ভালো লাগবে। ভালো থাকবেন।

প্রতিযোগিতার পৃথিবীতে ছুটছেন আপনি। ছুটতে হচ্ছে আপনার মনকেও। আপনার খোরাক জুটছে। মনের খোরাক জোটানোর সময় কি আছে? দুই কলি গান, একটি উপন্যাসের প্রিয় চরিত্রের সঙ্গে হারিয়ে যাওয়া, একটি ভালো সিনেমা দেখতে গিয়ে ওই সেটে নিজেকে আবিষ্কার করা—এমন মুহূর্তগুলোও হতে পারে মনের খোরাক। প্রতিদিন নিয়ম করে ১০ মিনিট গান শুনে বা ১০ মিনিট বই পড়ে দেখতে পারেন। মন ঠকবে না। আপনাকেও ঠকাবে না।

প্রকৃতি-প্রেম-সাধনা, হতে পারে আপনার মনের সান্ত্বনা। অথবা অন্য কোনো তাল বা লয়ে আপনার মনের ওপর বুলিয়ে দিতে পারে আলতো প্রলেপ। যে মন আপনাকে সামলাচ্ছে, তাকে ভালো রাখতে প্রলেপ আপনাকেই দিতে হবে। আপনার মনের প্রলেপ আপনাকে শক্তি দেবে। যে শক্তিতে জীবন সফল হোক না হোক, সার্থক হয়ে উঠবে।

* রুখসানা মিলি, [email protected]