শিশুশিক্ষায় অনন্য সংযোজন প্রকৃতি পাঠ

স্কুলব্যাগে বইয়ের পর বইয়ের বদলে প্রকৃতির মাঝে শিশুকে নেওয়া দরকার। ছবি: লেখক
স্কুলব্যাগে বইয়ের পর বইয়ের বদলে প্রকৃতির মাঝে শিশুকে নেওয়া দরকার। ছবি: লেখক

দেশের শিশুশিক্ষায় এক অভিনব, চমকপ্রদ, সময়োচিত এবং আশাজাগানিয়া সংযোজন শিশুদের জন্য প্রকৃতি পাঠ। আমরা যখন আমাদের শিশুদের রোবটে রূপান্তরের মচ্ছবে মেতে উঠছি; তাদের স্কুলব্যাগে ১০-১২টি বই, সমানসংখ্যক বা কোনো কোনো ক্ষেত্রে বেশি খাতা, ডায়েরি, পেনসিল বক্স, টিফিন বক্স, ছাতা, পানির বোতল পুরে নাজুক পিঠে চড়িয়ে দিয়ে পিঠটাকে করছি বাঁকা। এসব বইয়ের হোমওয়ার্কের চাপে নত করে দিচ্ছি মাথা।

ঠিক তখন বাংলাদেশের গ্রামে গ্রামে শিশুরা প্রকৃতি পাঠের উচ্ছল আনন্দে জ্ঞানের চোখ মেলে তাকাচ্ছে। দেখছে জগৎটাকে। চিনে নিচ্ছে গাছ, ফুল, ফল, পাখি, মাছ। শিখে নিচ্ছে কোনটা কী কাজে লাগে। কোনো গাছ-লতা-ফুল-পাখি-মাছ মানুষের জন্য উপকারী আর কোনটা তার ক্ষতি করে। পাতা ও কাঠি দিয়ে সৃজনশীলতার চর্চায় পাল্লা দিয়ে তৈরি করছে ফুল-পাখি-ঘর-ঘড়ি-চশমা-ব্যাগ এবং তাৎক্ষণিকভাবে তার মনে যা আসছে তা-ই। অন্তরঙ্গ বন্ধুর মতো শিক্ষিকার কাছ থেকে জেনে নিচ্ছে হঠাৎ কোনো প্রাকৃতিক বা যাপিত জীবনে হামেশা ঘটে থাকে এমন কোনো বিপদে পড়লে তাকে কী করতে হবে। শিখে নিচ্ছে সেসব ক্ষেত্রের প্রাথমিক চিকিৎসাটা কী। মা-বাবার মোবাইল ফোন নম্বরসহ নিজের ঠিকানা বলতে শিখছে। আর তারপর প্রকৃতির কোলে মেতে উঠছে মজার মজার সব গ্রামীণ শিশুতোষ খেলায়।

প্রক্রিয়া হিসেবে প্রকৃতি পাঠ হচ্ছে তাকিয়ে থাকা জিনিসটিকে দেখা এবং যা দেখা হলো তা সম্পর্কে সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছানো। ছবি: লেখক
প্রক্রিয়া হিসেবে প্রকৃতি পাঠ হচ্ছে তাকিয়ে থাকা জিনিসটিকে দেখা এবং যা দেখা হলো তা সম্পর্কে সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছানো। ছবি: লেখক

রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ কিছুদিন আগে এক বক্তৃতায় শিশুদের প্রকৃতির মাঝে নিয়ে গিয়ে পাঠদানের পরামর্শ দিয়েছিলেন। প্রস্তাবটি খুবই সময়োপযোগী। ২০১৬ সালের এক গবেষণা জরিপে দেখা গেছে, আমাদের চেয়ে অনেক উন্নত দেশ ব্রিটেনেও তিন-চতুর্থাংশ শিশু জেলখানার একজন কয়েদির চেয়ে কম সময় ঘরের বাইরে কাটায়। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছেÑশহুরে কোনো শিশুকে যদি বলা হয় ধানগাছের তক্তা দিয়ে জাহাজ নির্মিত হয়, অবলীলায় সে হয়তো কথাটি বিশ্বাস করে ফেলবে। আসুন না, কিছুটা সময় আমাদের শিশুদের প্রকৃতির মাঝে নিয়ে তার সামনে মেলে ধরি অফুরন্ত জ্ঞানের ভান্ডার! শিশুর শারীরিক-মানসিক-বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশে প্রকৃতি পাঠ সরাসরি ভূমিকা রেখে থাকে। শিশুর মাঝে আবেগ-অনুভূতি সৃষ্টিতে এবং সামাজিক বোধ গড়ে দিতে প্রকৃতি পাঠ সহায়তা করে থাকে।

প্রক্রিয়া হিসেবে প্রকৃতি পাঠ হচ্ছে তাকিয়ে থাকা জিনিসটিকে দেখা এবং যা দেখা হলো তা সম্পর্কে সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছানো। এর উদ্দেশ্য হচ্ছেÑকোনো শিশুকে পরিবেশের নিরিখে শিক্ষিত করে তোলা, যাতে পরবর্তী সময়ে তার জীবনটা সম্পূর্ণতর ও সমৃদ্ধতর হয়ে ওঠে। এটি প্রথাসিদ্ধ কোনো বিজ্ঞান-শিক্ষা নয়। এ শিক্ষা আসলে অনেক কিছুকে হাতের কাছে এনে দেয় এবং পদ্ধতিগত প্রাথমিক বা নিয়মতান্ত্রিক সম্পর্ক উল্লেখ ছাড়াই ওই জিনিসগুলোকে বুঝতে সাহায্য করে।

হোমওয়ার্কের চাপে নত শিশুদের প্রকৃতি পাঠ জরুরি। ছবি: লেখক
হোমওয়ার্কের চাপে নত শিশুদের প্রকৃতি পাঠ জরুরি। ছবি: লেখক

লৌকিকতা বিবর্জিত একেবারেই সাধারণ ব্যাপার এটি। যেসব বস্তু বা দৃশ্যাবলি দেখা হচ্ছে ঠিক তেমনটিই সাদামাটা। এটি সংজ্ঞা বা বইপত্রে দেওয়া পদ্ধতিগত ব্যাখ্যার একেবারেই বাইরে। সর্বাংশেই প্রাকৃতিক। এ পাঠ চোখ ও মনকে জীবনের সাধারণ জিনিসগুলোকে দেখতে ও বুঝতে শেখায়; এবং এর ফলে যা অর্জিত হয় তা বিজ্ঞানের মতো সরাসরি কোনো অর্জন নয় ঠিকই, কিন্তু অস্তিত্বমান যা কিছু আছে তার ওপর এটি এক জীবনঘন সহানুভূতি প্রতিষ্ঠা করে। প্রকৃতি পাঠ শিশুদের পরিবেশ সচেতনতা বাড়ায়। জগতের ওপর তার মালিকানা বোধ গড়ে দেয়। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে দেশের সম্পদে পরিণত করার লালন-পর্বে তাই প্রকৃতি পাঠের সন্নিবেশ ইতিবাচক ফল বয়ে আনবে বলেই আমার ধারণা। কেউ কি এগিয়ে আসবে এই শিশু প্রণোদনায়?

হ্যাঁ, বাংলাদেশের আড়াই হাজারের বেশি গ্রামে উঠান শিক্ষাকেন্দ্রের শিক্ষিকারা তাঁদের শিশুদের মাসে এক দিন প্রাকৃতিক পরিবেশে ঘুরে বেড়িয়ে এভাবেই নিয়ে যাচ্ছেন প্রকৃতি পাঠে। আর এই শিক্ষা সহায়তা কর্মসূচিটি পরিচালনা করছে সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট ইনোভেশন অ্যান্ড প্র্যাকটিসেস (সিদীপ) নামের একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা। চাইলে বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর তাদের কর্মসূচিতে এটি জুড়ে নিতে পারে।

মনজুর শামস: অনুবাদক, লেখক, বেসরকারি সংস্থার গবেষক, [email protected]