মানবাধিকার আইন ও অভ্যন্তরীণ পরিবেশগত শরণার্থীদের ভবিষ্যৎ

‘ফ্রাইডেস ফর ফিউচার’–এর মতো আন্দোলনগুলো জলবায়ু পরিবর্তন ও এর ক্ষতিকর প্রভাব নিয়ে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করছে। ছবি: রয়টার্স
‘ফ্রাইডেস ফর ফিউচার’–এর মতো আন্দোলনগুলো জলবায়ু পরিবর্তন ও এর ক্ষতিকর প্রভাব নিয়ে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করছে। ছবি: রয়টার্স

ছোট্ট শিশু গ্রেটা থুনবার্গ এবং ‘ফ্রাইডেস ফর ফিউচার’–এর মতো আন্দোলনগুলো জলবায়ু পরিবর্তন ও এর ক্ষতিকর প্রভাব নিয়ে আমাদের নতুন করে ভাবতে বাধ্য করে। বাংলাদেশ সমুদ্রতীরবর্তী এমন একটি দেশ, যা জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বিশ্বব্যাংকের একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের ১ কোটি ৩৩ লাখ মানুষ জলবায়ু শরণার্থীতে পরিণত হবে।

বর্তমান বিশ্বের নানা ধরনের সমস্যার মধ্যে শরণার্থী সমস্যা অন্যতম। এই সমস্যা সৃষ্টির মূলে রয়েছে ক্ষমতাসীন রাষ্ট্রগুলোর রাজনৈতিক লড়াই এবং অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনের নেশা, যার কারণে সিরিয়া সংকট, ফিলিস্তিন সীমান্তে ইসরায়েলিদের বসতি স্থাপন, রোহিঙ্গা সমস্যাসহ মেক্সিকো উপকূলে শরণার্থী সংকট তৈরির মতো উদাহরণ তৈরি হচ্ছে। শরণার্থী সমস্যা তৈরির মূল কারণ হলো রাজনৈতিক ও সামরিক ভিন্নমতাদর্শ, জাতিগত পার্থক্য, ধর্মীয় সহিংসতা, ক্ষমতার লড়াই ইত্যাদি।

তবে আজ আমি যে শরণার্থীদের নিয়ে কথা বলব, তা হলো সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি কারণে সৃষ্ট শরণার্থী। জলবায়ু শরণার্থী, পরিবেশগত শরণার্থী, জলবায়ু নির্বাসিত, যা–ই বলুন না কেন, বর্তমান বিশ্বে সৃষ্ট সমস্যাগুলোর মধ্যে এটি অন্যতম। এই শব্দ প্রথম ব্যবহৃত হয় ১৯৫৮ সালে। জলবায়ু পরিবর্তন ও এর ক্ষতিকর প্রভাব সমসাময়িক প্রেক্ষাপটে সর্বোচ্চ আলোচিত একটি বিষয়। এ সমস্যা সমাধানে বর্তমানে প্রচুর তোড়জোড় দেখা যাচ্ছে। জাতিসংঘের বিভিন্ন অঙ্গসংগঠন, যেমন: ইউএনএফসিসিসির বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণসহ সিওপি-১ থেকে সিওপি-২৪ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হয়েছে এবং সিওপি-২৫ অনুষ্ঠিত হচ্ছে ২ থেকে ১৩ ডিসেম্বর। কিন্তু ফলাফল বলতে গেলে শূন্য। এর কারণ হলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর কলোনিপ্রথার উচ্ছেদ হলেও ক্ষমতার প্রতিযোগিতা আগের মতোই বিদ্যমান, শুধু পদ্ধতিটার পরিবর্তন হয়েছে মাত্র। বর্তমানে ক্ষমতার প্রতিযোগিতাটা হয় অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিকভাবে নিজেদের শক্তিশালীকরণের মাধ্যমে। তাই পশ্চিমা উন্নত দেশগুলো তাদের শক্তিবৃদ্ধির চর্চায় ব্যস্ত, জলবায়ু ও পরিবেশ বিপর্যয় নিরসনে অর্থ ব্যয়ের ব্যাপারে বরাবরই তারা উদাসীন। এখানে আরেকটি বিষয় উল্লেখ্য, উন্নত দেশগুলো তাদের উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব অনেকটাই কাটিয়ে উঠতে সক্ষম, যেখানে প্রধান ভুক্তভোগী হচ্ছে অনুন্নত, উন্নয়নশীল রাষ্ট্রসহ আফ্রিকার অনুন্নত দেশগুলো এবং সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সমুদ্র উপকূলীয় ও দ্বীপরাষ্ট্রগুলো, যারা জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষেত্রে কম ভূমিকা পালন করছে। ইউরোপীয় কমিশন ও নেদারল্যান্ডসের পরিবেশবিষয়ক সংস্থার মতে, পৃথিবীর প্রথম সারির ১০টি দেশ, যা মোট কার্বনের ৬৭ দশমিক ৬ শতাংশ নিঃসরণ করে, তার মধ্যে চীন ও আমেরিকার অবস্থান সবার প্রথমে। সঙ্গে সঙ্গে জার্মানি, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান ও কানাডা কোনো অংশে পিছিয়ে নেই।

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সৃষ্ট সমস্যার সবচেয়ে বড় যেটি, সেটি হলো বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা বৃদ্ধি। এর কারণে বরফ গলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। উপকূলীয় অঞ্চল তলিয়ে যাচ্ছে সমুদ্রগর্ভে। বাস্তুহারা হচ্ছে মানুষ। জলবায়ু শরণার্থী হলো তারাই, যারা পরিবেশের আকস্মিক ও স্থায়ী পরিবর্তনের কারণে দীর্ঘ মেয়াদে তাদের বাসস্থান হায়ায়। দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকার একটি নিবন্ধে বলা হয়, আগামী ৫০ বছরে বিশ্বের প্রায় ১০০ কোটি মানুষ বাস্তুচ্যুত হবে। পাপুয়া নিউগিনির কার্টিরেট দ্বীপের বাসিন্দারা বিশ্বের সর্ব আন্তর্জাতিক জলবায়ুগত শরণার্থী হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে, যাদের ২০১৫ সালের মধ্যেই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে এবং ২০৫০ সাল নাগাদ প্রতি ৪৫ জনে ১ জন জলবায়ু শরণার্থী হবে, বাংলাদেশে প্রতি ৭ জনে ১ জন। এখন পর্যন্ত সাব–সাহারান আফ্রিকায় ৮৬ মিলিয়ন, দক্ষিণ এশিয়ায় ৪০ মিলিয়ন ও ল্যাটিন আমেরিকায় ১৭ মিলিয়ন মানুষ জলবায়ুগত শরণার্থীতে পরিণত হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে যেসব দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তার মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান প্রথম। ঢাকা, চট্টগ্রাম ও খুলনা বিভাগ হবে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত শহর। ২০১৮-১৯ সালে বায়ুদূষণে প্রথম স্থান অধিকার করেছে ঢাকা। আবার এই অযোগ্য শহরেই প্রতিবছর জড়ো হচ্ছে লাখ লাখ জলবায়ুগত শরণার্থী, যাদের একমাত্র আশ্রয় হচ্ছে বস্তি ও রেলস্টেশনের প্ল্যাটফর্ম।

এবার আসি একটু ভিন্ন প্রসঙ্গে, ইউনিভার্সাল ডিক্লিয়ারেশন অব হিউম্যান রাউটস(ইউডিএইচআর)-১৯৪৮–এর ১৪ নম্বর অনুচ্ছেদে অভিবাসনসংক্রান্ত বিষয়ে বলা হয়, কেউ তখনই অভিবাসী হবে, যখন সে তার নিজ দেশে বর্ণ, ধর্ম, জাতীয়তাবাদ ও রাজনৈতিক কারণে নির্যাতন ও নিপীড়নের স্বীকার হয়ে নিজ দেশ ত্যাগে বাধ্য হবে। আন্তর্জাতিকভাবে একজন অভিবাসী তার অধিকারগুলো তখনই পাবে, যখন সে আন্তর্জাতিক আইনে অভিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি পাবে। এখন যারা জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে নিজ বাসস্থান ত্যাগ করে নিজ দেশের অভ্যন্তরেই অন্যত্র স্থানান্তরিত হতে বাধ্য হয়েছে, তারা হলো অভ্যন্তরীণ জলবায়ুগত শরণার্থী। তারাও জলবায়ুগত শরণার্থী, কিন্তু তাদের আন্তর্জাতিক আইনে শরণার্থী হিসেবে কোনো স্বীকৃতি নেই। সুতরাং শরণার্থী হিসেবে সব অধিকার থেকেও তারা বঞ্চিত হবে।

জাতিসংঘের ক্লাইমেট অ্যাকশন সামিটের উদ্বোধনী পর্বে বিশ্বনেতাদের সামনে বক্তব্য দিচ্ছে গ্রেটা থুনবার্গ। ফাইল ছবি
জাতিসংঘের ক্লাইমেট অ্যাকশন সামিটের উদ্বোধনী পর্বে বিশ্বনেতাদের সামনে বক্তব্য দিচ্ছে গ্রেটা থুনবার্গ। ফাইল ছবি

ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ড. আইনুন নিশাত বলেন, বাংলাদেশে অভ্যন্তরীণ জলবায়ুগত শরণার্থীর সংখ্যা ক্রমে বাড়ছে, যার প্রকৃষ্ট উদাহরণ মোহাম্মদপুরের ভোলাপাড়া নামক বস্তি। ইন্টারন্যাশনাল ডিসিপ্লিন ম্যানেজমেন্টের হিসাব অনুযায়ী জলবায়ু পরিবর্তন ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ২০১৬ সালে মোট ৫৭ লাখ মানুষ বাস্তুহারা হয়েছে, যার ৭০ শতাংশই পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণে।

গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ড সাধারণত কাজ করে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর উন্নয়ন ও অভিযোজন নিয়ে। এ লক্ষ্যে এই সংস্থা কার্যক্রম পরিচালনায় অর্থায়ন করে থাকে। বর্তমানে বাংলাদেশে মোট চারটি প্রকল্প নিয়ে এ সংস্থা কাজ করছে, কিন্তু এখন পর্যন্ত অভ্যন্তরীণ জলবায়ুগত শরণার্থী নিয়ে তাদের কোনো প্রকল্প চালু হয়নি। এমনকি অভ্যন্তরীণ জলবায়ুগত শরণার্থীদের স্বীকৃত দেওয়ার জন্য কোনো আন্তর্জাতিক আইন তো নেইই, পাশাপাশি কোনো দেশও তাদের পুনর্বাসনে এখন পর্যন্ত কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি, যা হতাশাজনক হলেও সত্য।

আন্তর্জাতিক বিভিন্ন চুক্তি, আলোচনা সভা, যা–ই হোক না কেন, আমি মনে করি, অভ্যন্তরীণ জলবায়ুগত শরণার্থীদের আন্তর্জাতিক আইনে স্বীকৃতি দিয়ে তাদের যথাযথ পুনর্বাসনে পদক্ষেপ গ্রহণ না করলে এটি ভবিষ্যতে বড় ধরনের সংকটে পরিণত হবে।

*জাকিয়া সুলতানা, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, জাবি