সানদাকফু: পৃথিবীর উঁচু কয়েকটি পর্বতের শৃঙ্গ যেখানে

সাদা বরফে মোড়ানো পাহাড়। ছবি: লেখক
সাদা বরফে মোড়ানো পাহাড়। ছবি: লেখক

সানদাকফু যাওয়ার ইচ্ছে অনেক দিনের। অবশেষে সব প্রস্তুতি শেষ করে অফিস, বাড়ির অনুমতিপত্র নিয়ে যাত্রা শুরু করলাম সানদাকফুর উদ্দেশে। ইন্টারনেটের মাধ্যমে জেনে নিলাম আবহাওয়া, রাস্তা, কীভাবে যাব, কোথায় থাকব, খরচ কত ইত্যাদি। সমস্যা হলো, অফিসের ছুটি খুব কম। তাই খুব হিসেব করে সময় বাঁচিয়ে যতটুকু এগিয়ে যাওয়া যায়। ভয় হলো, আবহাওয়া যদি অনুকূলে না থাকে, তবে সময় বেশি লাগতে পারে। পাহাড়ে আবহাওয়া দ্রুত বদলায়। তাই অনেক প্ল্যান করে যেদিন থেকে ছুটি শুরু তার আগের দিন সন্ধ্যায় রওনা হয়ে সানদাকফুর কাছাকাছি পৌঁছানো। পাঁচজনের দল নিয়ে বেনাপোল দিয়ে বনগাঁ থেকে লোকাল ট্রেনে ২৫ রুপি ভাড়ায় কলকাতা।

ভূপৃষ্ঠ থেকে এত নীল আকাশ কমই দেখা যায়। ছবি: লেখক
ভূপৃষ্ঠ থেকে এত নীল আকাশ কমই দেখা যায়। ছবি: লেখক

আগেই অনলাইনে কলকাতা থেকে শিলিগুড়ি ট্রেনের টিকিট কাটা ছিল। টিকিট জনপ্রতি ৭০০ রুপি। তাই সময় নষ্ট না করে সোজা হাওড়া স্টেশনে গিয়ে ট্রেন। স্লিপার সিট না পাওয়ায় এসি চেয়ারে করে পরের দিন সকাল নয়টায় শিলিগুড়ি। অর্থাৎ আগের দিন বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত অফিস করে পরের দিন সকাল নয়টায় শিলিগুড়ি। যাঁদের পঞ্চগড়ের বাংলাবান্ধা দিয়ে ভিসা আছে, তাঁরা খুব সহজেই শিলিগুড়ি পৌঁছে যাবেন। আমি যেহেতু যশোরে থাকি তাই আমার জন্য বেনাপোল সুবিধা। শিলিগুড়ি থেকে ১ হাজার ১০০ রুপি দিয়ে ফোর হুইল ড্রাইভ জিপ রিজার্ভ নিয়ে রওনা দিলাম দার্জিলিংয়ের উদ্দেশে। এ যাত্রাপথ খুবই মনোমুগ্ধকর। রাজেষ খান্না ও শর্মিলী ঠাকুর অভিনীত সেই বিখ্যাত গানের কথা হয়তো সবার মনে আছে। ‘মেরে স্বপ্ন কি রানি কাব আয়ে গি তু’—রোমান্টিক এ গানের শুটিং এই রাস্তায় হয়েছিল। পাহাড়ের কোল ঘেঁষে রাস্তা। চা–বাগান। মেঘে ভিজে যাওয়া। পাহাড় প্যাঁচানো রাস্তা। মাঝেমধ্যে ছোট ছোট বাজার। আস্তে আস্তে ওপরে উঠছি। খাড়া পাহাড়ের গা ঘেঁষে কোনো রেস্তোরাঁয় দুপুরের খাবার খেয়ে তিন ঘণ্টা পর আমরা পৌঁছালাম দার্জিলিং শহরে। দার্জিলিংয়ের উচ্চতা ৭ হাজার ফুট। নিজেরাই একটা হোটেল ঠিক করে নিলাম ২ হাজার ৫০০ রুপিতে দুইটা রুম। সামান্য ফ্রেশ হয়ে বের হলাম আমাদের সানদাকফু ভ্রমণের সবকিছু ঠিক করতে। সব ঠিক করে হেঁটে হেঁটে শহর ঘুরলাম। দার্জিলিং শহরে কোথাও সমতল নেই। চৌরাস্তা নামক স্থানে একটু সমতল, এখানেই সবাই আড্ডা দেয়। দার্জিলিং শহর খুবই সুন্দর। রাতে পাহাড়ের গায়ে বাড়িঘরের বাতিগুলো মনে হয় তারার মেলা। রাতে ভীষণ ঠান্ডা পড়ে। তাপমাত্রা ৪–৫–এ নেমে আসে। তাই রাত ১১টার মধ্যে বিছানায়।

পাহাড়ের কোল ঘেঁষে রাস্তা। মেঘে ভিজে যাওয়া। পাহাড় প্যাঁচানো রাস্তা। ছবি: লেখক
পাহাড়ের কোল ঘেঁষে রাস্তা। মেঘে ভিজে যাওয়া। পাহাড় প্যাঁচানো রাস্তা। ছবি: লেখক

পরের দিন ভোরে ফোরহুইল ড্রাইভ জিপের চালক এসে হাজির। যাত্রা শুরু হলো। ২ ঘণ্টা পর পৌঁছালাম মানিভনজন। এখানে ভারত–নেপাল সীমান্ত। পাসপোর্টের ফটোকপি ও ২০০ রুপি দিয়ে কিছু প্রয়োজনীয় কাজ সেরে কিছুটা বিশ্রাম নিলাম। আমরা যে জিপ নিয়ে এসেছিলাম, সেটা আর যেতে পারবে না। নেপাল সরকার আরও শক্তিশালী জিপ ঠিক করে দিল। দক্ষ ইঞ্জিনিয়ার দিয়ে গাড়িটির টায়ার, ব্রেকশু, সব টেস্ট করে দিল। ল্যান্ড রোভার জিপ। খুবই শক্তিশালী। শুরু হলো পাহাড়ের ওপর ওঠা। কখনো ৬০ ডিগ্রি খাড়া উঠছে, সরু রাস্তা, এবড়োখেবড়ো পাথুরে, আবার কখনো ইউটার্ন নিয়েই ৬০ ডিগ্রি খাড়া। ভয়ংকর এক ভ্রমণ। নিচে তাকালে পিলে চমকে যাওয়ার অবস্থা। দলের দুয়েকজন ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে যাচ্ছিলেন। একজন তো যাবেন না বলেই দিলেন। অনেক বুঝিয়ে চোখ বন্ধ রেখে যাত্রা শুরু হলো। হাজার হাজার ফুট ওপরে। কখনো এত ঘন মেঘ যে জিপ দাঁড় করিয়ে রাখতে হয়। এটা নেপালের শিংগালিলা ন্যাশনাল পার্কের অন্তর্গত। পৃথিবীর বিরল প্রজাতির লাল পান্ডা এখানে আছে। এক পাশে ঘনজঙ্গল এক পাশে কাঞ্চনজঙ্ঘা পর্বত। সাদা বরফে মোড়ানো কাঞ্চনজঙ্ঘা। এক অসম্ভব সুন্দর প্রকৃতি। ওপরে উঠছি, আরও ওপরে, উঠছি তো উঠছিই। পাথুরে রাস্তা। আঁকাবাঁকা, খাড়া। প্রতি ১০ কিলোমিটার পরপর Tea House কাম base camp। এখানে ২০ মিনিটের বিরতি থাকে। যদি কেউ অসুস্থ হয়ে পড়ে, এখানে বিশ্রাম ও রাত্রযাপনের ব্যবস্থা আছে। ১০ কিলোমিটার যেতে এক ঘণ্টার ওপর সময় লাগে। এই Tea House গুলো খুবই সুন্দর। একবার ভাবুন খাড়া পাহাড়ের গায়ে বসে আপনি চা পান করছেন, চায়ের ধোঁয়া আর মেঘ একসঙ্গে মিশে একাকার। মেঘ আপনাকে ভিজিয়ে দিয়ে যাচ্ছে।

চা–বিরতি শেষে আবার ওপরে ওঠা শুরু। মেঘের স্তর শেষ হতেই এক অন্য রকম আকাশ চোখে পড়ল। নীল, গাঢ় নীল, অপার্থিব। ভূপৃষ্ঠ থেকে এত নীল আকাশ দেখা যায় না। নীলাকাশ, সাদা কাঞ্চনজঙ্ঘা, পাহাড় দেখতে দেখতে অবশেষে আমরা পৌঁছালাম ১১ হাজার ৯২৪ ফুট উচ্চতায় সানদাকফু। ভূপৃষ্ঠ থেকে যতই ওপরে ওঠা যায় বাতাসে অক্সিজেনের পরিমাণ ততই কমতে থাকে। যাদের উচ্চতায় খাপ খাইয়ে নেওয়ার ট্রেনিং নেই, তাদের অক্সিজেনের স্বল্পতার কারণে অতি উচ্চতায় ওঠা বিপজ্জনক। মাথা ঘোরা, বমি বমি ভাব, হার্টবিট বেড়ে যাওয়া, হাঁপিয়ে ওঠা, ঘুম না হওয়াসহ নানাবিধ সমস্যা দেখা দিতে পারে। এ সময় তরল খাবার যেমন চা, কফি, পানি, সফট ড্রিংকস ইত্যাদি খাবার খেলে কিছুটা আরামবোধ হতে পারে।

ভূপৃষ্ঠ থেকে ১১ হাজার ৯২৪ ফুট উচ্চতায় সানদাকফু। ছবি: লেখক
ভূপৃষ্ঠ থেকে ১১ হাজার ৯২৪ ফুট উচ্চতায় সানদাকফু। ছবি: লেখক

অনেকের পক্ষেই হিমালয়ের কাছে যাওয়া সম্ভব না। সানদাকফু থেকে এভারেস্টের চূড়া পরিষ্কার দেখা যায়। সবচেয়ে অবাক করা বিষয়, এখান থেকে পৃথিবীর কয়েকটি উঁচু পর্বতের শৃঙ্গ দেখা যায়। মাউন্ট এভারেস্ট, মাকালু, কাঞ্চনজঙ্ঘা, লোতসে। তবে এখান থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা আরও কাছে আরও সুন্দর দেখা যায়। ভীষণ সুন্দর এক জায়গা। সানদাকফু ভারতের পশ্চিমবঙ্গের সবচেয়ে উঁচু পর্বত। তাপমাত্রা ছিল ১২ ডিগ্রি, রাতে নেমে আসে ২–৩–এ। জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে স্নোফল হয়। তখন তাপমাত্রা মাইনাস থাকে। আকাশ খুবই পরিষ্কার ছিল বিধায় পর্বতের চূড়াগুলো পরিষ্কার দেখা যাচ্ছিল। এখানে রাতযাপনের জন্য কটেজ ও ১টা Tea House আছে।

সানদাকফু মূলত ট্রেকারদের জন্য খুব উপযোগী স্থান। যাঁরা পর্বত আরোহণ করতে চান, তাঁদের প্রাথমিক ট্রেনিং হিসেবে এখানে পাঠানো হয়। মানিভনজন থেকে সানদাকফু ৩১ কিলোমিটার পথ। প্রতিদিন ১০ কিলোমিটার করে পাহাড়ি পথে হেঁটে সানদাকফু পৌঁছাতে তিন দিন সময় লাগে। রাত হলে ১০ কিলোমিটার পরপর Tea House তো আছেই। অনেকে এখান থেকে ফালুট যান। ২১ কিলোমিটার দূরে একটা গ্রাম। যাই হোক সানদাকফু পৌঁছে কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে ছবি তুলে ফেরার পথে রওনা হলাম। অনেকে এখানে রাতযাপন করেন। বনে ও পাহাড়ে দ্রুত সন্ধ্যা নামে। পাহাড়ে নামা খুবই ভয়ংকর। জিপের ক্রু খুবই দক্ষ। এঁরা স্পেশাল প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। আস্তে আস্তে তিন ঘণ্টা সময় নিয়ে পৌঁছালাম মানিভনজন। এই জিপকে ৯ হাজার রুপি দিয়ে বিদায় করে যে জিপ দার্জিলিং থেকে নিয়ে এসেছিলাম সেই জিপ নিয়ে চলে এলাম দার্জেলিং। এই জিপকে সাড়ে ৩ হাজার রুপি দিয়ে রাত নয়টায় হোটেলে এসে ঘুম। দার্জিলিং থেকে সানদাকফু ৫৪ কিলোমিটার দূরে। সব মিলিয়ে ১৪ ঘণ্টার ভ্রমণ। পরের দিন দার্জিলিং থেকে শিলিগুড়ি হয়ে কলকাতা।

দার্জিলিং শহর খুবই সুন্দর। রাতে পাহাড়ের গায়ে বাড়িঘরের বাতিগুলো মনে হয় তারার মেলা। ছবি: লেখক
দার্জিলিং শহর খুবই সুন্দর। রাতে পাহাড়ের গায়ে বাড়িঘরের বাতিগুলো মনে হয় তারার মেলা। ছবি: লেখক

খুব কম খরচে শেষ করলাম অনন্য এক ভয়ংকর সুন্দর ভ্রমণ। পাঁচজনের দলের একেকজনের ৮ হাজার টাকার ওপর খরচ।