নিয়াজির নেতৃত্বাধীন বর্বর পাকিস্তানি বাহিনী সিলেট ও সুনামগঞ্জের চালায় গণহত্যা

পাকিস্তানের সেনাবাহিনী এবং তাদের দোসর শান্তি কমিটি, রাজাকার, আলবদর ও আলশামস বাহিনীর সহযোগিতায় এ দেশে হত্যাকাণ্ড চালানো হয়। ছবি: সংগৃহীত
পাকিস্তানের সেনাবাহিনী এবং তাদের দোসর শান্তি কমিটি, রাজাকার, আলবদর ও আলশামস বাহিনীর সহযোগিতায় এ দেশে হত্যাকাণ্ড চালানো হয়। ছবি: সংগৃহীত
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্যরাতে নিরস্ত্র বাঙালির ওপর ‘অপারেশন সার্চলাইট’-এর নামে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী হত্যাকাণ্ড চালায়। এটা বিশ্বের নজিরবিহীন হত্যাকাণ্ড। এখনো আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশের গণহত্যার স্বীকৃতি মেলেনি। বিশ্বের অন্যতম ভয়াবহ গণহত্যায় ৩০ লাখ মানুষ হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়। পাকিস্তানের সেনাবাহিনী এবং তাদের দোসর শান্তি কমিটি, রাজাকার, আলবদর ও আলশামস বাহিনীর সহযোগিতায় এ হত্যাকাণ্ড চলে। স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত ৫ হাজার বধ্যভূমির সন্ধান পাওয়া যায়। চিহ্নিত করা সম্ভব হয়েছে ১ হাজারের ওপর। বধ্যভূমি থেকে অসংখ্য মাথার খুলি, শরীরের হাড়গোড় ও চুল পাওয়া গেছে। ৬৪ জেলার গণহত্যা, বধ্যভূমি ও গণকবরের সংক্ষিপ্ত বিবরণের ধারাবাহিক থাকবে প্রথম আলো নাগরিক সংবাদে। আজ থাকছে সিলেট ও সুনামগঞ্জের গণহত্যা, বধ্যভূমি ও গণকবরের সংক্ষিপ্ত বিবরণ—

সিলেট

সিভিল সার্জন বাংলো বধ্যভূমি
পাহাড়ে সিলেটে সিভিল সার্জনের বাংলো ছিল পাকিস্তানিদের একটি কসাইখানা। এখানে অসংখ্য মুক্তিকামী মানুষকে হত্যা করা হয়। লাশগুলো মাটি চাপা না দিয়ে পাহাড়েই ফেলে রাখা হতো। তখন সেখানে লাশগুলোর আশেপাশের শেয়াল-শকুনের ভীড় লেগে থাকতো। লাশের পঁচা দুর্গন্ধে এপ্রিল মাসের শেষ দিকে এখান থেকে পাকিস্তানি বাহিনীর কসাইখানা অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া হয়।

খাদিমনগর চা বাগান বধ্যভূমি
১৯৭১ সালের ১৯ এপ্রিল খাদিমনগর চা বাগানের অবস্থানরত শ্রমিকদের রেশন দেওয়া কথা আহ্বান করলে তারা সমবেত হয় ব্যবস্থাপকের বাংলোর সামনে। তখন বলা হয়েছিল-ঐ ঘরে ঢুকলে তাঁদের নাম তালিকাভুক্ত করে রেশন দেওয়া হবে। নিরীহ শ্রমিকেরা তাদের কথামতো সেই ঘরে প্রবেশ করলে সঙ্গে সঙ্গে ঘরের দরজা বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং জানালা দিয়ে অসংখ্য টিয়ার গ্যাসের সেল ছুঁড়ে মারেন পাকিস্তানের সেনা সদস্যরা। এর ফলে গ্যাসে দম বন্ধ হয়ে ছটফট করতে থাকেন ৪৬ জন শ্রমিক। তখন পাকিস্তানী সেনাবাহিনী গুলি ছুঁড়ে তাদের হত্যা করেন। প্রাণ হারায় ৪৪ জন শ্রমিক। ৪৪ জন শ্রমিকের লাশগুলো ওই ঘরের বাম পাশে একটি গর্ত করে মাটিচাপা দেওয়া হয়। এই ঘটনায় শৈলেন মান্না ও নারায়ণ খোদাল বেঁচে যান।

আদিত্যপুর বধ্যভূমি
১৯৭১ সালের ১৪ জুন বালাগঞ্জ উপজেলার আদিত্যপুরে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী হত্যাযজ্ঞে শুরু করেন। এখানে রাজাকারদের সহযোগিতায় বাড়ি থেকে ৬৫ জন নিরীহ মানুষকে দড়ি দিয়ে বেঁধে আদিত্যপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে নিয়ে আসা হয়। এরপর তাজপুর-বালাগঞ্জ সড়কের অপর পাশে তাদের নির্মমভাবে হত্যা করে। এ ঘটনায় সেদিন শহীদ হয় ৬৩ জন নিরীহ বাঙালি। সুখময়চন্দ্র দেব ও শিবপ্রসাদ সেন চৌধুরী গুরুতর আহত হয়ে শেষ পর্যন্ত বেঁচে যান। ৬৩ জনের কয়েকজন হলে-সুকুমার সেন চৌধুরী, বিপুলচন্দ্র দেব, সুখেন সেন, দীঘিরাম চন্দ্র দেব, কৃষ্ণচন্দ্র দেব, যতীন্দ্র মোহন দাস, নরেশ দাস, অতুল আচার্য, রাধিকা রঞ্জন পুরকায়স্থ প্রমুখ।

বুরুঙ্গা বধ্যভূমি
১৯৭১ সালের ২৫ মে সিলেটের বালাগঞ্জ আসে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। তাঁরা এসে ঘোষণা দেন, পরদিন সকালে বুরুঙ্গা উচ্চ বিদ্যালয়ে একটি সভায় নির্বিঘ্নে চলাফেরার সুবিধার জন্য সবাইকে পরিচয়পত্র দেওয়া হবে। এ জন্য আশেপাশের প্রতিটি গ্রামের পুরুষদের উপস্থিত থাকে বলা হয়। পরেরদিন ২৬ মে বুধবার সকাল আটটা থেকে এলাকাবাসী নির্দিষ্ট স্থানে উপস্থিত হন। সকাল ১০টার দিকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী গ্রামবাসীকে দুভাগে বিভক্ত করেন। বুরুঙ্গা উচ্চ বিদ্যালয়ের উত্তর পাশের ভবনে মুসলমানদের আর ভবনের পূর্ব পাশে হিন্দুদের দাঁড়াতে বলেন। প্রায় দুপুর ১২টায় হিন্দুদের বুরুঙ্গা উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনের সবুজ চত্বরের একটি গাছের নিচে এনে বসতে বলা হয়। দালাল আবদুল আহমদ চৌধুরী অন্য কয়েক দালালসহ পাকিস্তানি বাহিনীর ক্যাপ্টেন নূরুদ্দিন খানের নেতৃত্ব সেখানে পৌছায়। নূরুদ্দিন খান নির্দেশে তাঁদের ওপর গুলি করে হত্যা করা হয়। পরদিন সকালে লাশগুলো পাশে একটি গর্ত করে পুঁতে রাখা হয়। এই হত্যাকাণ্ডে ৭৬ জনকে হত্যা করা হয়। বিশিষ্ট আইনজীবী রামরঞ্জন ভট্টাচার্যকে আলাদাভাবে বারান্দায় বসিয়ে হত্যা করা হয়। এখানে অনেক লুটপাট ও নারী নির্যাতন করা হয়। 

ভাটপাড়া গালিমপুর বধ্যভূমি

সিলেটের বালাগঞ্জের ভাটপাড়া-গালিমপুরে বধ্যভূমিতে ১৯৭১ সালের ১৯ মে এলাকায় অগ্নিসংযোগ করে এবং ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। তারা গালিমপুর গ্রামের সুরেশ রঞ্জন দাশ, রাকেশ রঞ্জন দাশ, রণেন্দ্র বিজয় দাশ, দিগেন্দ্র বিজয় দাশ, দেবব্রত দাশসহ আরো অনেককে গুলি করে হত্যা করে।

হরিকোনা বধ্যভূমি

সিলেটের হরিকোনার বধ্যভূমিতে এখানে বহু নিরপরাধ বাঙালিকে নৃশংসভাবে হত্যা করেছে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী।

বালাগঞ্জ বধ্যভূমি
বালাগঞ্জে বধ্যভূমিতে অসংখ্য মানুষকে হত্যার পর অনেক বিাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয়। বঙ্গবীর জেনারেল ওসমানীর বাড়িসহ অসংখ্য ঘরবাড়ি, দোকানপাট, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি। অনেক নারী নির্যাতনের স্বীকার হন। এই নারী নির্যাতনে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে আবদুল আহাদ চৌধুরী ও গৌছুর রহমান চৌধুরী।

উমরপুর বধ্যভূমি

পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকাররা মিলে উমরপুরে ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল। তাদের এই ভয়াবহ হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছিল অসংখ্য অসহায় নারী-পুরুষ-শিশু।

ইলাশকান্দি বধ্যভূমি

পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকাররা ১৯৭১ সালের ৮ এপ্রিল বালাগঞ্জের ইলাশকান্দি গ্রামে প্রবেশ করেন। এরপর তারা পুরো গ্রাম ঘেরাও করে এবং বাড়ি বাড়ি গিয়ে প্রায় ১৮ জন নিরীহ নারী-পুরুষ-শিশুকে ধরে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করেন। এরা হলেন মো. মকরম মিয়া, নুরুল ইসলাম চৌধুরী, ইদু মিয়া ও তাঁর বৃদ্ধ মা এবং পুতুল বিবির শিশু সন্তানসহ প্রমূখ।

সিলেট হাসপাতাল বধ্যভূমি
১৯৭১ সালের এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে সিলেটে পাকিস্তানি বাহিনীর প্রচণ্ড আক্রমণ শুরু করে। তাদের সেলিং, মর্টার ও মেশিনগানের গুলিতে অসংখ্য মানুষ মারা যায়। এছাড়া যাঁরা আহত হয়েছিল তাঁরা আশ্রয় নিয়েছিল সিলেট হাসপাতালে। আর এসব অসহায় মানুষকে চিকিৎসা দিয়ে বাঁচিয়ে তোলার দায়িত্ব নিয়েছিলেন ডা. শামসুদ্দিন আহমদ। ৯ এপ্রিল সকালে পাকিস্তানি বাহিনী হাসপাতালের চারদিক ঘেরাও ফেলে। এ সময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে দেয় মেজর রিয়াজ। পাকিস্তান সেনারা হাসপাতালের বিভিন্ন ওয়ার্ডে প্রবেশ করে এবং তারা ডা. শামসুদ্দিন আহমদ, ডা. শ্যামলকান্তি লালা, গাড়িচালক কোরবান আলী, মাহমুদুর রহমান ও আরও ৭ জন রোগীকে ধরে হাসপাতালের দক্ষিণপূর্ব কোণে নিয়ে গিয়ে একে একে গুলি করে হত্যা করে। তাঁদের লাশগুলো তিনদিন এই জায়গায় পড়ে থাকে। পরে কিছু লোক ঐ জায়গায় তাঁদেরকে কবর দেয়।

মির্জা জাঙ্গাল বধ্যভূমি
১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ সিলেটের পাকিস্তানি সেনাবাহিনী মির্জা জাঙ্গালের নিম্বার্ক আশ্রমে আক্রমণ চালায়। এখানে তারা হত্যা করে রাসবিহারী ধর ও পাঁচু বাবুকে। পরদিন ২৮ মার্চ আবার তারা নিম্বার্ক আশ্রমে হানা দিয়ে সুরতি ধর ও নরেন্দ্র দেকে ধরে দিয়ে যায়, এরপর তাঁদের আর কোনো সন্ধান পাওয়া যায় নি। ১০ এপ্রিল অধ্যক্ষ কৃষ্ণকুমার পাল চৌধুরীকে ধরতে না পেরে, তাঁকে আশ্রয় দেওয়ার কারণে পাকিস্তানি ক্যাপ্টেন করম খান আশ্রয়দাতা পদ্মকেশ চৌধুরীর ভাই ব্যোমকেশ চৌধুরীকে হত্যা করে। ডিসেম্বরে মির্জা জাঙ্গালস্থ ডা. দিগেন্দ্রকুমার এন্দ-র বাসা আক্রমণ করে এবং মর্টার নিক্ষেপ করে। এতে মারা যায় একই পরিবারের ডা. দিগেন্দ্রকুমার এন্দ, স্ত্রী সুনীতি বালা এন্দ, পুষ্পা এন্দ, দিব্যেন্দ এন্দ, শিখা এন্দ, অপু এন্দ, শিবানী এন্দ ও গোপেশ দাস। এছাড়া পাকিস্তানি বাহিনী হত্যা করে মির্জা জাঙ্গালের ব্যবসায়ী খসরুজ্জামানসহ আরও চার জনকে।

কলাপাড়া বধ্যভূমি
১৯৭১ সালের ৬ এপ্রিল বিকেল তিনটায় পাকিস্তানি বাহিনীর এক বিরাট বহর আসে কলাপাড়া বস্তিতে। তারা প্রতিটি নর-নারীকে তাদের তাঁবুতে হাজির হতে বলেন। কিন্তু তাদের ডাকে কোনো বাঙালিই সাড়া দেয় নি। ক্ষিপ্ত হয়ে পাকিস্তান বাহিনী লোকজনকে ধরে নিয়ে জড়ো করে কলাপাড়ার একটি বাড়ির সামনে। তাঁদের ওপর অমানুষিক নির্যাতনের পর, তাঁদের হিন্দু-মুসলমান দুই ভাগ কর হয়। মুসলমানদের মুক্তি দিয়ে হিন্দুদের ধরে একটি টিলার উপরে নেওয়া হয়। সেখানে তাঁদের সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করে। এই ঘটনায় যাঁরা শহীদ হয়েছিলেন, তাঁদের কয়েকজন হলে কালিয়া উড়িয়া, নকুল উড়িয়া, সধ্ব উড়িয়া, বীর উড়িয়া, বেণী উড়িয়া, নিতাই উড়িয়া, রমণ উড়িয়া, ছকু উড়িয়া প্রমুখ।

আখালি বধ্যভূমি
১৯৭১ সালের ২৮ মার্চ পাকিস্তানি হায়েনার দল সিলেটের আখালিতে প্রবেশ করেন। এখানে মদিনা মার্কেটে তারা ক্যাম্প প্রতিষ্ঠা করে এবং শুরু করে গণহত্যা। তারা মদিনা মার্কেটে নিরস্ত্র জনতার উপর গুলিবর্ষণ করে। এতে মানিক মিয়া, একজন রিকশাচালক, এক বৃদ্ধলোকসহ আরও অনেকে নিহত হয়। এরপর ১০ এপ্রিল নোয়াপাড়া গ্রামের আব্দুছ সাত্তার ও আবদুর রাজ্জাক দুজনকে গুলি করে হত্যা করে। ২৩ এপ্রিল আড়িখাইয়ের সুশীল চন্দ্র ঘোষকে এবং ২৫ এপ্রিল কলাপাড়ার পুলিন চন্দ্র দেবকে গুলি করে হত্যা করে। এ ছাড়া মুক্তিযুদ্ধে আখালিতে ব্যাপক লুটতরাজ, হত্যাযজ্ঞ ও নারী নির্যাতন চালায় পাকিস্তানি হায়েনার দল।

কালাগুল চা বাগান বধ্যভূমি
১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসের শেষের দিকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কালাগুল চা বাগানে প্রবেশ করে এবং ব্যবস্থাপকের বাংলোয় আস্তানা গড়ে তোলে। পাকিস্তান সেনাদের আগমনের কথা শুনে বাগানের শ্রমিকেরা পালাতে শুরু করেন, এতে কোনো কোনো শ্রমিক পালাতে সক্ষম হলেও অনেকেই ধরা পড়ে যান। ধৃত শ্রমিকদের সবাইকে জড়ো করে কালাগুল চা বাগানের কাঁঠালতলি জায়গায় সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করে। এঁদের মধ্যে ছিলেন কালোগুনা লোহার, কোষ লোহার, লালবান খাটুয়ার, সাধু বাউরি, তুফান লোহার, গোলক লোহার, ভুবন লোহার, ভীম লোহার ও মিঠাই লোহারসহ অন্তত ১৫ জন। মৃতদেহগুলো সেখানে যত্রতত্র পড়ে থাকে।

স্টার চা বাগান বধ্যভূমি
১৯৭১ সালের ১৮ এপ্রিল পাকিস্তান বাহিনী স্টার চা বাগানে প্রবেশ করে। এই চা বাগানের মালিক ছিলেন রাজেন্দ্রলাল গুপ্ত। পরিচয়পত্র দেওয়ার কথা বলে সবাই এক সঙ্গে শ্রমিকদের রাজেন্দ্রলাল গুপ্তের বাড়ির সামনে জড়ো করে। তারপর একসঙ্গে নিয়ে যায় পার্শ্ববর্তী মালনীছড়া চা বাগানের একটি টিলার পাশে। সেখানে মালিক,কর্মচারী ও শ্রমিকদের এই তিনভাগে বিভক্ত করে। টিলার তিন পাশে তিনজন সুবেদারের নেতৃত্বে তিনটি দলকে নিয়ে গিয়ে নির্বিচারে ৩৯জনকে হত্যা করে। তাঁদের কয়েকজনের হল- রাজেন্দ্রলাল গুপ্ত, রবীন্দ্রনাথ গুপ্ত, জহরলাল গুপ্ত, ক্ষিতীশ চন্দ্র দে, নরেশ চন্দ্র দেব, ফটিক রায় হালদার, ভারত ভল্লার, মহেন্দ্র কোরামোদী, পালেশ করোমোদী প্রমুখ। এছাড়া ৫ ও ৬ মে পুনরায় পাকিস্তানী বাহিনী স্টার চা বাগানে প্রবেশ করে আরও চার জনকে গুলি করে হত্যা করে।


গোয়ালাবাজার বধ্যভূমি
আওয়ামী লীগের গোয়ালাবাজার ইউনিয়ন সাধারণ সম্পাদক আবদুল মান্নান চৌধুরী, গদিয়ার চরগ্রামের আবদুল মনাফ ও মোড়লদাশ গ্রামের তোতা মিয়াকে আটক করে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। পাকিস্তানি সেনারা গোয়ালবাজারের পূর্ব দিকের হাওরে অজ্ঞাতপরিচয় দুজন, তাপেশ লাল ও নয়ান শুক্লা বৈদ্যকে গুলি করে হত্যা করে।

সাদিপুর বধ্যভূমি
১৯৭১ সালের ৮ এপ্রিল সিলেটের সাদিপুরে প্রবেশ করে পাকিস্তানি বাহিনী নির্বিচারে মানুষজনকে হত্যা করে। এ সময় মাসুক আহমদ নামের এক যুবককে তারা গুলি করে হত্যা করে। পাকিস্তান গ্রামে যাকে পায় তাতে বন্দি করে ধরে নিয়ে যায় সাদিপুর ফেরিঘাটে। রশি দিয়ে বেঁধে তাঁদের নৃশংসভাবে গুলি করে হত্যা করে। এই ঘটনায় আলী বক্স, বেটু মিয়া, টেনাই মিয়া, তরণী চন্দ্র বৈদ্য, খয়ের উদ্দিন চৌকিদার ও লদইসহ অনেকে শহীদ হন। সাদিপুর গ্রামে হামলা চালালে নিরস্ত্র অসহায় গ্রামবাসী পালিয়ে যেতে শুরু করে, এই পলায়নপর অবস্থায়ই তারা গুলি করে হত্যা করে কয়েকজন নিরীহ মানুষকে। তাঁরা হলেন টেনাই উল্লাহ, সুলতান উল্লাহ, সাধু মিয়া, সৈয়দ আনসার আলী, করম উল্লাহ প্রমুখ।

এ ছাড়া সিলেটে অসংখ্য বধ্যভূমি রয়েছে। উল্লেখযোগ্য হলো আবহাওয়া অফিস বধ্যভূমি, সুরিকোনা বধ্যভূমি, বারুতখানা বধ্যভূমি, টুলটিকর বধ্যভূমি, মছকন্দের খাল বধ্যভূমি, জৈন্তাপুর বধ্যভূমি, খরিসের পুল বধ্যভূমি, গোয়াইন নদী বধ্যভূমি, মডেল স্কুল বধ্যভূমি, জ্ঞানবাবুর বাড়ি, খাজাঞ্চি বাড়ি,মহাজান পট্টি, সিলেটে এমসি কলেজ, বিমানবন্দর বধ্যভূমি।

সুনামগঞ্জ

শ্রীরামসি বধ্যভূমি
১৯৭১ সালের ৩১ আগস্ট সকাল নয়টায় ৭-৮টি নৌকা বোঝাই হয়ে পাকিস্তানি সেনারা এদেশীয় কয়েকজন রাজাকারকে নিয়ে শ্রীরামসি গ্রামে এসে পৌঁছে। সকাল ১০টায় তারা প্রায় পুরো গ্রাম ঘেরাও করে শান্তি কমিটি গঠনের নাম করে গ্রামবাসীকে এক জায়গায় সমবেত হওয়ার আহ্বান জানায়। এ আহ্বানে তারা সাড়া না দিলে, পাকিস্তানি সেনাদের অস্ত্রের মুখে বহু গ্রামবাসীকে ধরে আনা হয় শ্রীরামসি স্কুল মাঠে। এই মাঠে তাদের সবাইকে বেঁধে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে ব্রাশফায়ারে হত্যা করা হয়। এই হত্যাকাণ্ডে কয়েকজনের নাম হলো প্রধান শিক্ষক ছাদ উদ্দিন, এহিয়া চৌধুরী, তহশীলদার সত্যেন্দ্র নারায়ণ চক্রবর্তী, তহশীলদার সৈয়দ আশরাফ হোসেন, শফিকুর রহমান, ফিরোজ মিয়া, সুনু মিয়া, মানিক মিয়া, আবদুল আজিজ, দবির মিয়া, আবদুল মান্নান, সবুজ মিয়া প্রমুখ।


রানিগঞ্জ বাজার বধ্যভূমি
১৯৭১ সালের ১ সেপ্টেম্বর বেলা ১১টায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আসে রানিগঞ্জ বাজারে। পাকিস্তানি সেনারা এই বাজার ঘিরে ফেলে এবং বাজারের দুই শর বেশি লোককে বেঁধে এক লাইনে দাঁড় করায়। তারপর গর্জে ওঠে পাকিস্তানি সেনাদের হাতের রাইফেলগুলো, মুহূর্তেই সব স্তব্ধ হয়ে যায়। এ হত্যাকাণ্ডের যাঁরা শহীদ হন, তাদের মধ্যে কয়েকজন হলেন তছর উদ্দিন, সোনাহর আলী, আলতা মিয়া, মদরিছ উল্লা, ধন মিয়া, মিছির আলী, আবদুল হেকিম, আপিল মাহমুদ, আছাল মিয়া, ছয়েব উদ্দিন, আতাউর রহমান, বোরহান উদ্দিন প্রমুখ।

ছাতক বধ্যভূমি

১৯৭১ সালের ২৮ এপ্রিল পাকিস্তানি বাহিনী সুনামগঞ্জের ছাতক উপজেলায় প্রবেশ করে। শুরু হয় হত্যাকাণ্ড, লুটতরাজ ও অগ্নিসংযোগ। ওই দিন পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে শহীদ হয়েছিলেন, তারা হলেন সিলেট কারিগরি মহাবিদ্যালয়ের ছাত্র দিলীপ কুমার তরাত ও জ্যোতির্ময় দত্ত নানু, ছাতক সিমেন্ট ফ্যাক্টরির কেরানি কলিম উদ্দিন, ছাতকের ব্যবসায়ী যোগেন্দ্র দত্ত ও রুনু দাস, জিতেন্দ্র দাস প্রমুখ। এ ছাড়া ২৬ মে ছাতকের বেতুরা গ্রামের পাশ দিয়ে সীমান্তে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া ১৮ জন যুবককে বেতুরার ফকির চেয়ারম্যান পাকিস্তানি হায়েনাদের হাতে তুলে দেয়। হায়েনারা এর মধ্যে ১৭ জনকে গুলি করে হত্যা করে মাটিচাপা দিয়ে রাখে। এ ছাড়া ছাতক উপজেলার ১১ জন মুক্তিযোদ্ধা সম্মুখযুদ্ধে শহীদ হয়েছিলেন, তারা হলেন ফিরোজ মিয়া, পীযূষ কান্তি সরকার, ময়না মিয়া, মোহাম্মদ মোস্তফা খলকু মিয়া-১, খলকু মিয়া-২, হোসেন আলী, মনাই মিয়া, আঞ্জব আলী, আলী আহমদ ও হুসিয়ার আলী।

গাজীপুরের সাগরদিঘী বধ্যভূমি
পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ২ মে সুনামগঞ্জের চুনারুঘাটের সীমান্ত ইউনিয়নের গাজীপুরের গ্রাম আক্রমণ চালাই। গাজীপুরের এই সাগরদিঘীর পাড়কে বধ্যভূমি পরিণত করে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। এখানে আহমাদবাদ ইউনিয়নের নালুয়া চা বাগানের ধরমনাথ লেনে ২০-২৫ জনকে হত্যা করে একটি পানি কূপে ফেলে দেওয়া হয়।

এখনো আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশের গণহত্যার স্বীকৃতি মেলেনি। বিশ্বের অন্যতম ভয়াবহ গণহত্যায় ৩০ লাখ মানুষ হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়। ছবি: সংগৃহীত
এখনো আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশের গণহত্যার স্বীকৃতি মেলেনি। বিশ্বের অন্যতম ভয়াবহ গণহত্যায় ৩০ লাখ মানুষ হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়। ছবি: সংগৃহীত

তথ্যসূত্রমুক্তিযুদ্ধবিষয়ক ত্রৈমাসিক স্বপ্ন ৭১-এর গণহত্যা ৭১ সম্পাদিত আবু সাঈদ;একাত্তরের বধ্যভূমি ও গণকবর-সুকুমার বিশ্বাস, পৃ.- ১১৬-১১৭,পৃ.- ১২১, ৩৮৭ যুদ্ধাপরাধ গণহত্যা ও বিচারের অন্বেষণ-ডা. এম এ হাসান, পৃ.- ৩৪৬, দৈনিক পূর্বদেশ, ৩০ জানুয়ারি ১৯৭২, সিলেটে গণহত্যা-তাজুল মোহাম্মদ, পৃ.- ৩৮-৪০, দৈনিক সংবাদ, ১৮ জুন ১৯৯৫

আবু সাঈদ: কবি, সংগঠক ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষক। [email protected]

আরও পড়ুন:
প্রথম পর্ব: পঞ্চগড়–ঠাকুরগাঁওয়ে গণহত্যা, বধ্যভূমি ও গণকবর
দ্বিতীয় পর্ব: দিনাজপুর ও নীলফামারীর গণহত্যা, বধ্যভূমি ও গণকবর
তৃতীয় পর্ব: রংপুর ও কুড়িগ্রামে ১৯৭১ সালে গণহত্যা, বধ্যভূমি ও গণকবর
চতুর্থ: মুক্তিযুদ্ধে লালমনিরহাট ও গাইবান্ধায় গণহত্যা
পঞ্চম পর্ব: মুক্তিযুদ্ধে জয়পুরহাট ও বগুড়ার গণহত্যা ও গণকবর
ষষ্ঠ পর্ব: মুক্তিযুদ্ধে রাজশাহীর গণহত্যা ও বধ্যভূমি
সপ্তম পর্ব: মুক্তিযুদ্ধে নওগাঁ ও নাটোরের গণহত্যা, বধ্যভূমি
অষ্টম পর্ব: ১৯৭১ সালে সিরাজগঞ্জ ও পাবনায় গণহত্যা
নবম পর্ব: ১৯৭১ সালে চাঁপাইনবাবগঞ্জের গণহত্যা
দশম পর্ব: ১৯৭১ সালের ময়মনসিংহ ও জামালপুরের গণহত্যা, গণকবর ও বধ্যভূমি
১১তম পর্ব: মুক্তিযুদ্ধে নেত্রকোনা ও কিশোরগঞ্জে গণহত্যা
১২তম পর্ব: টাঙ্গাইল ও শেরপুরের একাত্তরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গণহত্যা