ফাগুন চলে যাওয়ার সাত মাস

নিহত তরুণ সাংবাদিক ইহসান ইবনে রেজা ফাগুন। বাড়ি ফেরার পথে ২১ মে তাঁকে হত্যা করা হয়। অভিযোগ রয়েছে, সাংবাদিকতার জন্যই তাঁকে হত্যা করা হয়।
নিহত তরুণ সাংবাদিক ইহসান ইবনে রেজা ফাগুন। বাড়ি ফেরার পথে ২১ মে তাঁকে হত্যা করা হয়। অভিযোগ রয়েছে, সাংবাদিকতার জন্যই তাঁকে হত্যা করা হয়।

এমন হয় কেন! বাস থেকে একটা পলিথিন পড়ল পায়ের ওপর। পলিথিন ভরা বমি। ঘেন্না হওয়ার কথা, অথচ হলাম আশ্চর্য। আমার সঙ্গেই কেন! রাস্তায় তো আরও লোক ছিল, তাদের ওপর তো পড়ল না! এর একটা ব্যাখ্যা হতে পারে, যে ব্যাখ্যায় দোষটা শেষমেশ আমারই হওয়ার কথা। অন্যমনস্ক ছিলাম, অন্যরা ছিল মনস্ক। ওই যে বিজ্ঞানমনস্কের মতো মনস্ক আর কী। না হয় হাইওয়ে দিয়ে হাঁটার কী দরকার, এমন প্রশ্ন। দোষটা আমারই। ব্যাখ্যা এবং দায় এমনটাই।

ফাগুনেরও এমন অবস্থা ছিল। ও বলত, ‘দাওয়াতে খেতে বসলে আমার সামনে এসেই রোস্টের বাসনটা খালি হয়ে যেত। খেতে গিয়ে হঠাৎ গ্লাস উল্টে পড়ত টেবিলে।’ আমি বলতাম, তুই অতিভদ্র, সবাইকে ভালো জায়গা ছেড়ে দিয়ে তুই বসিস সব সময় শেষের দিকে, তাই দাওয়াতে রোস্ট থেকে বঞ্চিত হোস। আর খেতে বসে এক হাতে মোবাইল ফোন এবং সেই মোবাইল ফোনে দৃষ্টি নিবদ্ধ থাকলে তো গ্লাস উল্টে পড়বেই। অর্থাৎ দোষটা ওরই।

এসবই ট্রেন্ডি ব্যাখ্যা এবং মূলত অর্থহীন। কখন কী হবে, তা বলার সাধ্য কারও নেই। কেন হলো তা হওয়ার পর ব্যাখ্যা করা যায়, হওয়ার আগে আভাস দেওয়াও সম্ভব হয় না। ঘূর্ণিঝড়, সুনামি—এসবের পূর্বাভাস দেওয়া যায়, জানি এমনটা বলবেন কেউ কেউ। কিন্তু কে মারা যাবেন, তার ধারণা কি দেওয়া যাবে? যাবে না। যায় না। তবে মৃত্যুর পর দোষটা হয় মৃতেরই। বলা হয়, আশ্রয়কেন্দ্রে যায়নি। গেলেও একেবারে কিনারায় ছিল, যার ফলেই মারা গেছে। ফলে ঘটে যাওয়ার দায়টা তার, মৃতের!

আমাদের বর্তমান অবস্থাটাও তেমনি। কেউ মারা গেলে আগে তার দোষ খোঁজা হয়। অন্ধকার রাস্তায় একা গেল কেন, বাসে গেল কেন, বর্ষায় লঞ্চে কেউ যায়—এমন সব কথা বা দোষ! আমার ফাগুনকে নিয়েও অনেকে বলেন, ও ট্রেনে আসতে গেল কেন। আরে, স্বাধীন একটা দেশে স্বাধীন একটা তরুণ কিসে আসবে না আসবে, সেটা তার ইচ্ছা। তাকে নিরাপত্তা দেওয়ার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। না হলে মানুষের রাষ্ট্রের দরকার ছিল না। রাষ্ট্র হয়েছে নাগরিকদের নিরাপত্তা বিধানের শর্তেই। সেই শর্ত ভঙ্গ হলে সেটা রাষ্ট্রের ব্যর্থতা।

ইহসান ইবনে রেজা ফাগুন, ফাগুন রেজা। উদীয়মান গণমাধ্যমকর্মী। গণমাধ্যমের ইংরেজি বিভাগে সহসম্পাদক (সাব-এডিটর)। প্রতিভা, সততা আর প্রতিশ্রুতির অপূর্ব সমন্বয়। এমন একজনকে রক্ষা করা রাষ্ট্রের ফরজ। সেই ফরজ কাজ সম্পন্ন করতে পারেনি রাষ্ট্র। সাত মাস আগে, মে মাসের ২১ তারিখে ঢাকা থেকে বাড়ি ফিরতে গিয়ে নিখোঁজ হয় সে। পরে তার মৃতদেহ পাওয়া যায় জামালপুরের কাছে রেললাইনের ধারে। তার অগ্রজ এবং সহকর্মীরা বলেন, সাংবাদিকতার আগুন ছিল ফাগুনের মাঝে। সেই ফাগুন আমার বড় ছেলে। আমি পিতা হিসেবে ওর মৃতদেহ কাঁধে নিয়েছি। পৃথিবীর সবচেয়ে ভারী বোঝা বইতে হয়েছে আমায়। সাংবাদিক হিসেবে নিজ সাংবাদিক পুত্রের হত্যাকাণ্ড নিয়ে লিখেছি। একজন সাংবাদিকের জন্য এর চেয়ে যাতনার কিছু হতে পারে না। সেই যাতনা সয়েছি আমি, সয়ে যাচ্ছি এবং যাব। সঙ্গে লিখে যাব।

ফাগুন ট্রেনে ফিরছিল। অনেকেই বলেছেন, ট্রেনে এল কেন? এমনকি দায়িত্বশীলও অনেকে বলেছেন, ‘ট্রেনের অবস্থা খারাপ, নানা গ্রুপ রয়েছে, রয়েছে অজ্ঞান পার্টি, এর মধ্যে ট্রেনে আসতে গেল কেন!’ কী অদ্ভুত কথা! তাঁরা জানেন ট্রেনের অবস্থা খারাপ, অথচ এর প্রতিকার হয় না। দীর্ঘ এক বছরে রেললাইনের পাশে পাওয়া গেছে অনেকের লাশ। গণমাধ্যম বলছে, এগুলোর বেশির ভাগই হত্যাকাণ্ড। অথচ মৃতদের নাম জমা হচ্ছে অপমৃত্যুর খাতায়। ট্রেনে অজ্ঞান পার্টি রয়েছে, রয়েছে ছিনতাইকারী। তারা সামান্য জিনিসের জন্য মানুষ মেরে ফেলছে। করছে টার্গেট কিলিং। বিপরীতে তারা ধরা পড়ছে কয়জন। এত ফাঁসির আওয়াজ শুনি, এদের কারও কি ফাঁসি হয়েছে? গত এক দশকে রেললাইনের ধারে এসব হত্যাকাণ্ডের শিকার কেউ ন্যায়বিচার পেয়েছে কি? পায়নি। কেন পায়নি, এর জবাবও দেওয়ার কথা রাষ্ট্রের। অথচ কোথাও কোনো শোর নেই, এ ব্যাপারে ‘স্পিকটি নট’! এমন নিঃশব্দতায় নাগরিকেরা যাবেন কই!

আমাদের দেশে মৃত্যু এত সহজ হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, এখন মারা গেলে প্রতিকারের বিপরীতে খোঁজা হয় মৃতের দোষ। যেন মৃতকেই সবাই শূলে চড়াতে চায়। এ এক উল্টো নিয়মের দেশ। লঞ্চ, বাস, ট্রেনে অতিরিক্ত মানুষ। ছাদে মানুষ, ভেতরে দাঁড়ানো মানুষ, কেউ দেখার নেই। স্টেশনগুলোতে সিসি ক্যামেরা নেই। কারা চড়ল, কারা মারল আর কে মরল, বোঝার উপায় নেই। দুর্ঘটনায় মানুষ মরছে, খুন হচ্ছে, আগুনে পুড়ে মরছে, নিখোঁজ হচ্ছে, কোথাও কোনো মাথাব্যথা নেই। আমার ছেলে যখন নিখোঁজ। ওর মা আর আমি খুঁজে বেড়াচ্ছি পাগলের মতো, তখন অনেকে বলেছেন, ‘এই বয়সের ছেলে, দেখেন কোথায় কী করছে।’ তাঁদের বোঝাতে ব্যর্থ হয়েছি, বয়সে তরুণ হলেও মানুষ হিসেবে ফাগুন দায়িত্বশীল এবং চিন্তার মার্গটাও উঁচুতে। পরে যখন গণমাধ্যমে ওকে নিয়ে খবর বেরোল, তখন তাদের মুখে ছিল আফসোসের বাণী।

বলিহারি এমন আফসোসের। ঘটনা ঘটার পরের এ আফসোস হলো নিজ সামর্থ্যের অক্ষমতাপ্রসূত। এমন আফসোসের ধারণা রাষ্ট্রের ব্যর্থতা থেকে উৎসারিত। বয়সে তরুণ হলেও ফাগুনের চিন্তার মার্গ ছিল এনাদের চেয়ে অনেক ওপরে। চিন্তার উচ্চতা না থাকলে পড়াশোনার পাশাপাশি চাকরির কথা ভাবত না ফাগুন। ও বলত, ‘আব্বুজি, বাইরে আঠারোর পরেই মানুষ জব শুরু করে, আমার তো বিশ, আমি কেন করব না।’ এমন অগ্রসর চিন্তার কজন রয়েছে এ দেশে।

এখন পর্যন্ত ফাগুনের খুনিরা ধরা পড়েনি। কেন পড়েনি, সে কথা লিখতে গেলে মহাভারত হয়ে যাবে। যদি সময় এবং সুযোগ হয়ে ওঠে, লিখব অবশ্যই।

আজ সাত মাস ফাগুন চলে যাওয়ার। বাবা হিসেবে প্রতিদিন আর ক্ষণ যায় গুনে গুনে। প্রতিদিন চাই, ওকে যেন মনে না হয়, যেন ভুলে যেতে পারি। তাহলে হয়তো ভেতরের যাতনা ও ক্ষোভ কিছুটা কমবে। নানা কাজে মন দেওয়ার চেষ্টা করি। ব্যর্থ সেই চেষ্টা। হয় না, ভুলে থাকা যায় না। ভোলার চেষ্টায় আরও বেশি মনে পড়ে যায়। ফাগুনকে মনে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ে যায় তার প্রতি ঘটে যাওয়া নিষ্ঠুরতার কথা, তাকে রক্ষার ব্যর্থতার কথা। বুকের হাপরে ক্রমশ ক্রোধ জমে, ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হয়। মাঝেমধ্যেই মাথার ভেতর রাগী গলায় নবারুণ ভট্টাচার্য বলে ওঠেন, ‘এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না, এই জল্লাদের উল্লাসমঞ্চ আমার দেশ না।’ পরক্ষণেই নিজেকে সান্ত্বনা দিই। বলি, ‘আমি আমার দেশকে ফিরে কেড়ে নেব’, যেমন নিতে চেয়েছিল ফাগুন।

*কাকন রেজা, সাংবাদিক ও ফাগুন রেজার বাবা