দক্ষিণবঙ্গ: প্রকৃতি, জল আর মানুষের গল্প-পর্ব ২

পর্যটকদের জন্য অনিন্দ্যসুন্দর জায়গা। ফাইল ছবি
পর্যটকদের জন্য অনিন্দ্যসুন্দর জায়গা। ফাইল ছবি

দক্ষিণবঙ্গের প্রকৃতি, জল আর মানুষের গল্প নিয়ে তিন পর্বের দ্বিতীয়টি পড়ুন আজ রোববার।

কক্সবাজারের পর আমাদের পরবর্তী গন্তব্য চট্টগ্রাম। আমার জন্মস্থান। সেখানে আমার বাবার বাড়িতে এক কাজিন তার সদ্য বিবাহিতা স্ত্রী, শালি এবং আরও দুজন কাজিনসহ আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। তারা সবাই আজ সকালে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম বেড়াতে এসেছে। মাইক্রোবাস ভাড়া করা হয়েছে, ঘোরার প্ল্যানও ঠিকঠাক। এখন শুধু আমাদের চট্টগ্রামে ফেরার অপেক্ষা।

তিন ঘণ্টার বাসযাত্রা শেষে বেলা একটার দিকে আমরা বাসায় পৌঁছালাম। তারপর হুড়োহুড়ি করে গোসল আর খাওয়া সেরে বেলা তিনটার দিকে কাজিনদের দলসহ বেড়াতে বের হয়ে গেলাম। কক্সবাজারে সমুদ্রের পানিতে দুই দিন ঝাঁপাঝাঁপি করেও আমরা তিনজন, মানে আমি, সাত বছরের কন্যা প্রমিতি আর তার বাবা মোটেও ক্লান্ত ছিলাম না। শুধু আমাদের তিনজনের চেহারাই রোদে পুড়ে কালো হয়ে গিয়েছিল, এই যা। আমাদের প্রথম গন্তব্য ভাটিয়ারী। চট্টগ্রাম শহর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার উত্তরে ভাটিয়ারী এলাকাটি অবস্থিত। পাহাড়ের বেশ ওপরে সবুজ বনানীতে ঘেরা অসম্ভব সুন্দর একটা জায়গা। এখানে আরও আছে স্ফটিক স্বচ্ছ জলের লেক, সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রিত গলফকোর্স। ভাটিয়ারী আমি আগে একবার গেছি, তারপরও সেখানে পৌঁছানোর পর তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে নতুন করে মুগ্ধ হলাম। বর্ষার স্পর্শে পাহাড় আর জঙ্গল ঝকঝকে সবুজ রং ধারণ করেছে। লেকের পানি অনেক ওপরে উঠে এসেছে। আমরা একটা বোট ভাড়া করে অনেকক্ষণ লেকে ঘুরলাম। দীর্ঘ লেকটি পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে বয়ে চলেছে। আবহাওয়া মেঘলা হওয়ায় পাহাড়, লেক, গাছপালা—সব মিলিয়ে বিকেলের নিভে আসা আলোয় প্রকৃতি যেন তার রূপের ডালি মেলে ধরেছ। ভাটিয়ারীর গলফকোর্সটাও খুব সুন্দর, বাংলাদেশে এত সুন্দর গলফকোর্স আর একটাও আছে বলে মনে হয় না। তবে সেখানে ঢুকতে গেলে অনুমতি নেওয়া লাগে। এ ছাড়া এখানে সানসেট পয়েন্ট বলে একটা স্পট আছে, যেখানে পাহাড়ের ওপর থেকে দূরে সমুদ্রে সূর্যাস্তের দৃশ্য দেখা যায়। তবে এবারের যাত্রায় আমাদের শুধু লেকে নৌকা ভ্রমণে সন্তুষ্ট থাকতে হলো। কেননা, আমাদের পরবর্তী গন্তব্য বহুদূর, আমাদের সবার অত্যন্ত প্রিয় জায়গা। যে জায়গায় যাওয়া ছাড়া চট্টগ্রাম ভ্রমণ অপূর্ণ থেকে যায়। নাম তার নেভাল।

নেভাল জায়গাটার আরেক নাম রিভার সাইড। এটি কর্ণফুলী নদীর মোহনায় অবস্থিত। অর্থাৎ এখানে নদীটি সমুদ্রের সঙ্গে মিশেছে। বাংলাদেশ নেভাল একাডেমি এবং পতেঙ্গা বিচের একদম সংলগ্ন নেভাল নামে পরিচিত জায়গাটি মূলত কর্ণফুলী নদীর পাশে বাঁধ দেওয়া উঁচু রাস্তা, যার সিমেন্ট বাঁধানো রেলিংয়ে বসে নদীর নির্মল বাতাস উপভোগ করা যায়। নদীর বুকে নোঙর করে থাকা ছোট আকৃতির জাহাজগুলোর ঢেউয়ের তালে দুলতে থাকা মন ভরিয়ে দেয়। আস্তে আস্তে সন্ধ্যা ঘনানো শুরু হলে নদীর সৌন্দর্য আরও বাড়তে থাকে। সেই সঙ্গে ওপারে বিশাল এলাকাজুড়ে থাকা কর্ণফুলী ফার্টিলাইজার কোম্পানি লিমিটেডের কারখানায় একে একে অসংখ্য বাতি জ্বলে ওঠে। সে এক নয়নাভিরাম দৃশ্য। বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজনসহ চট্টগ্রামবাসী এখানে আসে কর্ণফুলী নদীর সৌন্দর্য উপভোগ করতে। রাত যত বাড়ে, নদীর পাড়ে বসে থাকতে তত ভালো লাগে। বাতাস আরও নির্মল হয় ওঠে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের পাশাপাশি এখানকার একটি বড় আকর্ষণ হলো, রাস্তার পাশের ঝুপড়ি দোকানে ভাজা গরম–গরম পেঁয়াজু আর ঝাল ঝাল কাঁকড়া ভুনা। নেভালে গিয়ে এই দুটি জিনিস পরখ না করলে চট্টগ্রামে বেড়ানোই অপূর্ণ থেকে যায়।

এমন সাজানো পথে ঘুরতে কার না ভালো লাগে। ফাইল ছবি
এমন সাজানো পথে ঘুরতে কার না ভালো লাগে। ফাইল ছবি

আমাদের জন্য ভাটিয়ারী থেকে নেভালে যাওয়াটা প্রকৃতপক্ষে একেবারেই বাজে একটা প্ল্যান ছিল। কেননা, দুটি স্পট চট্টগ্রাম শহরের দুই মাথায়। কিন্তু পরের দিন আমরা ঢাকা চলে আসব, আমার কাজিনরা যদিও থেকে যাবে, কিন্তু নদী দেখতে দেখতে কাঁকড়া ভাজা তারা আমাদের ছাড়া খেতে রাজি নয়। অতএব, যেতেই হলো। ভাটিয়ারী থেকে রওনা হয়ে দুই ঘণ্টার বেশি জার্নি করে আমরা যখন নেভালে পৌঁছালাম, তখন রাত আটটা বেজে গেছে। এর মধ্যে শুরু হয়েছে তুমুল বৃষ্টি। বাধ্য হয়ে আমাদের অবস্থান নিতে হলো মাইক্রোবাসের ভেতরেই। তাই কর্ণফুলীর মোহনা দর্শন আর নির্মল বাতাস সেবন তেমন জমল না। আমার মনটা একটু খারাপই হলো বটে। সেই কষ্ট অবশ্য গরম–গরম পেঁয়াজু আর কাঁকড়া ভাজা কিছুটা লাঘব করল।

পরের দিন বিকেলে আমাদের ট্রেন। সারা দিন আমরা ঘরে বসে গল্পগুজব করেই সময় পার করলাম। আমাদের বাসাটা চট্টগ্রাম শহরের একদম কেন্দ্রে হলেও এলাকাটা পাহাড়ে ঘেরা। নাম বাঘঘোনা। একসময় এখানে ঘন জঙ্গল ছিল, বাঘও থাকত। তাই এই নাম। আমাদের বাসার পেছনেই একটা পাহাড়ি ঢাল। সারা বছর সেই জঙ্গল সবুজ গাছপালায় ঢেকে থাকে। সেখানে ফুটে থাকে নাম না জানা নানা বর্ণের পাহাড়ি ফুল। এই পাহাড়টি চট্টগ্রাম বিভাগজুড়ে থাকা পাহাড়ের সারির অংশ। ছোটকালে যখন জঙ্গল ঘন ছিল, প্রায়ই দেখতাম বাসার সীমানাপ্রাচীরের ওপারে বড় বড় গুইসাপ রোদ পোহাচ্ছে। শিয়ালের বাচ্চাও দেখেছি। একটু দূরের পাড়ায় বেড়াতে গিয়ে একবার একটা মৃত চিতাবাঘও দেখেছিলাম। এলাকার মানুষ পিটিয়ে মেরে ফেলেছে। কয়েক বছর আগ পর্যন্তও একটা বড় বাগডাশ আমাদের বাসার পেছনে পাহাড়ের ঢালের নিচের সমতল অংশে রাতের বেলা খাবারের খোঁজে হেঁটে বেড়াত। একটা বড় কুবো পাখি দিনেরবেলা ওড়াউড়ি করত। বড় কুবো পাখি আকারে একটা মুরগির সমান। গায়ের রং খয়েরি আর নীল। বিশাল লম্বা লেজ আছে। বাগডাশ এবং বড় কুবো দুটিই বিলুপ্তপ্রায় প্রাণী। আমরা প্রকৃতির এই দুই বিরল সন্তানকে খুব ভালোবাসতাম। এ ছাড়া টিয়া, দোয়েল, ঘুঘু, বুলবুলিসহ নাম জানা না-জানা কত পাখি যে ছিল আমাদের এলাকায়। কাঠবিড়ালি গাছ থেকে গাছে দৌড়ে বেড়াত। বাসার গা ঘেঁষে থাকা কামরাঙ্গাগাছে থোকায় থোকায় দারুণ সুন্দর ফুল ফুটে থাকত। বাসা থেকে এক গলি পরেও আরেকটা পাহাড় আছে। আমরা সকালবেলা দল বেঁধে সেই পাহাড়ে মর্নিংওয়াকে যেতাম। এখন প্রকৃতি আগের মতো নেই। গলিতে গলিতে আম, কাঁঠালের গাছ নেই। তালগাছের অভাবে বাবুই পাখিরা আর বাসা বাঁধে না। বাগডাশ আর বড় কুবোটিকেও কয়েক বছর ধরে আর দেখি না। হয়তো কোনো দুষ্ট মানুষ তাদের মেরে ফেলেছে। মানুষের মতো নিষ্ঠুর প্রাণী তো পৃথিবীতে আর একটিও নেই। এলোমেলোভাবে গড়ে ওঠা ঘরবাড়ির আড়ালে আশপাশের সব পাহাড় চাপা পড়েছে। শুধু আমাদের বাসার পেছনের পাহাড়টাই টিকে আছে। কেননা, এটা ব্যক্তিগত সম্পত্তি। পাহাড়ের অবশিষ্ট এই অংশটুকুই অবশ্য মনে প্রশান্তি আনার জন্য যথেষ্ট।

চট্টগ্রামের ভাটিয়ারী দেখতে অনেকেই ছোটেন। ফাইল ছবি
চট্টগ্রামের ভাটিয়ারী দেখতে অনেকেই ছোটেন। ফাইল ছবি

পাহাড়ের সৌন্দর্য উপভোগ করে, ভাইবোনদের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে সারা দিন আলসেমিতে পার করলাম। বিকেলের ট্রেনে রওনা হলাম ঢাকার উদ্দেশে। এরই মধ্য দিয়ে প্রমিতি আর তার বাবার দক্ষিণবঙ্গ ভ্রমণ শেষ হলো। এরপর সাতক্ষীরার প্রান্তিক উপকূলীয় এক জনপদে যেতে হবে। সেই গ্রামের গা ছুঁয়ে বয়ে চলা নদীটির ওপারেই সুন্দরবন। বাংলাদেশের মানচিত্রের একদম দক্ষিণ প্রান্তের প্রত্যন্ত এই জনপদে ঘুরে বেড়ানোর অভিজ্ঞতা ছিল অসাধারণ। সেই গল্পও পরের পর্বে।

* উপমা মাহবুব, কলামিস্ট এবং উন্নয়ন পেশাজীবী