দক্ষিণবঙ্গ: প্রকৃতি, জল আর মানুষের গল্প - পর্ব ৩

সুন্দরবনের মানুষের জীবন কাটে কষ্টে। ফাইল ছবি
সুন্দরবনের মানুষের জীবন কাটে কষ্টে। ফাইল ছবি

দক্ষিণবঙ্গের প্রকৃতি, জল আর মানুষের গল্প নিয়ে তিন পর্বের শেষটি পড়ুন আজ সোমবার।

কক্সবাজার এবং চট্টগ্রাম ভ্রমণ শেষে ঢাকায় পৌঁছানোর পরের দিন দুপুরেই অফিসের কাজে রওনা হতে হলো সাতক্ষীরার উদ্দেশে। আমাদের প্রথম গন্তব্য যশোর। সেখান থেকে পরের দিন চলে যাব সাতক্ষীরার একদম প্রান্তে সুন্দরবন ঘেঁষা মুন্সিগঞ্জ উপজেলায়। আমার সহযাত্রী আমার অফিসের যুক্তরাষ্ট্র শাখার সহকর্মী বার্ট রবার্টসন। এয়ারপোর্টে ঢোকার পরই বিপত্তি বাধল। স্কেনিং মেশিনে বার্টের ব্যাকপ্যাকে ধাতববস্তুর অস্তিত্ব ধরা পড়ল। কিন্তু আতিপাতি করেও বার্ট কোনো ধাতব জিনিস খুঁজে পেল না। বারবার স্ক্যান করা হচ্ছে, বারবারই একটা কিছুর অস্তিত্ব ধরা পড়ছে। শেষে আবিষ্কার হলো তার ব্যাগে ছোট্ট একটা তালা রাখা আছে, যেটা বার্ট কখনোই ব্যবহার করেনি। নিরাপত্তা তল্লাশি (সিকিউরিটি চেকিং) সমাপ্ত হলো কিন্তু চেক ইন করতে গিয়ে বাধল নতুন বিপত্তি। অফিস আমাদের টিকিটের ব্যবস্থা করে দিয়েছিল এবং আমাকে টিকিটের সফটকপি পাঠিয়েছিল। চেক ইন করতে গিয়ে টের পেলাম ভুল করে শুধু বার্টের টিকিট কাটা হয়েছে। অফিসের কাজের চাপে আমি বিষয়টা খেয়াল করিনি! মহাবিপদে পড়ে গেলাম। এদিকে ফ্লাইটের সময়ও হয়ে যাচ্ছে। বিমান কোম্পানির যে কর্মকর্তারা চেক ইনের কাজ করছিলেন, তাঁরা জানালেন এই ফ্লাইটে এখনো দুটো সিট খালি আছে। দৌড়ে টিকিট বিক্রির কাউন্টারে গিয়ে একটা টিকিট কিনলাম।

ঢাকা থেকে যশোর ৪৫ মিনিটের ফ্লাইট। সেখানে পৌঁছানোর পর তেমন কোনো কাজ ছিল না। বার্ট তার রুমে চলে গেল। আমি গেলাম মার্কেটে। উদ্দেশ্য বিখ্যাত যশোর স্টিচের কাজ করা পোশাক কেমন হয়, তা একটু পর্যবেক্ষণ করা। দোকানে দোকানে ঘুরে যশোর স্টিচের শাড়ি, সালোয়ার–কামিজ, বিছানার চাদর আর কুশন কভার দেখে মাথা ঘুরে গেল। এত্ত সুন্দর, একদম বুনোট কাজ। আর দামেও ঢাকার তুলনায় বেশ সস্তা। পরের দিন সাতসকালে আমরা রওনা হলাম সাতক্ষীরার মুন্সিগঞ্জ উপজেলার উদ্দেশে। সেখানে পৌঁছাতে সময় লাগল প্রায় তিন ঘণ্টা। জায়গাটা যে কেমন, তা বর্ণনা করা একটু কঠিনই বটে। প্রচুর গাছপালা, কিছুদূর পরপর দিগন্ত বিস্তৃত চিংড়িঘের। একটু পরপর ঝোড়ো বাতাস বইছে। সেখানকার বাতাস একদমই অন্য রকম। শীতল, বুনো আর শক্তিশালী। আমার প্রাণ জুড়ে যাচ্ছিল। আমরা প্রথমেই একটা অফিসে গিয়েছিলাম। সেটা গ্রামের একদম শেষ প্রান্তে। পাশেই একটা নদী, তার ওপারে সুন্দরবন দেখা যাচ্ছে। নদীর এই পারে জোয়ার-ভাটার চিহ্ন বোঝা যায়। সেখানে রয়েছে বড় বড় লোনাপানির গাছ, সেগুলোর শ্বাসমূল বের হয়ে আছে। এরপর আমরা গেছি একটি বাড়িতে, সেখানে উঠানে বসে আমরা গ্রামীণ প্রান্তিক নারীদের কাছ থেকে তাঁদের সুখ, দুঃখের গল্প শুনেছি। গল্প শুনতে শুনতে একপর্যায়ে হুট করে ঝড় শুরু হলো। তারপর প্রচণ্ড বৃষ্টি। কয়েক মুহূর্তের ঝড়ে আমাদের আশপাশে বড় বড় গাছের কয়েকটা ডাল ভেঙে পড়ল। অথচ এই গ্রামীণ নারী আর তাঁদের পরিবারের সদস্যরা নির্বিকার। এ রকম বৈরী প্রকৃতি নাকি তাঁদের জীবনের নিত্যসঙ্গী! বৃষ্টি শেষে পিচ্ছিল কাদার মধ্যে হাঁটতে আমার যে কী অবস্থা হয়েছিল, তা বলার মতো নয়। আরেকটু হলে পুকুরে গিয়ে পড়তাম।

সুন্দরবনের নদী। ফাইল ছবি
সুন্দরবনের নদী। ফাইল ছবি

এ এলাকায় চারপাশ পানিময় কিন্তু সবই লবণাক্ত। মাইলের পর মাইলজুড়ে চিংড়িঘের। মালিকেরা লবণপানি জমিয়ে রাখতে রাখতে এমন অবস্থা হয়েছে যে ভূগর্ভস্ত পানি পর্যন্ত লবণাক্ত করে ফেলেছে। ফলে জমির উর্বরতা শক্তি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। সুপেয় পানি পাওয়া দুষ্কর হয়ে উঠেছে। প্রতিদিন গ্রামের দরিদ্র নারীরা অনেকটা পথ হেঁটে পানি সংগ্রহ করেন। তাতে ব্যয় হয় কয়েক ঘণ্টা। অথচ পানি যা পাওয়া যায়, তা খুবই অপ্রতুল। আমি যে অফিসে গিয়েছিলাম, সেখানকার কলের পানি দিয়ে মুখ-হাত ধুলে নাকি চোখ জ্বলে। গোসল করলে চুল নষ্ট হয়ে যায়। অন্যদিকে ঝড় আর বন্যা এখানকার বাসিন্দাদের নিত্যসঙ্গী। জলোচ্ছ্বাসে সব ডুবে গেলে দরিদ্র মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে গিয়ে ওঠে। পানি নেমে যাওয়ার পর কোনোমতে ভাঙাঘর মেরামত করে, বাসার পাশে নতুন করে শাকসবজির গাছ লাগায়। নদীতে কাঁকড়া ধরে আর চিংড়িঘেরে কাজ করেও দরিদ্র মানুষ জীবনধারণ করে। এ ছাড়া কাজের আর তেমন কোনো সুযোগ নেই। পরবর্তী দুদিন আমরা শ্যামনগর এবং সাতক্ষীরা অঞ্চলে ঘুরেছি। সেখানেও মানুষের অনেক কষ্ট। বিশেষ করে পানির অনেক অভাব। জলবায়ু পরিবর্তন আর মানবসৃষ্ট পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণে আমাদের উপকূলীয় জনপদের মানুষ যে সীমাহীন দারিদ্র্য আর দুর্ভোগের মধ্যে জীবনযাপনে বাধ্য হচ্ছে, তা নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস হওয়ার মতো নয়। সরকারসহ অনেক সংস্থা এখানে লবণসহিষ্ণু ফসল ফলানোর, নিরাপদ পানির নতুন টেকনোলজি স্থাপনের চেষ্টা করছে। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এখানকার প্রকৃতি যেভাবে দিন দিন বৈরী হয়ে উঠছে, তার সঙ্গে পেরে ওঠা খুবই কঠিন।

তবে উপকূলের মানুষ সত্যিই সংগ্রামী। প্রতিনিয়ত প্রকৃতির সঙ্গে তারা যুদ্ধ করে চলেছে। মজার ব্যাপার হলো, মুন্সিগঞ্জ ও শ্যামনগর প্রান্তিক এলাকা হলেও এখানে নাকি প্রচুর বিদেশি আসে। উদ্দেশ্য একটাই, সুন্দরবন ভ্রমণ। কিছু হোটেল আর রিসোর্টও আছে, যেগুলো মানের দিক দিয়ে মন্দ নয়। মুন্সিগঞ্জের নদীতে বড় বোট দেখেছি। বড় টিম এলে আট ঘণ্টার জন্য এসব বোট ভাড়া করে সুন্দরবনের ভেতর থেকে ঘুরে আসে। এখানকার মধু বিখ্যাত। সুন্দরবনের ভেতর থেকে মাওয়ালিরা নিয়ে আসেন। ঐতিহ্যের দিক থেকেও এই অঞ্চল কম সমৃদ্ধ নয়। কুমোরপাড়ায় কুমোরকে মাটির পাত্র বানাতে দেখেছি। অসাধারণ দৃশ্য। যেদিন শ্যামনগরে ঘুরেছি, সেদিন একটা অসাধারণ ঘটনা ঘটল। এক জায়গা থেকে গাড়িতে করে অন্য জায়গায় যাচ্ছি, হঠাৎ দেখি বিশাল জায়গাজুড়ে একটা পোড়ো বাড়ি। সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি দাঁড় করালাম। বাড়িটার দেয়ালজুড়ে মস্ত বটগাছ। কাঠামোটা এখনো পুরোপুরি ভেঙে পড়েনি। দোতলায় কোথাও বারান্দা আবার কোথাও জানালার অংশবিশেষ দেখা যাচ্ছে। গাছপালা জন্মে জায়গাটা একদম জঙ্গল হয়ে গেলেও বাড়িটার সামনের দিকের এক-দুটি কক্ষে কারা যেন জ্বালানি রেখেছে। আমরা অনেকক্ষণ ধরে পুরো এলাকাটা ঘুরে ঘুরে দেখলাম। ইতিহাসের এত চমৎকার একটা নিদর্শন, অথচ অযত্ন-অবহেলায় পড়ে আছে। কোনো ধরনের সংরক্ষণের লক্ষণ চোখে পড়ল না। পরে ইন্টারনেট ঘেঁটে জানতে পারলাম, এই বাড়িটা নকিপুর জমিদার বাড়ি নামে পরিচিত। ১৮৮৮ সালে এই অঞ্চলের জমিদার হরিচরণ রায় চৌধুরী এই বাড়িটি তৈরি করেন। ১২ বিঘা জমির ওপর তিনতলা এল শেইপ বাড়িটিতে কক্ষের সংখ্যা ছিল ৮৫। এ ছাড়াও বাড়িসংলগ্ন পুকুর ছিল। আরও ছিল শিবমন্দির, যার ভগ্নাংশ এখনো বিদ্যমান। জমিদার হরিচরণ একজন সমাজসেবক ছিলেন। তিনি পানি সংরক্ষণাগার, রাস্তা নির্মাণ, বৃক্ষরোপণ ইত্যাদি কাজ করেছেন। স্থানীয় অনেকগুলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপনে তাঁর বিশেষ ভূমিকা ছিল। এ রকম একটা গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক স্থাপত্য অনাদরে–অবহেলায় নষ্ট হচ্ছে, এটা ভেবে মনটা বেশ খারাপ হয়ে গেল।

কক্সবাজার হয়ে দেশের দক্ষিণাঞ্চল ভ্রমণ শুরু করেছিলাম। সাতক্ষীরা অঞ্চলের সুন্দর প্রকৃতি, অবহেলায় ধ্বংসপ্রায় প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন, একঝলক সুন্দরবন দর্শন, অপূর্ব সুন্দর চিংড়িঘেরের ভয়ংকর কুফল, একদিকে সুপেয় পানির জন্য হাহাকার, অন্যদিকে জীবনসংগ্রামে জয়ী হওয়ার অসাধারণ সব গল্প—সব মিলিয়ে একসঙ্গে ভালো লাগা আর মন খারাপের মিশ্র অনুভূতি দিয়ে আমার ভ্রমণ শেষ হলো। মন বলল, ‘আমি একটুখানি দাঁড়াব এবং দাঁড়িয়ে চলে যাব; শুধু একটু থেমেই আমি আবার এগিয়ে যাব; না, আমি থেকে যেতে আসিনি; এ আমার গন্তব্য নয়; আমি এই একটুখানি দাঁড়িয়েই এখান থেকে চলে যাব।’ সৈয়দ শামসুল হক।

* উপমা মাহবুব, কলামিস্ট এবং উন্নয়ন পেশাজীবী