সৈন্যে নয়, 'পণ্যে' শাসন বিশ্বময়

ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

একসময় দেশ দখলের প্রধানতম সংস্কৃতি ছিল সেনাপতিসহ সৈন্য পাঠিয়ে ভৌগোলিকভাবে রাজ্য, রাজত্ব, আধিপত্য বাড়ানো, যা কালে কালে বদলেছে নানাভাবে। কখনো কখনো মগজ দখল করে অথবা মগজ নষ্ট করেও আধিপত্য বাড়ানোর চেষ্টা লক্ষণীয়। তবে তথাকথিত আধুনিক কৌশল বোধ করি ‘সৈন্য’ পাঠানো থেকে সরে গিয়ে ‘পণ্য’ পাঠানোর আধিপত্যে পরিমাপযোগ্য।

বিজয় বা শক্তি বাড়ানোর কাজটা শুধু নিজেদের সংখ্যা বাড়িয়ে নয়, বিপরীত দিকের সংখ্যা কমিয়েও করা সম্ভব। মাদক ব্যবসার প্রসার যেখানে সবচেয়ে সফলতার সঙ্গে মানুষকে হত্যা করে অথবা পিছিয়ে দেয়।

বিষয়টি নানাভাবেই পর্যবেক্ষণ করা যায়। তবে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া পেঁয়াজ নিয়ে আমাদের বাসার গুরুত্বপূর্ণ ব্যবস্থাপক, যাঁকে প্রচলিত ভাষায় ‘গৃহকর্মী’ বলে জানি, তাঁর বোধ ও বিশ্লেষণে আমাকে অনেক বেশি ভাবতে শিখিয়েছে:

ঘটনা ৩: আমার বাসার ‘গৃহকর্মী’ বিদ্রোহ করলেন, শীতের সকালে নতুন পেঁয়াজের আগমনে, কেন আমি কঠিন করলাম তাঁর জীবন। প্রিয়তমা স্ত্রী বোঝালেন, কাজের ক্ষতি করে এত সময় নিয়ে এতগুলো পেঁয়াজ ছিলে-কেটে রান্নার বদলে নতুন আগন্তুক ‘বোমা পেঁয়াজ’ একটাই যথেষ্ট সারা বেলার রান্নার প্রয়োজন মেটাতে। ‘আমরা কয়েকজন একসঙ্গে আলাপ কইরা দেখছি, চায়না (পেঁয়াজ) আমাগো চোখে কান্দন দেখতে চায় না ভাইয়া,’ হেসে বললেন গৃহকর্মী শান্তা। আমি একটু চোখ তুলে তাকাতেই তিনি হেসে বললেন, ‘আমারে তাড়াইতে পারলেও এ দেশ থেইকা এই বোমা পিঁয়াজ কোনো দিন তাড়াইতে পারবেন না ভাইজান।’ বললাম, কেন? তিনি বললেন, ‘একবার বিদেশি জিনিস আসা শুরু করলে কবে হেইডা থামছে গো।’ বুঝলাম, বিজ্ঞ ‘গৃহকর্মী’ শ্রমের রাজনৈতিক অর্থনীতিটা বুঝেছেন এবং বোঝাতে পেরেছেন। আর আমরা?

ঘটনা ২: পেঁয়াজের হাহাকারে প্রিয় স্বদেশ, বিধ্বস্ত মাতৃভূমি। যেন যা-ই পায়, গিলে খেতে চায় পেঁয়াজের তৃষ্ণা মেটাতে। কত কবিতা, প্রশংসা, অলংকরণ, সম্ভাষণ, হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসা আর নস্টালজিয়া, যা কিনা এ ভূখণ্ডের সব প্রেমের উপাখ্যান, অর্জিত জ্ঞান—সবকিছুকে ছাপিয়ে দেশের মুদ্রাব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনে হুমকি হিসেবেও দেখা দেয়।

ঘটনা ১: দেশ তো আর সৈনিক দিয়ে শাসন করা যায় না। দেশ শাসনের অস্ত্র হয়ে উঠেছে ‘পণ্য’। মানুষ ও মানুষের দেশ নিয়ন্ত্রণের সহজতম উপায় সব সময়ই সংখ্যায় মাত্র দুটি—মগজ অথবা পেট। মগজ নিয়ন্ত্রণে ‘মেধা পাচার’ অথবা ‘নেশাদ্রব্য’ ফর্মুলা ব্যবহার করা হয়। নানা ধরনের মেধাবৃত্তি অথবা গবেষণার নামে সম্ভাবনাময় মানুষগুলোকে শিকড়হীন করে মেধা পাচারে উৎসাহিত করা হয়। অন্যদিকে, নেশাদ্রব্য ধরিয়ে দিয়ে নানা কৌশলে মানুষকে অকর্মণ্য মাংসপিণ্ডে পরিণত করা হয়। আর ক্ষুধা মেটানো বা রসনা বিলাসের জন্য খাদ্যের পাশাপাশি অখাদ্যে-কুখাদ্যে অভ্যস্ত করে দেওয়া হয়। পেটের জ্বালা মেটাতে মানুষের বেপরোয়া হওয়ার ইতিহাস সর্বকালের। যখন এই দুই ফর্মুলা একই সঙ্গে ঘটে, তখন শাসনের কাজটা পানির মতো সহজ হয়ে যায়। ...পেঁয়াজের রাজনৈতিক অর্থনীতি আমাদের ‘গৃহকর্মী’ বুঝলেও, বুঝলাম না আমরা!

ঘটনা ০: এ জীবন কি শুধুই মনোপলি-মনোপলি খেলা?

লেখক: ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির জেনারেল এডুকেশন ডেভেলপমেন্টের বিভাগীয় প্রধান ও স্টুডেন্ট অ্যাফেয়ার্সের ডিরেক্টর