নাফাখুম - বাংলার নায়াগ্রা ফলস

নাফাখুম যেতে পাথুরে পথ পাড়ি দিতে হয়। ছবি: লেখক
নাফাখুম যেতে পাথুরে পথ পাড়ি দিতে হয়। ছবি: লেখক

মানুষ জন্মগতভাবেই অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয়। জয় করার নেশা মানুষের চিরন্তন। এই চিরন্তন নেশায় এবার আমরা ছুটি নাফাখুমে।

প্রতিবারের মতো এবারও হাতে সময় খুবই কম। এক মুহূর্তও নষ্ট করা যাবে না। এক বৃহস্পতিবার রাতে ঢাকা থেকে বান্দরবানের বাসে রওনা। পরদিন শুক্রবার সকাল আটটায় বান্দরবান শহরে। নাশতাসহ প্রয়োজনীয় কাজ সেরে লোকাল বাসে অনেক পাহাড় পেরিয়ে বেলা দুইটায় থানচি পৌঁছাই।

থানচি বান্দরবানের একটি উপজেলা। বান্দরবান থেকে ৮৫ কিলোমিটার দূরে। পাহাড়বেষ্টিত নদীর কলকাকলিতে মুখরিত ছোট্ট একটি শহর। চারপাশে পাহাড়। পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে খরস্রোতা সাঙ্গু নদ। নদের সৌন্দর্য মুগ্ধ করবেই। বর্ষায় নদ পুরোপুরি যৌবনে ভরপুর। একপাশে পাহাড়, একপাশে থানচি শহর, মাঝখানে বয়ে চলেছে নদ। দুপুরে পর্যটন মোটেলে খাওয়া সেরে যাই সেনাবাহিনীর ক্যাম্পে।

এবারে দলে আমরা ১০ জন। সবার জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি ও এক কপি ছবি ক্যাম্পে জমা দিয়ে নির্ধারিত ফরম পূরণ করে নাফাখুম যাওয়ার অনুমতি নিই। স্থানীয় পর্যটন মোটেল থেকে দুজন গাইড ঠিক করে দেন সেনাবাহিনীর এক কর্মকর্তা। গাইড ছাড়া যাওয়া যাবে না। এরপর সবকিছু ঠিক করেন গাইড। এখন আমাদের গন্তব্য রেমাক্রি। নদীপথে যেতে লাগে চার ঘণ্টা। এক নৌকায় পাঁচজনের বেশি যাওয়া যাবে না। আমাদের দুটি নৌকা নিতে হলো। পুরো বিষয়টা সেনাবাহিনী তদারকি করে। শুরু হলো নৌকাভ্রমণ। ইঞ্জিনচালিত লম্বা আকৃতির চিকন নৌকা। খুবই দ্রুত চলে। বর্ষা মৌসুম হওয়ায় সবাই বড় বড় পলিথিন কিনে নিলাম বৃষ্টি থেকে বাঁচতে। সবার ব্যাগ একটা পলিথিনে ঢেকে ফেললাম। নৌকায় বসতেই শুরু হলো ঝুম বৃষ্টি। বৃষ্টি থামার অপেক্ষায় না থেকে সময় নষ্ট না করে পলিথিন গায়ে দিয়ে যাত্রা শুরু হলো। চারটে নাগাদ চলতে শুরু করল নৌকা।

সরু নৌকায় রেমাক্রি যেতে প্রায় ৪ ঘণ্টা লাগে। ছবি: লেখক
সরু নৌকায় রেমাক্রি যেতে প্রায় ৪ ঘণ্টা লাগে। ছবি: লেখক

বৃষ্টিতে পাহাড়ের সৌন্দর্য অন্য রকম। নৌকা চলছে। পাহাড়ি বুনো বৃষ্টিতে পলিথিন আমাদের রক্ষা করতে পারল না। সবাই ভিজে গেছি। শরীর ভিজছে কিন্তু কেন জানি আমাদের ভালোই লাগল। কিছুক্ষণ পর বৃষ্টি অবশ্য থেমে গেল। পাহাড়ে আবহাওয়া দ্রুত বদলায়। দুই পাশে সুউচ্চ পাহাড়, মাঝখান দিয়ে বয়ে চলেছে নদী। কোথাও কোথাও দুই পাহাড়ের মাঝখানে সরু নদী। কোনোভাবে নৌকা যেতে পারবে। তখন বুঝলাম নৌকাগুলো কেন চিকন। কোথাও দুই পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে সূর্য উঁকি দিচ্ছে। কোথাও এত স্রোত যে নৌকা দিকভ্রষ্ট হওয়ার উপক্রম। দুই ঘণ্টা যাওয়ার পর শুরু হলো পাথুরে নদী। নদীর মাঝখানে বিশাল বিশাল পাথর। নদীর স্রোত পাথরের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে এক ভয়ংকর আবহ তৈরি করেছে। সঙ্গে স্রোতের গর্জন। এ এক ভয়ংকর পথ! কোথাও পাহাড়ের ঢালের কারণে নদী উঁচু থেকে কয়েক ফুট নিচে আছড়ে পড়ছে। আমাদের নৌকা যখন আছড়ে পড়ল, তখন আমরা ভয়ে আড়ষ্ট। কারও মুখে কোনো কথা নেই। সবার চোখ সবার চোখের দিকে। গাইড সাহস দিলেন। নৌকা চলছে। কোথাও নদীতে পড়ে থাকা পাথরের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে নৌকা উল্টে যাওয়ার উপক্রম। তবে ততক্ষণে আমরা বেশ সাহস সঞ্চয় করে ফেলেছি। নির্জন এলাকা দিয়ে নৌকা চলছে। কেউ নেই। গাইড বললেন, বিকেলে এই পথে কেউ আসে না। শুধু আমাদের দুই নৌকা। পাথরগুলো খুবই পিচ্ছিল। পানিতে থাকতে থাকতে শেওলা জমে গেছে। বড় পাথরগুলোর পাশ কাটিয়ে আঁকাবাঁকা করে নৌকা চলছে। হঠাৎ সামনে নদী তিন থেকে চার ফুট নিচে নেমে গেছে। মানে ছোট জলপ্রপাত। গাইড শুধু বললেন, সবাই নৌকা শক্ত করে ধরেন। এরপরই নৌকাটি তিন থেকে চার ফুট আছড়ে নিচে পড়ল। অনেকটা রাফটিংয়ের মতো। নৌকা ডুবতে ডুবতে আবার চলতে শুরু করল। বনে আর পাহাড়ে দ্রুত সন্ধ্যা নামে।

পাহাড়ে পথ চলতে ও নদী পেরোতে লাঠি অবশ্যই থাকা চাই। ছবি: লেখক
পাহাড়ে পথ চলতে ও নদী পেরোতে লাঠি অবশ্যই থাকা চাই। ছবি: লেখক

মুহূর্তের মধ্য অন্ধকার হয়ে গেল। ভীষণ অন্ধকার। ভয়ে আমরা আড়ষ্ট। মাঝি বড় টর্চলাইট জালিয়ে আমাদের কিছুটা আশ্বস্ত করলেন। অন্ধকারে পাথরের সঙ্গে ধাক্কা লেগে নৌকার প্রপেলার ভেঙে গেল। মাঝি নৌকা থামালেন। নিঝুম অন্ধকারে আমরা পাথুরে খরস্রোতা নদীতে। নৌকার ভেতর থেকে নতুন প্রপেলার বের করে লাগিয়ে আবার চলতে শুরু করল। অবশেষে রাত আটটা নাগাদ পৌঁছালাম রেমাক্রি বাজারে। টিলার ওপর ছোট্ট একটা বাজার। বিদ্যুৎ নেই। ঘুটঘুটে অন্ধকার। তবে নিঝুম। বাজারের কিছু দোকান খোলা তখনো। কেরোসিনের আলোয় আলোকিত। আমরা ভীষণ ক্লান্ত। আমাদের থাকার জায়গা হলো বাঁশ দিয়ে ঘেরা টিনশেড একটা কাঠের দোতলায়। এক কক্ষে সবাই ফ্লোরিং। এখানে এ রকম হোটেল মাত্র দুটি। হোটেলে রাত ১০টা পর্যন্ত জেনারেটর চলে। অনেকে এই জেনারেটরের বিদ্যুতে চার্জার লাইট চার্জ দেয়। বাথরুম থাকার জায়গা থেকে কিছুটা দূরে। নদীর পানি দিয়ে গোসল সেরে ডিমভাজি আর খিচুড়ি খেয়ে বের হলাম বাজারে। সব দোকানি উপজাতি নারী। কোনো পুরুষ চোখে পড়ল না। সব মিলিয়ে বাজারে ১৪ থেকে ১৫টি দোকান। গাইড তাগাদা দিচ্ছিলেন, কাল সকাল ছয়টা থেকে হাঁটতে হবে। তাই সবাই দ্রুত বিছানায় গেলাম। ক্লান্ত শরীরে কখন ঘুমিয়ে গেছি বুঝতেই পারিনি।

পরদিন ভোরে গাইডের ডাকে ঘুম থেকে উঠে প্রয়োজনীয় কাজ সেরে আবারও ডিমভাজি–খিচুড়ি খেয়ে শুরু হলো ট্রেকিং। আমাদের গন্তব্য নাফাখুমের দিকে। সবার হাতে বাঁশের লাঠি। লাঠিতে ভর দিয়ে হাঁটতে সুবিধা হয়।

সারিবদ্ধভাবে আমরা হাঁটছি। রেমাক্রি পার হতেই কাজুবাদামের অনেক বাগান চোখে পড়ল। পাহাড়ের গায়ে বেশ বড় বাগান। আমরা হাঁটছি এক পাহাড় থেকে আরেক পাহাড়ে। তবে এই পথে কিছুটা লোকালয় আছে। মাঝেমধ্যে দু–একটা দোকানও আছে। পেঁপে, কলা ও বিস্কুট পাওয়া যায়। মাঝেমধ্যে ছোট ছোট জলপ্রপাত ক্লান্তি দূর করে দেয়।

কখনো হেঁটে নদী পার হতে হচ্ছে। খরস্রোতা নদী। কোমরসমান পানিতে নদী পার হচ্ছি। নদী খরস্রোতা হওয়ায় জোঁকের আশঙ্কা কম। আবার পাহাড়ে উঠছি, নামছি, কখনো উঁচু পাহাড়ের কোল ঘেঁষে হাঁটছি। নিচে তাকালে পিলে চমকে যায়। হাঁটছি, হঠাৎ পানির শব্দ। গাইড বললেন, এটা নাফাখুমের শব্দ। আস্তে আস্তে শব্দ জোরে হতে লাগল। আমাদের কৌতূহল বেড়েই চলেছে। এমনিতে পাহাড়ে হাঁটা খুবই কষ্টকর। কষ্ট, ক্লান্তি, কৌতূহল—সব মিলিয়ে আমরা জয়ের নেশায় এগিয়ে চলেছি।

চারপাশে পাহাড় আর মাঝখানে নদী। ছবি: লেখক
চারপাশে পাহাড় আর মাঝখানে নদী। ছবি: লেখক

এভাবে হাঁটতে হাঁটতে তিন ঘণ্টা পরে আমরা পৌঁছালাম নাফাখুম, বাংলার নায়াগ্রা ফলস। তখন সকাল ১০টা। এ এক অভাবনীয় আনন্দ। সবাই চিৎকার করতে থাকল ‘ইয়েস’। একভাবে অপলক তাকিয়ে থাকলাম। এ এক অন্য রকম সৌন্দর্য। পাথরের পাহাড়, পানি অনেক নিচে পড়ে নদী হয়ে গেছে। ভীষণ শব্দ। বেশ কিছু পর্যটক এখানে তাঁবু টাঙিয়ে রাতের নৈসর্গিক সৌন্দর্য উপভোগ করেছেন। জলপ্রপাতের উচ্চতা বেশি না হলেও সৌন্দর্যের কমতি নেই। উচ্চতা কম থাকায় নিচে নামলাম। তবে গভীরতা আছে। ভীষণ স্রোত। জলপ্রপাতের জলে গা ভিজিয়ে মনে হলো এ এক নৈসর্গিক অনুভূতি। কারও মুখে কোনো কথা নেই। শুধু পানির শব্দ। সবাই আসলে উপভোগ করছেন।

চারপাশে আকাশচুম্বী পাহাড়। কিছু সময় কাটালাম, ছবি তো তুলতেই হবে। আগের রাতে বৃষ্টি হওয়ায় জলপ্রপাত বেশ জীবন্ত ছিল। সময় কম, এবার যাওয়ার পালা। আবার শুরু হলো হাঁটা। একই পথে হেঁটে বেলা দুইটা নাগাদ রেমাক্রি পৌঁছে গেলাম। খাওয়া সেরে নৌকায় চেপে বসলাম। সেই পাথুরে নদী পেরিয়ে সন্ধ্যার কিছু আগে থানচি পৌঁছালাম। নৌকাভাড়া ১০ জনের ১০ হাজার টাকা (দুই নৌকা) আর রেমাক্রি রাতের জনপ্রতি থাকা ১০০ ও খাওয়া ১০০ টাকা। সেনাবাহিনীর ক্যাম্পে ফিরতি রিপোর্ট করে চান্দের গাড়ি ভাড়া করে চলে (জনপ্রতি ২০০ টাকা) এলাম বান্দরবান। ওই রাতেই বাসে বান্দরবান থেকে যশোর। সব মিলিয়ে থাকা–খাওয়াসহ ১০ জনের জনপ্রতি ৪ হাজার ৫০০ টাকা করে খরচ।

গন্তব্য যতটা সৌন্দর্যময়, এর যাওয়ার পথটি অনেক বেশি বিচিত্র ও আকর্ষণীয়। কী নেই পথে! গহিন পাহাড় আর বন, রেমাক্রি খালের পাথুরে বন্যতা সবুজ সুতার মতো শেওলা নিয়ে বয়ে চলা, বুনো পাখির কুজন। এবারে ভাবতে বাধ্য হবেন, জীবনকে আজ কিছু দিলাম! এ এক অদ্ভুত পূর্ণতা!

মারুফ হোসেন: পেশাজীবী ও পর্যটক