বাঁশের মাথায় স্মৃতিময় অ্যানটেনা

বাঁশের মাথায় অ্যানটেনা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে চ্যানেল ধরানো এখন স্মৃতি। ছবি: সংগৃহীত
বাঁশের মাথায় অ্যানটেনা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে চ্যানেল ধরানো এখন স্মৃতি। ছবি: সংগৃহীত

এক. 

বিটিভির জন্মদিন (২৫ ডিসেম্বর) গেল। স্মৃতিপটে এই রাষ্ট্রীয় চ্যানেলটি আমাদের জীবনের সঙ্গে কতই–না প্রাসঙ্গিক ছিল সেই এক সময়, আমাদের শৈশবে। বাংলাদেশে একমাত্র টেলিভিশন চ্যানেল ছিল রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি)।

বিটিভি চ্যানেলই আমাদের প্রাণ। লম্বা বাঁশের মাথায় অ্যানটেনা লাগিয়ে কালো রঙের পাতলা কেবল টেনে টিভির পেছনে থাকা অ্যানটেনা ছকেটে কেবল প্লাগ লাগিয়ে দিলেই হতো। টিভির ইলেকট্রিক প্লাগে বৈদ্যুতিক সংযোগ দিলেই ঢাকা বিটিভি ভবন থেকে প্রচারিত অনুষ্ঠান অ্যানটেনার সাহায্য একেবারে আমাদের টেলিভিশন সেটে হাজির।

সেটা আশির দশকের কথা। আশির দশকে আমাদের গ্রামে বিদ্যুৎ আসে। আশির দশকেই আমাদের বাড়িতে (মজিদ কুটিরে) টিভি আসে। সে এক অন্য রকম অভিজ্ঞতা আমাদের শৈশবের। কুমিল্লা অঞ্চলের উত্তর–পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত বলে আমাদের গ্রাম থেকে উত্তর–পশ্চিম কোনার দিকে অ্যানটেনা তাক করাতে হতো। বাঁশটার নিচে ধরে ঘুরিয়ে টিভির ছবি পরিষ্কার করার জন্য অ্যানটেনার দিকনির্দেশন করা। পূর্ব–উত্তর কোনার দিকে দিলে ভারতীয় রাষ্ট্রীয় চ্যানেল দূরদর্শনও আমরা দেখতে পারতাম একেবারে পরিষ্কার। আগরতলা রিলে সেন্টার কাছে হওয়ায় দিল্লির অনুষ্ঠান আমাদের টিভিতে বেশি পরিষ্কার। বাঁশটার নিচের মাটির অংশ ফাঁকা রাখা হতো অ্যানটেনা ঘোরানোর সুবিধার্থে। উঁচু বাঁশের মাথায় অ্যানটেনা দেখেই অনুমান করা যেত কার বাড়িতে টেলিভিশন আছে। গ্রামজুড়ে হাতে গোনা কয়েকটি টিভিই ছিল মাত্র। এই গোটা কয়েক টিভিই ভরপুর থাকত দর্শকে।

প্রতিবেশী এপাড়া–ওপাড়ার লোকজন দল বেঁধে টিভি দেখতে আসতেন। ঘরে কি আর এত মানুষ জায়গা দেওয়া যায়। টিভি আছে—এমন বাড়ির দরজায় টিভি বসিয়ে উঠোনের দিকে দিলেই হতো...উঠোনে বসে টিভি দেখার স্মৃতি কি ভোলা যায়। আমাদের (বুড়িচং) থানা সদর বাজারে একটি লাইব্রেরির সামনে রাস্তার দিকে মুখ করে টিভি বসিয়ে দিত লাইব্রেরির মালিক ভদ্রলোক (ফিলিপস ব্র্যান্ডের ২০ ইঞ্চি সাদাকালো টিভি)। বাড়িতে যখন বিদ্যুৎ আসেনি, টিভিও আসেনি। পথে বসে সেই টিভি দেখা। থানা পরিষদের টিটিসি হলে টিভি দেখা। আমাদের থানা সদরের অডিটোরিয়ামে বসে টিভি দেখা (ফিলিপস ২০ ইঞ্চি সাদাকালো)। আমাদের গ্রামের দক্ষিণপাড়ার এক বাসিন্দার শখের টিভি (ন্যাশনাল ২১ ইঞ্চি সাদাকালো) ব্যাটারিতে চলত। সেই উঠোনে বসে টিভি দেখা। মামার বাড়িতে বেড়াতে গেলে বাজারের একটি দোকানের মেঝেতে বসে টিভি দেখতাম। তারপর নিজের বাড়িতে বিদ্যুৎ এলে লোজজন নিয়ে টিভি দেখার স্মৃতি এখনো স্মৃতিপটে অম্লান। জীবনের প্রথম টেলিভিশন দেখার অনুভূতি এখনো সুখ ছুঁয়ে যায়, সেই নয়–দশ বছর বয়সে। আমাদের গ্রামের পূর্বপাড়ায় বিয়ের অনুষ্ঠানে ভাড়ায় চালিত টিভি আনা হয়েছিল। বিদ্যুৎ তো ছিল না, চালিয়েছিল ব্যাটারিতে। সেই উঁচু বাঁশের মাথায় অ্যানটেনার সঙ্গে পরিচয়। স্মৃতির ছায়া ফেলে অ্যানটেনা আমার জীবনের প্রতিটি অনুভূতিতে।

সেই বাঁশের মাথায় অ্যানটেনা। অসাধারণ এক সৌন্দর্য আকাশের পানে উঁচিয়ে আছে। সেই এক অ্যানটেনার স্মৃতি ভোলা যায় না কিছুতেই। এখন কেবল টিভির যুগ, ইন্টারনেট টিভির যুগ। সেই একটি চ্যানেল বিটিভিই তার অনুষ্ঠানের মান দিয়ে দর্শক ধরে রাখত চুম্বকের মতো। দর্শক টানত চুম্বকের মতো। বাংলাদেশ টেলিভিশনের খবর, নাটক, বিভিন্ন বিনোদনমূলক ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান, কৃষিভিত্তিক অনুষ্ঠান, বিদেশি অনুষ্ঠানের বাংলা অনুবাদ (ডাবিং) প্রোগ্রাম, সংগীত অনুষ্ঠান, নাচের অনুষ্ঠান, স্টেজ শো, জাদু প্রদর্শন, থিয়েটার প্রোগ্রাম, কবিতা ও কবিদের নিয়ে অনুষ্ঠান, সামাজিক জনসচেতনতা ও উন্নয়নমূলক অনুষ্ঠান ছাড়াও ছিল বাংলা পুরোনো চলচ্চিত্র প্রদর্শন। ছিল পাপেট শোর মতো ও অন্যান্য শিশুতোষ অনুষ্ঠান, খেলাধুলার অনুষ্ঠান।

আশি থেকে নব্বইয়ের দশকের শুরুটা বিটিভির ধারাবাহিক নাটক ছিল দর্শকের অস্থিমজ্জায়। মমতাজউদদীন আহমদ, আবদুল্লাহ আল–মামুন, মামুনুর রশীদ ও হ‌ুমায়ূন আহমেদের সৃষ্টিশীল সময় ছিল সেটা। হ‌ুমায়ূন আহমেদের ‘অয়োময়’ নাটকে পাখির মুখে ‘তুই রাজাকার, তুই রাজাকার’ শব্দ ছড়িয়ে দেওয়ার কৌশল কোনো দিন কেউ ভুলবে না। সময়টা ছিল তখন রাজাকারের অনুকূলে। এ দুঃসাহস হ‌ুমায়ূন আহমেদের পক্ষেই সম্ভব ছিল। ‘কোথাও কেউ নেই’ নাটকের চরিত্র বাকের ভাই আসাদুজ্জামান নুরের ফাঁসি নিয়ে সারা দেশে আন্দোলন; সেটাও হ‌ুমায়ূন আহমেদের কারিশমা। বিটিভির ‘বহুব্রীহি’ ধারাবাহিক নাটকে প্রয়াত হুমায়ুন ফরিদীর অনবদ্য অভিনয় ভোলার নয়। ফেরদৌসী মজুমদারের হুরমতি চরিত্র ও হুমায়ুন ফরিদীর রমজান চরিত্রে অভিনয়, কী অসাধারণ। হুরমতি রমজানের কান কেটে দেয়। কানকাটা রমজান চরিত্রে হুমায়ুন ফরিদী অনন্য। ফতেহ লোহানী, আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান, জুয়েল আইচের জাদু, আনিসুল হক, হানিফ সংকেতের ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান, বিশ্বনাটক নিয়ে হাজির থিয়েটারপাগল প্রয়াত সৈয়দ মহিদুল ইসলামের স্মৃতি মনে পড়ে। আরও কত অনুষ্ঠান। মোস্তফা মনোয়ারের সেই পাপেট শো ভোলার জিনিস নয়। সেই বাঁশের মাথায় লাগানো অ্যানটেনা নিয়েই দর্শকের মন জয় করেছিল বাংলাদেশ টেলিভিশন ও দূরদর্শন। এখন এত চ্যানেল দর্শক ধরতে পারছে না। দর্শক স্থির হচ্ছে না একটি চ্যানেলেও।

বাঁশের মাথায় এখন আর অ্যানটেনার দেখা মেলে না। ছবি: সংগৃহীত
বাঁশের মাথায় এখন আর অ্যানটেনার দেখা মেলে না। ছবি: সংগৃহীত

দুই.
আশির দশকের কথা। ভারতীয় রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন চ্যানেল দূরদর্শনের মাধ্যমে ভারতীয় সংস্কৃতি দেখে দেখে আমরা বেড়ে উঠেছি। হিন্দি সংস্কৃতি শুধুই বিনোদন, গা ভাসিয়ে দিইনি। লম্বা বাঁশের মাথায় অ্যানটেনা লাগিয়ে টিভি দেখার স্মৃতি ভুলতে পারি না। কুমিল্লা অঞ্চলে আমার জন্মগ্রাম শিবরামপুর, পৈতৃক নিবাস। ভারতের ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলায় অবস্থিত দূরদর্শনের রিলে সেন্টার থাকায় দিল্লির অনুষ্ঠান স্পষ্ট দেখতে পেতাম আমরা। আমাদের চোখেমুখে এখনো দূরদর্শন স্মৃতি। হিন্দি ভাষার তারকা–মহাতারকাদের চিনতে পারার ও টুকটাক হিন্দি ভাষা বলতে পারার, এমনকি হিন্দি নাটক–সিনেমা দেখে বুঝতে পারার শিক্ষাগুরু কিন্তু আমাদের কাছে দূরদর্শনই।

ভারতীয় সব রাজ্যের সংস্কৃতির সঙ্গে আমাদের পরিচয়টাও ঘটিয়েছে দূরদর্শন। কতটা শক্তিশালী ছিল সে সময় আমাদের কাছে ভারতের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমটি। প্রতি রোববারে দুপরে প্রাদেশিক ভাষার সিনেমা প্রচার হতো দূরদর্শনে। ভারতীয় সব ভাষার শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রগুলো দেখাত দূরদর্শন। ভারতীয় সংস্কৃতি বহু মত, বহু রীতি, বহু ধর্ম, বহু চিন্তাচেতনার মিশেল ধরা পড়ত দূরদর্শনের পর্দায়। আমরা তা দারুণ উপভোগ করতাম। ভারতীয় সংস্কৃতি আমাদের চিন্তার জগৎকে সম্প্রসারিত ও সমৃদ্ধ করেছে নিঃসন্দেহে বলা চলে। হিন্দি ভাষার ভারতীয় জাতীয় অনুষ্ঠানের সঙ্গে বাংলাদেশের অজপাড়াগাঁয়ের দর্শকদের কত সহজে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল দূরদর্শন। কী অসাধারণ সেসব অনুষ্ঠান ছিল দূরদর্শনের। রোববারের সকালে ‘রাংগুলি’ (হিন্দি চলচ্চিত্রের গানের অনুষ্ঠান) শুনে ও দেখে আমাদের বয়স বেড়েছে।

রাত জেগে পুরোনো হিন্দি সিনেমা দেখা। কত কত পুরোনো–আধা পুরোনো হিন্দি বাংলা ও অন্য ভাষার চলচ্চিত্র যে দেখেছি দূরদর্শনে। হিন্দি সিনেমার নিয়মিত প্রচার রোববারে (পরে শুক্রবার ও শনিবার) সন্ধ্যায় ও রাতে। ভারতের বেশ কয়েকটা প্রধান ভাষায় ভারতের মহা গুণীদের সৃষ্টি সেই ‘সংগীত মিলে সুর মেরা তুমহারা তো সুর বানে হামারা’ কী অসাধারণ উচ্চাঙ্গ তান! কত ধরনের নৃত্য, রাগপ্রধান সংগীত, সকালের অনুষ্ঠানে মন ছুঁয়ে যাওয়া গান, প্রকৃতি ও উদ্ভিদের ওপর অনুষ্ঠান ‘পের পোদে’ তাও প্রভাতে কী সুন্দর সময় ছিল সেটা। সব তো মনে করা কঠিন। ‘জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া’ একটা শিক্ষামূলক অনুষ্ঠানও ছিল সম্ভবত রোববারে সকালের দিকে। বলিউড বাদশা শাহরুখের অনবদ্য অভিনয় সে সময় দূরদর্শন নাটকে দেখেছি, বুঝতে পারছিলাম সে অনেক দূর যাবে। তা–ই হয়েছে। অসাধারণ জনপ্রিয় অনুষ্ঠান সকালে প্রচারিত হতো সম্ভবত রোববারেই—রামায়ণ, মহাভারত। ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যের এই অনুষ্ঠানগুলো খুবই সুন্দর ও মনে রাখার মতো ছিল। মহাভারতের এ নাট্যরূপ দর্শকদের আকর্ষিত করেছে দারুণভাবে। আরও কত–কী, কোনটা ফেলে কোনটা বলি। পুরো ছোটবেলাটাই জড়িয়ে আছে দূরদর্শনের আলোতে। একটা সাদামাটা সহজ–সরল গ্রামে বসে এমন বিনোদন উপভোগ করা, ছোটবেলার জানার পরিধিকে বিকশিত করা এক স্বপ্নসুন্দরের নাম দূরদর্শন। আমাদের মনোজগতে সে আজও সাঁতরে বেড়ায় স্মৃতিতাড়িত হয়ে।

চোখ বুজলেই স্পষ্ট দেখতে পাই বাঁশের মাথায় অ্যানটেনা লাগানো আমার সেই গ্রামের বাড়ি আর ১৭ ইঞ্চি সাদাকালো নিক্কন ব্র্যান্ডের টিভিটা। এখন শুধুই স্মৃতি।

*মির্জা আবু হেনা কায়সার টিপু: অভিনয়শিল্পী, কবি ও লেখক
[email protected]