গোপালগঞ্জ ও মাদারীপুরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হত্যাযঞ্জ

সারা দেশের কিছু বধ্যভূমি সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ছবি: সংগৃহীত
সারা দেশের কিছু বধ্যভূমি সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ছবি: সংগৃহীত
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্যরাতে নিরস্ত্র বাঙালির ওপর ‘অপারেশন সার্চলাইট’-এর নামে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী হত্যাকাণ্ড চালায়। এ ধরনের হত্যাকাণ্ড বিশ্বে নজিরবিহীন। এখনো আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশের গণহত্যার স্বীকৃতি মেলেনি। বিশ্বের অন্যতম ভয়াবহ গণহত্যার শিকার হয় ৩০ লাখ মানুষ। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তাদের এদেশীয় দোসর শান্তি কমিটি, রাজাকার, আলবদর ও আলশামস বাহিনীর সহযোগিতায় এ হত্যাকাণ্ড চালায়। বধ্যভূমিতে অসংখ্য মাথার খুলি, হাড়গোড় ও চুল পাওয়া গেছে। ৬৪ জেলার গণহত্যা, বধ্যভূমি ও গণকবরের সংক্ষিপ্ত বিবরণ ধারাবাহিকভাবে থাকবে প্রথম আলোর নাগরিক সংবাদে। আজ থাকছে গোপালগঞ্জ ও মাদারীপুরের গণহত্যা, বধ্যভূমি ও গণকবরের সংক্ষিপ্ত বিবরণ।

গোপালগঞ্জ
কলাবাড়ি বধ্যভূমি
গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় কলাবাড়ি এলাকায় ১৯৭১ সালের ১২ অক্টোবর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী গানবোট নিয়ে নির্মমভাবে হামলা চালায়। ওই এলাকার প্রায় ২০০ নিরীহ গ্রামবাসীকে হত্যা করা হয়। পুরো কলাবাড়ি গ্রামটি হয়ে ওঠে বধ্যভূমিতে।

ডেভেলপমেন্ট সেন্টার অফিস বধ্যভূমি
গোপালগঞ্জের ডেভেলপমেন্ট সেন্টার অফিসে ১৯৭১ সালের ১৬ মার্চ পাকিস্তান বাহিনী একটি শক্তিশালী ঘাঁটি স্থাপন করে। এ ঘাঁটির অন্যতম নায়ক ক্যাপ্টেন ফয়েজ মোহাম্মদ ও নায়ক ক্যাপ্টেন সেলিম। এলাকায় ওই ঘাঁটিকে কসাইখানা হিসেবে মানুষজন মনে করতেন। এখানে পাকিস্তান সেনাবাহিনী সাধারণ মানুষজনকে ধরে নিয়ে এনে নির্মমভাবে জবাই করে হত্যা করত। তাঁদের মধ্যে ছিলেন মাহবুবুর রহমান চৌধুরী ও গোলজার চৌধুরী। যুদ্ধ শেষে এখানে বহু মানুষের মাথার খুলি, হাড়, কঙ্কাল ছড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। আরও দেখতে পাওয়া যায় অনেক নারীকে নির্যাতনের চিহ্ন। এ টর্চার সেলে ৪৫ জনের নাম জানা গেছে। তবে শহীদদের সঠিক সংখ্যা নিরুপণ করা সম্ভব হয়নি।

জয়বাংলা পুকুর বধ্যভূমি
গোপালগঞ্জের জয়বাংলা পুকুর ছিল মুক্তিযুদ্ধের সময় অন্যতম একটি বধ্যভূমি। এখানে পাকিস্তান সেনাবাহিনী বিভিন্ন জায়গা থেকে মানুষ ধরে নিয়ে এসে হত্যা করে। এখানে ৩৬ জন শহীদের নামের তালিকা লিপিবদ্ধ করা আছে। এখান থেকে প্রতিদিন পাকিস্তানি বাহিনী জেলার এক একটি এলাকায় হামলা চালিয়ে ধ্বংসযজ্ঞ, হত্যাকাণ্ড, লুটপাট ও নারী নির্যাতন চালাত। বর্বর নির্যাতনের পর হত্যা করে জয়বাংলা পুকুরপাড়, মধুমতী নদী ও ইটভাটার ক্লিমে মাটিচাপা দিয়ে রাখা হতো। ফলে এটি বধ্যভূমিতে পরিণত হয়।

সারা দেশের কিছু বধ্যভূমি সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ছবি: সংগৃহীত
সারা দেশের কিছু বধ্যভূমি সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ছবি: সংগৃহীত

মাদারীপুর
১৯৭১ সালের ২২ এপ্রিল হানাদার বাহিনী বিমান হামলা চালায় মাদারীপুরে। অনেকটা বিপদমুক্ত ও নিরাপদ মনে করার পর ২৪ এপ্রিল মাদারীপুরে প্রবেশ করে হানাদার বাহিনী। এরপর মাদারীপুরের বিভিন্ন স্থানে শুরু হয় একের পর এক ধ্বংসযজ্ঞ, নারী নির্যাতন।

এ আর হাওলাদার জুট মিল বধ্যভূমি
১৯৭১ সালের মাদারীপুরের এ আর হাওলাদার জুট মিলে পাকিস্তান হানাদার বাহিনী একটি ঘাঁটি স্থাপন করে। এখানে প্রতিদিন অসংখ্য মানুষকে ধরে এনে নির্যাতন করত এবং পরে তাঁদের হত্যা করত। ১৯৭১ সালে ৯ ডিসেম্বর মাদারীপুর শত্রুমুক্ত হলে এখানে অসংখ্য নরকঙ্কাল পাওয়া যায়।

শিকদার বাড়ি বধ্যভূমি
মাদারীপুরের শ্রীনদী সড়কের পাশে মিঠাপুরের শিকদার বাড়ি বধ্যভূমিতে গণহত্যায় শত শত মুক্তিপাগল বাঙালিকে হত্যা করা হয়। বিজয়ের শেষ সময়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও তার দোসরদের হাতে শহীদ হন এ অঞ্চলের শতাধিক বুদ্ধিজীবী। এলাকার নিত্যগোপাল ঠাকুর বলেন, সেই সময় শিকদার বাড়ি ও তার আশপাশের শতাধিক মানুষকে লাইন দিয়ে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়। সেদিন নিহত সবাইকে বর্তমান কৃষি ব্যাংক কালীবাজার শাখা ভবনের আশপাশ এলাকায় মাটি চাপা দেওয়া হয়।

মিঠাপুর গোপী ঠাকুরের বাড়ি বধ্যভূমি
মিঠাপুর গোপী ঠাকুরের বাড়ির পেছনে পুকুরের উত্তর পাশে বধ্যভূমিতে ৫১ জন মুক্তিপাগল মানুষকে হত্যা করে মাটি চাপা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তথ্য অনুসন্ধান করে ৩৮ জনের নাম পাওয়া গেছে।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্যরাতে নিরস্ত্র বাঙালির ওপর ‘অপারেশন সার্চলাইট’-এর নামে পাকিস্তান সেনাবাহিনী যে হত্যাকাণ্ড চালায়, তা বিশ্বে নজিরবিহীন। ছবি: সংগৃহীত
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্যরাতে নিরস্ত্র বাঙালির ওপর ‘অপারেশন সার্চলাইট’-এর নামে পাকিস্তান সেনাবাহিনী যে হত্যাকাণ্ড চালায়, তা বিশ্বে নজিরবিহীন। ছবি: সংগৃহীত

কুলদ্বীপ বধ্যভূমি
মাদারীপুর পৌরসভার কুলদ্বীপ সাবেক সরকারি শিশু সদন ভবনের পূর্ব পাশে বধ্যভূমিতে ১৬ জন মুক্তিপাগল মানুষকে হত্যা করে মাটি চাপা দেওয়া হয়।

১৯৭১ সালে মাদারীপুরে সমাদ্দার ব্রিজ-সংলগ্ন বধ্যভূমি, সেনদিয়া, পাখুল্যা, সেনদিয়া, কলাগাছিয়া, এআর হাওলাদার জুট মিল, মিঠাপুর বধ্যভূমি ছাড়াও পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কের কুমার নদীর ফেরিঘাট (বর্তমানে ব্রিজ নির্মিত) এলাকায় অসংখ্য বাঙালি নর-নারীকে হত্যা করে ফেলে দেওয়া হয় কুমার নদীতে।

তথ্যসূত্র: মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক ত্রৈমাসিক স্বপ্ন ’৭১-এর গণহত্যা ’৭১, আবু সাঈদ সম্পাদিত; দৈনিক পূর্বদেশ, ২০ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২ দৈনিক সংবাদ, ২৭ আগস্ট ও ১০ ডিসেম্বর ১৯৯৩ যুদ্ধাপরাধ গণহত্যা ও বিচারের অন্বেষ, ডা. এম এ হাসান, একাত্তরের বধ্যভূমি ও গণকবর, সুকুমার বিশ্বাস, মুক্তিযুদ্ধ কোষ, প্রথম খণ্ড, মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত, মার্চ ২৬, ২০১৬, বাংলা ট্রিবিউন, দৈনিক সংবাদ, ১২ অক্টোবর ১৯৯৩, দৈনিক বাংলা, ২৮ মার্চ ১৯৭২ বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ দলিলপত্র, অষ্টম খণ্ড, হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত, গণহত্যা ৭১: গোপালগঞ্জের সাতপাড়, সুভাষ চন্দ্র সরকার, দৈনিক জনকণ্ঠ, ১৫ ডিসেম্বর ২০১৭

*এই দুই এলাকার গণহত্যা, গণকবর কিংবা বধ্যভূমিসংক্রান্ত আরও যদি খবর থাকে, অনুগ্রহ করে মেইলে জানাবেন।

আবু সাঈদ: কবি, সংগঠক ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষক
[email protected]