সুই-সুতায় রুজিনার ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প

নিজ দোকানে একমাত্র সন্তান তামিমের সঙ্গে রুজিনা আক্তার। ছবি: লেখক
নিজ দোকানে একমাত্র সন্তান তামিমের সঙ্গে রুজিনা আক্তার। ছবি: লেখক

মা, আব্বায় কবে আসব?

কাইল সকালেই তোমার আব্বায় আইব, তুমি অহন ঘুমাও বাবা!
মা, আব্বারে একটা ফোন দেও না, রাকিবের আব্বায় অরে একটা সুন্দর জুতা কিনা দিছে।
আমার আব্বারে কও না আমার জন্য কালা জুতা আনতে!
ঠিক আছে কমুনে বাবা...মা, আব্বা সত্যি সত্যি সকালে আইবো ত?...

যেন হারিয়ে যাওয়া বাবার আসার অপেক্ষায় শিশুর নির্ঘুম চোখকে ঘুমের দেশে নিয়ে যেতে মিথ্যা গল্পের ফুলঝুরিতে মা ভুলিয়ে রাখছেন সন্তানকে। মা–ছেলের এমন কথোপকথন শুনে নাটকের কোনো দৃশ্যের মতো মনে হলেও প্রতিদিন বাবাকে নিয়ে নতুন নতুন মিথ্যা রূপকথার গল্প আর এমন অভিনয় করেই একমাত্র শিশুসন্তান তামিমকে ভুলিয়ে রাখেন মা রুজিনা আক্তার (২৯)।

মনে মনে হয়তো তামিমের মতো রুজিনা আক্তারও বিশ্বাস করেন, সকালেই ঘুম ভেঙে উঠেই দেখবেন স্বামীকে। অথচ রুজিনা আক্তার নিজেই জানেন না তামিমের বাবা হারুন অর রশিদ এখন আছেন কোথায়? কেননা আজ প্রায় ৯ বছর হতে চলল স্ত্রী–সন্তান ফেলে নিরুদ্দেশ হারুন অর রশিদ। একটিবারের জন্য খোঁজ নেয়নি পরিবারের আপনজনের। তাই জীবন–জীবিকার তাগিদে একমাত্র সন্তানের কথা চিন্তা করে নিজ ইচ্ছাশক্তিতে শেখেন সেলাইয়ের কাজ। সেই দক্ষতাকে পুঁজি করে স্বাবলম্বী হতে ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলার বুড়ার বাজারে কাপড় সেলাইয়ের দোকান করছেন তিনি।

দোকানে ছোট শিশু, নারী–পুরুষ থেকে শুরু করে বয়োবৃদ্ধদের পোশাক তৈরি করে যা উপার্যন করেন, তা দিয়েই নিজ পাঁয়ে দাঁড়ানোর প্রত্যয়ে কাজ করে যাচ্ছেন সাহসী রুজিনা আক্তার। দোকান থেকে মাসে যা আয় হয়, তা দিয়ে মা-ছেলের সংসারের খরচ মিটিয়ে সন্তান তামিমকে পড়াচ্ছেন কিন্ডারগার্টেন স্কুলে।

বাবা হারুন অর রশীদের ফিরে আসার অপেক্ষায় ছবির দিকে তাকিয়ে থাকে শিশু তামিম। ছবি: লেখক
বাবা হারুন অর রশীদের ফিরে আসার অপেক্ষায় ছবির দিকে তাকিয়ে থাকে শিশু তামিম। ছবি: লেখক

শরতের চকচকে নীল আকাশের মধ্য দুপুরে তখন গ্রামের স্কুলের ছুটির ঘণ্টা বেজে উঠত, ধুলোমাখা মেঠোপথ দিয়ে হেঁটে হেঁটে স্কুলজীবনের বান্ধবী সুমি, আকলিমা, তাবাচ্ছুম, আখিদের সঙ্গে বাড়ি ফিরত রুজিনা আক্তার। চঞ্চলা দস্যুপনা আর পুতুল খেলার মধ্যে কেটেছে শৈশব। হঠাৎ একদিন মা ঘরে ঢুকেই বললেন, ‘রুজিনা শাড়িডা পইরা ফালা, বাড়িত মেমান আইছে তরে দেহনের লাইগা, কবিরাজ কইছে তর উপর বদ জিনের আসর আছে। বিয়া দিলেই সব ঠিক হইয়া যাইব, আর পোলাডাও পাইছি ভালা। বাজারে দর্জির দোকান আছে, হেগো পছন্দ হইলে আইজ রাইতেই বিয়া হইব।’
‘...মার কথায় শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে ছিল রুজিনা সেদিন, সে হয়তো বুঝে ছিল তাকে নিয়ে সবার চিন্তার আর অন্ত নাই, এবার তার হাতে বিয়ের মেহেদির রং লাগাতেই হচ্ছে।’

সরেজমিনে ফুলবাড়িয়ার বুড়ার বাজারে দুপুরে রুজিনার দোকানে গিয়ে দেখা মিলল কয়েকজন নারীকে। সবাই রুজিনা আক্তারের দোকানের নিয়মিত গ্রাহক, কেউ এসেছেন সালোয়ার–কামিজ বানাতে আবার কেউ বা তার ছোট শিশুর জামাকাপড় বানাতে ভিড় করছেন দোকানে, কারও জামা ফিটিং করাতে হবে। এ সময় রুজিনা আক্তার সঙ্গে কাজ করতে দেখা গেছে গ্রামের বেশ কয়েকজন নারীদের।

জামা বানাতে আসা গৃহিণী রমিছা (৩৫) আক্তার বলেন, ‘রুজিনারে আমি ছোটবেলা থেইহাই চিনি, খুব ভালো হাতের কাজ জানে সে। আমগর গ্রামের ম্যাইয়ারা তার দুহানে (দোকানে) সব সময় জামাকাপড় বানাই, আমার ছোট দুই মেয়ের ফ্রক বানানের লাইগ্যা ওর দোহানে আইছি।’

রুজিনা আক্তার জানান, ‘বিয়ার পর ইচ্ছা আছিলো পড়াশোনাটা চালাইয়া যামু। তয় শ্বশুরবাড়ির মানুষের জন্য পড়াশোনাও গেল এর মধ্যে আবার তামিমের জন্মের পর ওর বাবা বিদেশ যাওনের কথা বইলা আমার বাপের বাড়ি থেইকা ৩ লাখ টাকা নিয়া আমারে আর আমার পোলারে বাপের বাড়িত রাইখা হেই যে বিদেশে গেল ৭ বছর হয়, আর কোনো খবর নিল না আমগো, অহন হুনছি দেশেই আছে, কিন্তু কই আছে, আমি জানি না ভাই।’

দোকানে ব্যস্ত রুজিনা আক্তার। ছবি: লেখক
দোকানে ব্যস্ত রুজিনা আক্তার। ছবি: লেখক

রুজিনার কান্না চেপে আসছিল। অশ্রুসিক্ত হয়ে তিনি বলেন, ‘তামিমের কথা চিন্তা কইরা আমি আর অন্য হানে বিয়া বইনাই আর বিয়াতো মানুষের জীবনে একবারই হয়। পোলাটা সারা দিন বাবা বাবা করে, বাপের ছবিগুলাইনের দিকে চায়া কত কথা কয় আমার লগে, কত রকমের প্রশ্ন তার। কিন্তু পাষণ্ড মানুষটা ফিরা আইলো না পোলার টানে।’

জানা যায়, ফুলবাড়িয়ার রাঙামাটিয়া ইউনিয়নের হাতিলেইট গ্রামের দরিদ্র কৃষক মফিজ উদ্দিন ফকিরের মেয়ে রুজিনা আক্তার। ১৩ বছর বয়সে সপ্তম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় পার্শ্ববর্তী বাদিহাটি গ্রামের আব্দুল হকের ছেলে হারুন অর রশীদের সঙ্গে বিয়ে হয় তাঁর। বিয়ের দুবছর পর তামিমের জন্ম। বিয়ের পর রুজিনা আক্তারের স্কুলে যাওয়ার বিষয়টি পছন্দ করতেন না স্বামীসহ শ্বশুরবাড়ির লোকজন। এরপরও স্বামী-সংসার সন্তানের দেখভালের পর কোনোমতে এসএসসি পরীক্ষা পর্যন্ত পড়াশোনা চালিয়ে গেলেও শ্বশুরবাড়ির চরম প্রতিবন্ধকতার কবলে পড়ে পরীক্ষা দেওয়া হয়নি রুজিনার। স্বামী বিদেশ পাড়ি দেওয়ার পর বেশ কয়েক বছর বাপের বাড়িতে ছিলেন রুজিনা। এরপরই তাঁর মনে হয় কেন সংসারে বোঝা হয়ে বেঁচে থাকবেন, কেন কারও বোঝার পাত্র হবেন। আর সেই অদম্য ইচ্ছাশক্তি থেকেই হাতে তুলে নেন সুই-সুতা। গ্রামের বাড়ি বাড়ি গিয়ে কার কী বানানোর প্রয়োজন, অর্ডার এনে বাড়িতে বসেই হাতে সেলাইয়ের কাজ শুরু করেছিলেন রুজিনা। বেশ কিছুদিনের মধ্যে কাজের চাহিদাও বেড়ে যায় গ্রামের মানুষের মধ্যে, গ্রামের নারী থেকে শুরু করে স্কুল–কলেজের মেয়েরা তাঁর কাছে কাপড় বানাতে আসত। একসময় বিষয়টি বড় বোনজামাই বাবুল হোসেন লক্ষ করে রুজিনা আক্তারকে একটি সেলাই মেশিনসহ বুড়ার বাজারে দর্জির দোকান দিয়ে দেন।

বোনজামাই বাবুল হোসেন বলেন, ‘রুজিনাকে আমার ছোট বোনের মতোই স্নেহ করি। ওকে আরেকটা বিয়ে দিতে চেয়েছিলাম কিন্তু তামিমের জন্য বিয়ে বসতে রাজি হয়নি। শুধু একা না গ্রামের অন্যদের এ কাজে উদ্বুদ্ধ করে সে।’

তবে রুজিনার পথচলা কিন্তু মসৃণ ছিল না। অন্য নারীদের যেমন কথা শুনতে হতো, তাঁকেও হয়েছে। রুজিনা বলেন, ‘যখন প্রথম প্রথম বাজারে দোকানে বসে কাজ শুরু করেন সবাই তাঁকে নিয়ে এটা–ওটা বলাবলি করতেন। বাড়ির মেয়ে কেন বাইরে হাটবাজারে দোকান করবে? কিন্তু মানুষের কথায় কান না দিয়ে কাজ করে চলেছেন নিজের মতো। গ্রামে আমার মতো আরও অনেক নারী আছেন, তাঁরা প্রতিনিয়িত সমাজের তুচ্ছতাচ্ছিল্য ছাড়া আর কিছুই না, তাই তাঁর ইচ্ছা নির্যাতিত নারীদের সেলাইয়ের কাজ শিখিয়ে স্বাবলম্বী করার পাশাপাশি তাঁদের পাশে থেকে কাজ করবেন।’

রুজিনা বলেন, ‘আমার এই ছোট্ট দোকানে গ্রামের প্রায় আট থেকে দশ জন নারী প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন সেলাই কাজ শেখার জন্য। আমি যদি সরকারি বা বেসরকারিভাবে আরও উন্নত প্রশিক্ষণের সুযোগ এবং কোনো ব্যাংক থেকে সহজ শর্তে ঋণ পাই, তবে আমার স্বপ্নটা একদিন পূরণ করতে পারব নিশ্চয়ই।’

এদিকে ৯ বছর ধরে স্ত্রী–সন্তানের ভরণপোষণের খরচ না দেওয়ায় যৌতুক নিরোধ আইনে ২০১৬ সালে ময়মনসিংহের বিজ্ঞ সিনিয়র জুডিশিয়াল ২ নম্বর আমলি আদালতে স্বামী হারুন অর রশিদ (৩২), শ্বশুর আব্দুল হক এবং শাশুড়ি মোছা. হারতন নেছার নামে মামলা করেন।

মামলায় রুজিনা উল্লেখ করেন, ২০০৮ সালের ৮ অক্টোবর বিয়ে হয় হারুনের সঙ্গে। বিয়ের পর হারুন ওমান যাওয়ার কথা বলে রুজিনার বাড়ি থেকে প্রায় ৩ লাখ টাকা দাবি করেন। রুজিনার ভাই সেই টাকা দিয়ে হারুনকে ওমান পাঠিয়ে দেন। বিদেশে যাওয়ার পর হারুন অর রশিদ তাঁর স্ত্রী সন্তানের কাছে টাকা পাঠানো দূরের কথা একটিবারের জন্য কোন খোঁজ নেয়নি। তবে এই সময়ে হারুন তাঁর বাবা–মার কাছে নিয়মিত টাকা পাঠাতেন বলে অভিযোগে উল্লেখ করা হয়। ওমান থেকে আসার কিছুদিন পর আরও ২ লাখ টাকা হারুন তাঁর শ্বশুরের কাছে দাবি করেন। রুজিনার পরিবার সেই টাকা দিতে রাজি না হওয়ায় পরিবারের সদস্যদের রেখে নিরুদ্দেশ হন হারুন।

আজ ৯ বছর ধরে স্বামীর কোনো খোঁজ জানেন না রুজিনা আক্তার। তবু এখনো মনে মনে তাঁকেই স্বামী মানেন এই বঙ্গ ললনা। তাঁর স্বামী একদিন তাঁর কাছেই ফিরে আসবেন, এমন বিশ্বাস রুজিনার।

রাঙামাটিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সালিনা চৌধুরী সুষমা বলেন, রুজিনার বিষয়টি খুব বেদনাদায়ক। রুজিনার মতো অসংখ্য মেয়ের জীবনে এমন ঘটনা ঘটে। নারীদের প্রতি এমন আচরণের কারণ হলো অশিক্ষা ও সামাজিক সচেতনতার অভাব। পুরুষশাসিত সমাজ ব্যবস্থায় এমন ঘটনা যুগ যুগ ধরে ঘটেই চলেছে। তাই নারী নির্যাতনের বিষয়ে আমাদের সবাই মিলে একটি সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা একান্ত প্রয়োজন।