এনআরসি ও ক্যাব নিয়ে কিছু কথা

আসামে এনআরসির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সমাবেশ হয়। ফাইল ছবি
আসামে এনআরসির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সমাবেশ হয়। ফাইল ছবি

ভারতজুড়ে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (সিএএ) ও জাতীয় নাগরিক নিবন্ধন (এনআরসি) বিরোধী আন্দোলন চলছে। আর এ দুটো আইন ভারতের সাংবিধানিক মূলনীতি ধর্মনিরপেক্ষতার বিষয়টিকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। মানবাধিকারকর্মীদের মতে, এর ফলে ভারতের অনেক অধিবাসীকে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে পরিণত করার চেষ্টা হচ্ছে। জোরপূর্বক অনেকের নাগরিকত্ব ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে, যা মানবাধিকার লঙ্ঘনের আওতায় পড়ে।

আসামে এনআরসির ফলস্বরূপ নাগরিকত্ব হারায় প্রায় ২০ লাখ মানুষ, যা আসামের পরিস্থিতিকে উত্তপ্ত করে তোলে। এ উত্তাপের পেছনের কারণ শুধু মুসলিম বাঙালিদের নাগরিকত্ব ছিনিয়ে নেওয়াই নয়, বরং প্রকাশিত ওই নাগরিক নিবন্ধনে বাদ পড়েন প্রচুর বাঙালি হিন্দু, যাঁরা অবৈধ অভিবাসী হওয়ার ঝুঁকিতে পড়ে যান। নাগরিকত্ব আইন সংশোধনের জন্য তাই ক্ষমতাসীন বিজেপি সরকার রাজি হয় এবং এ-ও বলে, প্রকাশিত নিবন্ধনপত্রটি ত্রুটিপূর্ণ ছিল।

সমালোচকেরা মনে করেন, ধর্ম নিয়ে উন্মাদনা ও ভারতকে হিন্দু রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা বিজেপি সরকারের অন্যতম আলোচ্য বিষয়। সাংবিধানিকভাবে রাষ্ট্রটি ধর্মনিরপেক্ষ হলেও বিজেপি সরকারের কর্মকাণ্ড তার পরিচয় দিচ্ছে না। বিতর্কিত এনআরসি আসামের পর পশ্চিমবঙ্গ ও ধীরে ধীরে ভারতের অন্যান্য অঞ্চলে আরোপ করা হবে বলে প্রাথমিকভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, যদিও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এর বিরোধিতা করেছেন। এনআরসির পর ক্যাব আইনে পরিণত করায় ভারতের দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলগুলোতে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনে (সিএএ) মুসলিমদের অবহেলা করা হয়েছে। বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান থেকে ভারতে গিয়ে ৬ বছর ধরে বসবাস করা হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন, খ্রিষ্টান, শিখ, পারসি অধিবাসীরা নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করতে পারবেন। কিন্তু মুসলিমরা পারবেন না।

সিএএ ও এনআরসি-বিরোধী বামপন্থী দলের প্রতিবাদ মিছিল। ফাইল ছবি
সিএএ ও এনআরসি-বিরোধী বামপন্থী দলের প্রতিবাদ মিছিল। ফাইল ছবি

ভারতের মহাত্মা গান্ধী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক কাস্তুরি কৃষ্ণা বলেন, ‘একজন অসমিয়া হিসেবে আমি আসলে বুঝতে পারছি না এনআরসির মাধ্যমে সরকার আসলে কী চাচ্ছে। ৯ লাখ মানুষ নিবন্ধিত হয়নি, তারা বৈদেশিক ট্রাইব্যুনালে তাদের কেস নিয়ে লড়তে যাচ্ছে। যদি তারা নাগরিকত্ব প্রমাণে ব্যর্থ হয়, তখন উচ্চ আদালতে যাবে, তারপরও যদি ব্যর্থ হয় তখন আসলে কী হবে, তা স্পষ্ট নয়। জোর করে এই বিপুলসংখ্যক মানুষকে দেশ থেকে তাড়িয়ে দেওয়া সম্ভব বলে আমি মনে করি না, আর এটা মানবাধিকার লঙ্ঘনও।

দক্ষিণ ভারতের অধিবাসী পদুচেরি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী সারান্যা পটলুরি বলেন, ‘মানবাধিকার প্রশ্নে এনআরসি ইতিবাচক নয়, ব্যক্তিগতভাবে আমার বাদ যাওয়া মানুষের জন্য খারাপ লাগা রয়েছে।’ আসামে চাকরি সুবাদে বসবাসরত নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মুসলিম পুলিশ কর্মকর্তা ‘দ্য গার্ডিয়ান’ পত্রিকায় বলেন, ‘মুসলিমদের ইচ্ছাকৃতভাবে অবহেলিত রাখা হচ্ছে। আমি নিজে পুলিশে আছি তাও ভয়ে থাকি, কারণ আমি মুসলিম।’

অবৈধ নাগরিক চিহ্নিত ও বিতাড়িত করার জন্য বিজেপি সরকারের ধর্মভিত্তিক পক্ষপাতদুষ্টতা সবার কাছেই প্রমাণিত। কেন্দ্র থেকে এটাও বলা হয়েছে, বাদ যাওয়া মুসলিমরা মুসলিম রাষ্ট্রের কাছে আশ্রয় চাইতে পারেন। বাঙালি মুসলিম যারা বাংলাদেশ থেকে অভিবাসী হয়েছেন ও অনেক প্রজন্ম ধরে ভারতে বসবাস করছেন, তাঁদের হঠাৎ রাষ্ট্রহীন করে দিলে এবং তারা বাংলাদেশের কাছে আশ্রয় চাইলে তা বিদ্যমান রোহিঙ্গা সংকটকেও পেছনে ফেলবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। আর সব থেকে বড় কথা, এত বিপুলসংখ্যক মানুষ যারা ভারতে বসবাস করছে প্রজন্ম ধরে, তারা কেন অন্য দেশে আসতে চাইবে, তা-ও বোধগম্য নয়। সরকারের বোঝা উচিত এটা জাতিগত দ্বন্দ্ব ও সংঘাত উসকে দেবে। বিশ্লেষকেরা আরও মনে করেন, হিন্দুত্ববাদী বিজেপি সরকারের দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বেশি মনোযোগ দেওয়া দরকার।