মুক্তিযুদ্ধোত্তর দিনাজপুরে ৬ জানুয়ারির বেদনা

১৯৭২ সালের ৬ জানুয়ারি মহারাজা স্কুল প্রাঙ্গণে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের গণসমাধি। চেহেলগাজী মাজার প্রাঙ্গণ, দিনাজপুর। ছবি: সংগৃহীত
১৯৭২ সালের ৬ জানুয়ারি মহারাজা স্কুল প্রাঙ্গণে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের গণসমাধি। চেহেলগাজী মাজার প্রাঙ্গণ, দিনাজপুর। ছবি: সংগৃহীত

১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১, বাঙালির দীর্ঘ ৯ মাসের যুদ্ধ জয়ের দিন। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এদিন আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়েছিল বীর বাঙালিদের কাছে। পাকিস্তানি হানাদারদের আত্মসমর্পণের ভেতর দিয়ে বিশ্ব মানচিত্রে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটেছিল এই দিনে। নতুন পতাকা, নতুন দেশ নিয়ে বীরোচিত অভিযাত্রা শুরু হয়েছিল সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের।

যুদ্ধ শেষে ঘরে ফেরার পালা। ঘরে ফিরতে থাকে বাঙালি শরণার্থীরা। ঘরে ফেরার প্রস্তুতি নিতে থাকেন বাংলার বীর মুক্তিযোদ্ধারা। ঘরে ফেরার প্রস্তুতি হিসেবে তাঁরা সমবেত হতে থাকেন বিভিন্ন ট্রানজিট ক্যাম্পে। সেখানেও অনেক কাজ। ঘরে ফিরতে চাইলেও সঙ্গে সঙ্গে ঘরে ফেরা যাচ্ছিল না।

বিশেষ করে যুদ্ধ জয়ের সঙ্গে সঙ্গেই সেদিন সব মুক্তিযোদ্ধার পক্ষে ঘরে ফেরা সম্ভব হয়নি। কারণ শত্রু বাহিনীর ফেলে যাওয়া, পুঁতে রাখা অস্ত্র, গোলা, বোমা, বারুদ তখনো অনেকের প্রাণ সংহারের কারণ হয়ে উঠছিল। বিভিন্ন স্থানে, যেখানে-সেখানে ফেলে যাওয়া, পুঁতে রাখা সেসব বিপজ্জনক মারণাস্ত্র যতক্ষণ নিরাপদ দূরত্বে সরিয়ে নেওয়া না যায়, ততক্ষণ মুক্তিযোদ্ধাদের ঘরে ফেরা সম্ভব নয়। এ জন্য বিজয়ী মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে দেশের বিভিন্ন এলাকায় গড়ে তোলা হয় ট্রানজিট ক্যাম্প।

মুক্তিযুদ্ধে ৬ ও ৭ নম্বর সেক্টরের আওতায় দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও ও পঞ্চগড়ের যেসব মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন, তাঁদের নিয়ে ট্রানজিট ক্যাম্প করা হয় দিনাজপুরের মহারাজা গীরিজানাথ হাইস্কুল প্রাঙ্গণে। বৃহত্তর দিনাজপুরে যুদ্ধ করেছেন এমন প্রায় দেড় থেকে দুই হাজার মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে এ ট্রানজিট ক্যাম্প গড়ে উঠেছিল। ক্যাম্পের সার্বিক নেতৃত্বে ছিলেন লে. কর্নেল শাহরিয়ার।

ক্যাম্পের মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে বৃহত্তর দিনাজপুরের বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর পুঁতে রাখা, ফেলে রাখা, ছেড়ে যাওয়া মাইন, বোমা ও অন্যান্য অস্ত্র উদ্ধার করা হতো। প্রতিদিনের উদ্ধারকৃত অস্ত্র ট্রানজিট ক্যাম্পের বড় বাংকারে রেখে দেওয়া হতো। মহারাজা স্কুলের বিরাট মাঠের দক্ষিণ দিকে (বর্তমানে যেখানে মসজিদ রয়েছে তার পাশেই) উদ্ধারকৃত এসব অস্ত্রের বাংকার ছিল। সেখানে থাকত উদ্ধার করা অ্যান্টি ট্যাংক মাইন, অ্যান্টি পারসোনাল মাইন, জ্যাম্পিং মাইন, মর্টারের ২ ও ৩ ইঞ্চি শেল, গ্রেনেড ইত্যাদি। স্বাধীন দেশের মাটি নিরাপদ করতে মুক্তিযোদ্ধারা উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে প্রতিদিনের উদ্ধারকাজ চালাতে থাকেন। বিপুল পরিমাণ অস্ত্র উদ্ধার হয় কয়েক দিনে। কিন্তু বিজয়ের মাত্র ২০ দিন পর ১৯৭২ সালের ৬ জানুয়ারি সব আনন্দ উদ্দীপনা নিঃশেষ হয়ে যায় এক অকল্পনীয় দুর্ঘটনায়।

১৯৭২ সালের ৬ জানুয়ারি, সূর্য তখন অস্তগামী। আকাশে লাল আভা। ঠিক এ সময় অকস্মাৎ প্রচণ্ড বিস্ফোরণে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হলো মহারাজা স্কুল। স্কুলের দ্বিতল ভবন গুঁড়িয়ে গেল। মাঠের যে স্থানটিতে অস্ত্রভান্ডার ছিল, সেটি বিরাট খালে পরিণত হলো। সেই খালে উঠে এল পানি। আর গোটা আকাশ, গোটা মহারাজা স্কুল প্রাঙ্গণ অন্ধকারে ঢেকে গেল। স্কুলের বিশাল এলাকা এবং এর চারপাশে নিহত আর আহত মানুষের পোড়া গন্ধে ভয়ংকর এলাকায় পরিণত হলো ট্রানজিট ক্যাম্প। এ অকস্মাৎ বিস্ফোরণ শুধু মহারাজা স্কুলপ্রাঙ্গণ নয়, গোটা দিনাজপুর শহরকে ভূমিকম্পের মতো কাঁপিয়ে দিয়েছিল। এখান থেকে ৪০-৫০ মাইল দূরের লোকও বিকট একটি শব্দের সঙ্গে সঙ্গে বিশাল এক অগ্নিকুণ্ড দেখতে পেয়েছিল।

কেমন করে এ দুর্ঘটনা ঘটেছিল, এর সঠিক ব্যাখ্যা আজও পাওয়া যায়নি। তবে বিভিন্ন সূত্রে এবং অনেকের লেখা থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, অন্যান্য দিনের মতো ৬ জানুয়ারিতেও বিপুলসংখ্যক অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার করা হয়েছিল এবং সে অস্ত্রগুলো দুটি যানবাহনে করে (কারও কারও মতো তিনটি) মহারাজা স্কুলে আনা হয়েছিল। ট্রাক থেকে অস্ত্র খালাসের কাজ শুরু হয় বিকেল ৪ টার দিকে। বাংকার বা অস্ত্রভান্ডার থেকে ট্রাকের দূরত্ব ছিল ১০০ গজের মতো। এ ১০০ গজের মধ্যে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা দাঁড়িয়ে ছিলেন। ট্রাক থেকে অস্ত্র নামিয়ে হাতবদলের মাধ্যমে বাংকারে অস্ত্রগুলো রাখা হচ্ছিল। কিন্তু সেদিন হাতবদলের সময় একজন মুক্তিযোদ্ধার কাছ থেকে একটি মাইন ফসকে পড়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে সেটি বিস্ফোরিত হয়। বিস্ফোরণের সঙ্গে সঙ্গেই বাংকারে মজুত অস্ত্রভান্ডারও বিস্ফোরিত হয়ে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ সাধন করে। সেই ভয়াবহ বিস্ফোরণে ক্যাম্পে উপস্থিত কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাদের অকালমৃত্যু ঘটে।

দুর্ঘটনার সময় সঠিক কতজন মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে উপস্থিত ছিলেন, তার সুনির্দিষ্টভাবে তথ্য নেই। বিভিন্নজনের থেকে জানা গেছে, সকালে রোল কলের সময় ৭৮০ জন মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে উপস্থিত ছিলেন। তারপর অনেকেই ২-১ দিনের ছুটি নিয়ে স্বজনদের সঙ্গে দেখা করতে ক্যাম্প ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। ক্যাম্প ছেড়ে চলে যায় কত জন? তাও জানেন না কেউ। তাই দুর্ঘটনার সময় ক্যাম্পে অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা বলা কঠিন।

দুর্ঘটনার পরপরই উদ্ধারকাজে নেমে পড়েন স্থানীয় জনসাধারণ। কিন্তু সে সময় বিদ্যুৎ না থাকায় ঘন অন্ধকারের ভেতর উদ্ধারকাজ চালানো কষ্টকর ছিল। পরে ভারতীয় মিত্রবাহিনী উদ্ধারকাজে যোগ দেয়। গাড়ির লাইট জ্বালিয়ে এবং টর্চ, হ্যাজাক ও লণ্ঠনের আলোয় রাতভর উদ্ধারকাজে সর্বস্তরের মানুষ অংশ নেন। পরদিন প্রথমে ৮৬ জনের, পরে আরও ২১ জনের লাশ চেহেলগাজী মাজার প্রাঙ্গণে দাফন করা হয়। লাশগুলোর সবই মুক্তিযোদ্ধাদের।

স্বাধীন বাংলাদেশে এত বড় ট্র্যাজেডি আর কোথাও হয়নি। এক সঙ্গে কয়েক শ বিজয়ী মুক্তিযোদ্ধার প্রাণ ঝরে যাওয়া বড়ই বড় মর্মান্তিক, হৃদয়বিদারক ঘটনা অকল্পনীয়। যে মুক্তিযোদ্ধারা ঘরে ফিরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, বাংলাকে স্বাধীন করে এর মাটিকে নিরাপদ করতে সক্রিয় ছিলেন, তাঁদের এ প্রাণ বিসর্জন বেদনার চেয়েও বেদনাদায়ক।

১৯৭২ সালের ৬ জানুয়ারির দুর্ঘটনায় আহত মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মজিদ (পিতা মাহাতাব উদ্দিন, গ্রাম, বলঞ্চা, থানা: রানীশংকৈল, জেলা- ঠাকুরগাঁও) স্মৃতিচারণা করে পত্রে লিখেছিলেন, ‘১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস পালন করি রানীশংকৈল থানার নেকমরদে। এখান থেকে দিনাজপুরে একত্র হওয়ার নির্দেশ পেয়ে আমরা ১৫ সদস্যের একটি দল ১৯৭২ সালের ৪ জানুয়ারি দিনাজপুরের মহারাজা স্কুলে হাজির হই। ক্যাপ্টেন শাহরিয়ারের কাছে আমাদের হাতিয়ার জমা দিয়ে আমরা অবস্থান গ্রহণ করি। স্কুলের মাঝ কক্ষটিতে আমরা মেঝেতে বিছানা করে নেই। আমাদের গ্রুপের কারও থালা, বাটি, গ্লাস ছিল না। অন্যের থালা, বাটি, গ্লাসে খেয়ে যার যার বিছানায় শুয়ে পড়ি। কয়েক দিন আগের থেকেই আমার জ্বর ও মাথাব্যথা ছিল। সুতরাং খাওয়ার পর বাইরে যাওয়ার কোনো ইচ্ছা হলো না। ৬ জানুয়ারি আমি ও শ্রী সিরেন চন্দ্র দুপুরে খেয়ে বিছানায় বসে নিজেদের বাড়ির গল্প করছিলাম। কারণ ৫ জানুয়ারি (বুধবার) আমার প্রতিবেশী মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল, বিরেন্দ্রনাথ ও আমার এক চাচা ছুটি নিয়ে বাড়ি চলে গিয়েছিলেন। আমিও ছুটি চেয়েছিলাম, কিন্তু দিল না। তাই অসুস্থ শরীরে, দুঃখভারাক্রান্ত মনে সিরেন চন্দ্রের সঙ্গে এক বিছানায় বসে গল্প করছিলাম। বিকেল ৫টার দিকে সৈয়দপুর থেকে মাইন ও বিস্ফোরক দ্রব্য বোঝাই দুইটি ট্রাক আসে। এ সময় মাঠে সবাইকে হাজির হওয়ার জন্য হুইসেল দেওয়া হয়। আমি অসুস্থতার কারণে বের না হয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ি। আমার পাশে সিরেন চন্দ্রও শুয়ে পড়েন। মুক্তিযোদ্ধারা ট্রাক থেকে মাইন নামানো শুরু করেন। ছোট-খাটো বিস্ফোরকগুলো আমাদের পাশের কক্ষে এবং বড় ধরনের মাইনগুলো একটি গর্তে রাখা হচ্ছিল। পাশের মসজিদে তখন আজান শুরু হলো। আজান শেষ হতে না হতেই হঠাৎ একটা বিদ্যুতের চমক এবং প্রকম্পিত বিকট আওয়াজ শুনতে পেলাম। তারপরে কী হলো আর কিছুই বলতে পারি না। পরের দিন সকাল ৯টায় নিজেকে আবিষ্কার করলাম সদর হাসপাতালের বিছানায়। জানতে পারলাম যে আমার সাথি সিরেন বেঁচে নেই।’

মুক্তিযোদ্ধা ফজলুল হক (গ্রাম কাদিহাট, থানা রানীশংকৈল) ৬ জানুয়ারির দুর্ঘটনায় আহত হয়েছিলেন। তিনি এ প্রসঙ্গে এক চিঠিতে লিখেছিলেন, ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় অর্জনের পর আমরা রানীশংকৈল থানার নেকমরদ ইউনিয়ন পরিষদের একটি ঘরে অবস্থান করছিলাম। ১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাসে নির্দেশ গেল হাতিয়ার জমা দেওয়ার। আমরা ৭ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধা। সেই সূত্রে আমাদের ধারণা ছিল যে, আমাদের বগুড়ায় ক্লোজ হতে হবে। নেকমরদ থেকে ৪ জানুয়ারি গরুর গাড়ি যোগে শিবগঞ্জ হয়ে ঠাকুরগাঁও এসে পৌঁছালাম বেলা ২টার দিকে। ঠাকুরগাঁও থেকে আর কোনো যানবাহন না পেয়ে অনেক অনুরোধের পর ভারতীয় সৈনিকদের ট্রাকে উঠে দিনাজপুর শহরের বালুবাড়ীতে এসে পৌঁছাই সন্ধ্যার দিকে। বালুবাড়ী থেকে মহারাজা স্কুলে যাই। ৬ জানুয়ারি আমার ছুটি নিয়ে বাড়ি আসার কথা ছিল। কিন্তু অজ্ঞাত কোনো কারণবশত আমাকে ছুটি দেওয়া হয়নি। ছুটি না পাওয়ায় এমনিতেই মন খারাপ ছিল। তদুপরি অন্যের প্লেট নিয়ে ভাত খাওয়ার জন্য বাবুর্চিখানায় গিয়ে বাবুর্চির মুখে শুনলাম যে, শুধু ডাল-ভাত। আমার গায়ে যেন আগুন ধরে গেল। এত কষ্ট করে স্বাধীনতা আনার পরও শুধু ডাল-ভাত খেতে হবে! প্লেটটা ছুড়ে ফেলে দিয়ে নিজের পকেট থেকে টাকা বের করে কাশিপুর নিবাসী মুক্তিযোদ্ধা নুরুজ্জামানকে হোটেল থেকে ভাত আনতে পাঠাই। রাগান্বিত মনে রুমে এসে জানালার ধারে বসে রেডিও নিয়ে কিছুক্ষণ থাকার পর বিছানায় শুয়ে পড়ি। পাশে ছিলেন ডিজেল চন্দ্র। ভাতের অপেক্ষায় থাকতে থাকতে মাগরিবের আজান শুনতে পাই। আজান শেষ হতে না হতেই হঠাৎ বিকট আওয়াজ এবং বিদ্যুৎ চমক দেখতে পেলাম। এরই মধ্যে কখন যে ছাদ ভেঙে আমার ওপর পড়ে গেছে, তা বুঝতেই পারিনি। একটু পরে লক্ষ করে দেখি যে ডিজেল চন্দ্র ছাদের টুকরোর নিচ থেকে হাত বের করে আমাকে ডেকে বলছে, আমাকে বাঁচাও। বিসমিল্লাহ বলে ডিজেলের হাত ধরে টেনে বের করি এবং প্রধান গেটের দিকে দৌড়াতে থাকি। পেছন থেকে কতজন যে আমাকে ডেকেছে, তা নিজেই জানি না। এদিকে আমার মাথা ফেটে রক্তে পুরো শরীর ভিজে গেছে, তা অনুভব করতে পারিনি। পাশেই একটি পানের দোকান ছিল। সেই দোকানের কাছে এসে জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। রাতেই আমাকে সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ৩-৪ দিন পর জ্ঞান ফিরে আসে।

দিনাজপুরের এ ট্র্যাজেডিতে অনেকের ধারণা, সেদিন প্রায় ৪০০ থেকে ৫০০ মুক্তিযোদ্ধার মৃত্যু হয়েছিল। অধিকাংশই ছিলেন দিনাজপুর শহরের বাইরের। আহতদের তুলনায় মৃত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা বেশি ছিল। দিবসটিকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের কোথাও, এমনকি দিনাজপুরেও কোনো ধরনের কর্মসূচি পালন হতো না। এমনকি মহারাজা স্কুলেও কর্মসূচি থাকত না শোকাবহ দিবসটিকে কেন্দ্র করে।

ট্র্যাজেডির প্রায় ১৬ বছর পর ১৯৮৮ সালে দিনাজপুরের ৩টি ক্ষুদ্র সংগঠন অমৃত সাহিত্য গোষ্ঠী, হোমিও মেডিক্যাল ছাত্র ঐক্য পরিষদ—দিনাজপুর শাখা এবং পাটুয়াপাড়া জাগরণী ক্লাব প্রথমবারের মতো ৬ জানুয়ারিতে ‘ট্র্যাজেডি দিবস’ পালন করে। ওই বছর পত্রপত্রিকায়ও ৬ জানুয়ারির ওপর প্রবন্ধ বের হয়। ফলে দিনাজপুরের এ ট্র্যাজেডি সম্পর্কে দিনাজপুরবাসী নতুন করে জানতে পারেন। সঙ্গে জানতে পারেন দেশবাসীও। এরপর প্রতিবছরই বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে দিবসটি পালিত হয়ে আসছে।

মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক মুক্তিযুদ্ধকালীন জোন-৬-এর চেয়ারম্যান মরহুম এম আবদুর রহিম, মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক সাইফুদ্দিন আকতার এবং সাংবাদিক আজহারুল আজাদ জুয়েলের প্রচেষ্টায় ৬ জানুয়ারি নিহত ও আহত মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা সংগ্রহের চেষ্টা চালানো হয়। পূর্ণাঙ্গ তালিকা পাওয়া কঠিন ছিল। তবুও উদ্যোগের অংশ হিসেবে নিহত ১২২ জন এবং আহত ৪৪ জন মুক্তিযোদ্ধার নাম সংগ্রহ করা যায়। এম আবদুর রহিমের উদ্যোগে সেই সব আহত ও শহীদ মুক্তিযোদ্ধার নামাঙ্কিত একটি স্মৃতিফলক স্থাপন করা হয় ২০০০ সালের ৬ জানুয়ারি। বিডিআরের তৎকালীন মহাপরিচালক আ. ল. ম. ফজলুর রহমান সেই স্মৃতি ফলক উদ্বোধন করেন। দিনাজপুর পৌরসভার সাবেক মেয়র ও ৬ জানুয়ারি স্মৃতি পরিষদের বর্তমান আহ্বায়ক মুক্তিযোদ্ধা সফিকুল হক ছুটুও এই উদ্যোগের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। তিনি স্মৃতিফলক স্থাপন কমিটির সদস্যসচিব ছিলেন।

চেহেলগাজী মাজার প্রাঙ্গণে ১৯৭২ সালের ৭ জানুয়ারি মুক্তিযোদ্ধাদের গণসমাধি হওয়ার পর স্থানীয় জনগণ সমাধির সামনে একটি ছোট্ট শহীদ মিনার তৈরি করেন। কিছু মানুষ প্রতিবছর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে ও ৬ জানুয়ারিতে সেখানে শ্রদ্ধাঞ্জলি দিয়ে থাকেন। সেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের গণ সমাধিসৌধে বেঙ্গল রেজিমেন্ট একটি স্মৃতিফলক দিয়েছে। কিন্তু ৭২ সালের এত বড় ট্র্যাজেডির ঘটনায় জাতীয় পর্যায়ের কোনো উদ্যোগ না থাকা পীড়াদায়ক!

বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আসার আগে দিনাজপুরে এক জনসভায় মহারাজা স্কুলে একটি স্মৃতি স্তম্ভ নির্মাণের ঘোষণা দিয়েছিলেন। জাতীয় সংসদের বর্তমান হুইপ ইকবালুর রহিম উদ্যোগী হয়ে সম্প্রতি স্মৃতিসৌধের নির্মাণকাজ উদ্বোধন করেন। সেই কাজ এগিয়ে চলছে।

*আজহারুল আজাদ জুয়েল: সাংবাদিক