ঢাকায় নির্বাচনে গণতন্ত্রের শোক যাত্রা দেখতে চাই না

থার্টি ফাস্ট নাইটে রঙিন ঢাকা। ছবি: দীপু মালাকার
থার্টি ফাস্ট নাইটে রঙিন ঢাকা। ছবি: দীপু মালাকার

‘ঢাকা শহর আইসা আমার আশা ফুরাইছে/ আরে লাল লাল নীল নীল বাত্তি দেইখ্যা নয়ন জুড়াইছে’—জনপ্রিয় এ গান ছড়িয়ে আছে মানুষের মুখে মুখে।

ঢাকা তো সব সময় নতুন জামাইয়ের অপরূপ বেশে থাকে! বিশেষ করে রাতের তিলোত্তমা ঢাকার আলাদা একটা সৌন্দর্য রয়েছে। রাতের আলো-আঁধারিতে অনেকটা অচেনাও হয়ে ওঠে জাদুর শহরটি। চারদিকে লাল, নীল, হলুদ, সাদা আর সবুজ রঙের বর্ণিল আলো আর সর্পিল সব রেখা ভেসে বেড়ায় এই কাছে, ওই দূরে! ঢাকার গায়ে এত সৌন্দর্য অবশ্য সবাইকে পুলকিত করে না। ঢাকার রাজপথে নানা রঙের-ঢঙের বিলাসবহুল গাড়ি কিংবা আকাশচুম্বী দর্শনীয়, লক্ষণীয়, অপরূপ, বিচিত্র, দৃষ্টিনন্দন অট্টালিকা আর আলো-ঝলমলে শপিং মল দেখে ভাবা ঠিক হবে না, ঢাকা নামের শহরে অভাব বলতে কিছু নেই। বরং এ শহরের মানুষের অনেক কিছুর অভাব। চকচক দেখলেই কোনো সমস্যা নেই, কষ্ট নেই, বিষয়টা মোটেও তা নয়। ঔজ্জ্বল্যের মধ্যে নগরবাসীর সমস্যা হারিয়ে যায় না।

এ তিলোত্তমা ঢাকার অন্য পরিচয়ও রয়েছে! রিকশার শহর, মশার শহর, বসবাসের অযোগ্য শহর, ঘনবসতির শহর, বস্তির শহর, পকেটমারের শহর, মলম পার্টির শহর, যানজটের শহর, ডেঙ্গুর শহর, আবর্জনার শহর, ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের শহর, ফিটনেসবিহীন গাড়ির শহর, দখলের শহর, মিছিল-মিটিং-কাঁদানে গ্যাসের শহর, খুনের শহর, কাকের শহর, উন্মুক্ত ডাস্টবিনের শহর, ভিক্ষুকের শহর—আরও কত পরিচয়! এত কিছুর ওপরে আরও একটি বড় পরিচয় রয়েছে ঢাকার। সম্প্রতি বিশ্বের সবচেয়ে অনিরাপদ শহরের তালিকায় পঞ্চম হয়েছে আমাদের প্রিয় রাজধানী ঢাকা। ইকোনমিস্ট ইনটেলিজেন্স ইউনিটের সেফ সিটি ইনডেক্সে এমনটি বলা হয়েছে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা সম্পর্কে। গত বছর তৃতীয় স্থানে ছিলাম আমরা।

একটা শহরের মানুষের দুঃখ-কষ্ট শুধু তার অবকাঠামো দিয়ে ঢেকে দেওয়া যায় না। এ রাজধানী শহরেও অভাব-অনটনের মধ্যে দিন কাটানো মানুষের সংখ্যা অনেক। এ জন্য নগরপিতাদের চিন্তাচেতনায় থাকতে হবে অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসার মতো মৌলিক চাহিদাগুলো দরিদ্রতম মানুষগুলোর কাছে দ্রুততম সময়ে পৌঁছে দেওয়া।

শুধু থার্টি ফাস্ট নাইটে নয়, সারা বছর নানান উৎসবে এভাবে রঙিন থাকে ঢাকা শহর। ছবি: দীপু মালাকার
শুধু থার্টি ফাস্ট নাইটে নয়, সারা বছর নানান উৎসবে এভাবে রঙিন থাকে ঢাকা শহর। ছবি: দীপু মালাকার

২০১৯ সাল শুরু হয়েছিল একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন-পরবর্তী উত্তেজনা দিয়ে। ওই নির্বাচনের ফল হয়েছিল ‘বিস্ময়কর’! আওয়ামী লীগ ও তার মিত্ররা পেয়েছিল ‘অস্বাভাবিক’ জয়। তেমনি বিএনপি ও তার মিত্রদের ঘটেছিল ‘অস্বাভাবিক’ পরাজয়! নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হয়েছিল। মানে, বিএনপিসহ সবাই নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল। দশম সংসদ নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হয়নি। কারণ বিএনপিসহ অনেক দলই নির্বাচন বর্জন করেছিল। তারপর সেই নির্বাচন শান্তিপূর্ণও হয়নি। জ্বালাও-পোড়াওসহ ব্যাপক সহিংসতা হয়েছে। কিন্তু নির্বাচন বন্ধ করা যায়নি। ওই বিতর্কিত নির্বাচনে গঠিত সরকার মেয়াদকাল পূর্ণ করতে পারবে না বলে মনে করা হলেও তা হয়নি। সরকার দাপটের সঙ্গেই মেয়াদ পূর্ণ করে নতুন নির্বাচনের আয়োজন করেছিল।

বর্তমান সরকার টানা তিনবার ক্ষমতায়। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে নির্বাচনের প্রাথমিক প্রস্তুতি শেষ। ৩০ জানুয়ারি ভোট গ্রহণ। নির্বাচন দিয়ে ক্ষমতাসীনদের জনপ্রিয়তা যাচাই করার সুযোগ আছে। কাজেই নির্বাচন সুষ্ঠু ও অবাধ হোক—সবাই এটাই চায়। প্রার্থীরা তাঁদের পরিকল্পনা, যোগ্যতা আর কর্মতৎপরতা দিয়ে জনগণের মন জয় করুন। শুধু কথাই নয়, কথার সঙ্গে কাজের সমন্বয় ঘটুক। ব্যালটযুদ্ধে গণতন্ত্রের দুয়ার উন্মোচিত হোক।

একটি দেশের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির কল্যাণের জন্য একটি অবাধ, সুষ্ঠু এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন একান্ত অপরিহার্য। প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতার পালাবদল হলে গণতন্ত্রের বিকাশ ঘটে। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের ভোটাররা আগামী পাঁচ বছরের জন্য মেয়র ও কাউন্সিলদের নির্বাচিত করবেন। এবারের নির্বাচনে সব রাজনৈতিক দলই প্রার্থী দিয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই আশা করা হচ্ছে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হবে নির্বাচন। শুধু দেশবাসী নয়, বিশ্ববাসী এ নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে আছে। আমরা গণতন্ত্রের শোক যাত্রায় আর শামিল হতে চাই না।

জনগণ নগরপিতা এবং স্থানীয় প্রতিনিধি বেছে নেওয়ার সুযোগ পাবেন এবং সেটা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায়, এটাই দেশের শান্তিপ্রিয় মানুষের আশা। স্বৈরাচার হটিয়ে গণতন্ত্রকামী মানুষ আশা করেছিল দেশ গণতন্ত্রের পথে হাঁটবে, গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি আরও শক্তিশালী হবে। কিন্তু দুর্ভাগ্য, মানুষের সে স্বপ্ন হোঁচট খেয়েছে বারবার।

রাজধানীর বনানী বিদ্যানিকেতন ভোটকেন্দ্রের সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তা গৌরাঙ্গ বৈরাগী এক প্রার্থীর পক্ষে ব্যালট পেপারে সিল মারছেন—এমন খবর পেয়ে দুপুরে সেখানে হাজির হন গণমাধ্যমকর্মীরা। এ সময় তিনি ব্যালট পেপার ফেলে দাঁড়িয়ে ক্ষমা চান। তখনো তাঁর টেবিলের সামনে পড়ে ছিল সিল মারা বেশ কিছু ব্যালট পেপার। ২০১৪ সালের নির্বাচনের ছবি।
রাজধানীর বনানী বিদ্যানিকেতন ভোটকেন্দ্রের সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তা গৌরাঙ্গ বৈরাগী এক প্রার্থীর পক্ষে ব্যালট পেপারে সিল মারছেন—এমন খবর পেয়ে দুপুরে সেখানে হাজির হন গণমাধ্যমকর্মীরা। এ সময় তিনি ব্যালট পেপার ফেলে দাঁড়িয়ে ক্ষমা চান। তখনো তাঁর টেবিলের সামনে পড়ে ছিল সিল মারা বেশ কিছু ব্যালট পেপার। ২০১৪ সালের নির্বাচনের ছবি।

আওয়ামী লীগের নেতারা যদি মনে করেন, বিএনপির রাজনীতি দেশের অধিকাংশ লোক পছন্দ করে না, তাহলে তাঁদের আর নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণার কোনো দরকার আছে কি? এমনিতেই ভোটের বাক্স উপচে পড়বে! তাহলে অহেতুক প্রার্থীর মনোনয়ন জমা দেওয়ার দিন থেকে কেন্দ্রীয় নেতাদের এত দৌড়ঝাঁপ করতে হবে কেন! প্রতিদ্বন্দ্বীর প্রতি শ্রদ্ধাশীল না হলে, জনরায়ে আস্থা রাখতে ব্যর্থ হলে সবচেয়ে বিপন্ন হয়ে পড়ে দেশের গণতন্ত্র। মুজিব বর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আমরা বলতে পারছি না, আমাদের গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য সমৃদ্ধ হচ্ছে!

ঢাকার সিটি নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার নিয়ে সর্বত্র আলোচনা হচ্ছে। বিরোধীদের দাবি মোতাবেক, ইভিএমে ভোট জালিয়াতি ও ভোট চুরির অফুরন্ত সুযোগ থাকবে না—এটি নিশ্চিত করে বলা যায় না। ইসি ও শাসক দল ইভিএমের পক্ষে ওকালতি করলেও বিরোধী দলগুলো ইভিএমের বিপক্ষে। বর্তমানে বিশ্বের ৯০ শতাংশ দেশে ইভিএম পদ্ধতি বাতিল করা হয়েছে। এমনকি পশ্চিমা দুনিয়ার কোনো আধুনিক ও উন্নত রাষ্ট্রে ইভিএম ব্যবহার করা হয় না। সারা বিশ্ব যখন ইভিএম পদ্ধতি নিয়ে উদ্বেগ–উৎকণ্ঠা প্রকাশ করছে, তখন নির্বাচন কমিশন ইভিএমের মাধ্যমে নির্বাচন কেন করতে যাচ্ছে, তা বোধগম্য নয়!

অতীতের নির্বাচনগুলোয় সরকারি দলের মহড়ার কারণে বিরোধী দলের প্রার্থীর এজেন্টরা কেন্দ্রে ঢুকতে পারেননি। এ অবস্থা এবারও বিদ্যমান থাকলে ইভিএমের জটিলতা আরও বাড়বে। ক্ষমতাসীন দলের অতি উৎসাহী মাসলম্যানরা বিরোধী প্রার্থীর ভোটারদের ইভিএমের বাটনে হাত দিতে দেবেন না। বলবেন, ‘আপনার কষ্ট করার দরকার নেই, আমরাই বাটন চেপে ভোট দিয়ে দিচ্ছি!’ নির্বাচনে পেশিশক্তির ব্যবহার হবে না—এমন গ্যারান্টি কি নির্বাচন কমিশন দিতে পারবে!

টিকাটুলীর কামরুন নেসা সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ে নির্বাচনী কর্মকর্তার কাছ থেকে ব্যালট পেপার নিয়ে তাঁর সামনেই জাল ভোট দিতে দেখা যায় ক্ষমতাসীন দলের কর্মীদের। ২০১৪ সালের ছবি। ছবি: প্রথম আলো
টিকাটুলীর কামরুন নেসা সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ে নির্বাচনী কর্মকর্তার কাছ থেকে ব্যালট পেপার নিয়ে তাঁর সামনেই জাল ভোট দিতে দেখা যায় ক্ষমতাসীন দলের কর্মীদের। ২০১৪ সালের ছবি। ছবি: প্রথম আলো

এ ছাড়া সর্বসাধারণের অস্বস্তি বাড়িয়ে দিয়েছে নির্বাচন নিয়ে রাজনীতিবিদদের কথাবার্তা। নেতাদের কথাবার্তা, আচার-আচরণে দায়িত্বশীলতার অভাব থাকা দুঃখজনক। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন নির্বাচন সামনে রেখে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের কাছে বলেছেন, ‘দেশের ৯০ শতাংশ মানুষ বিএনপির বিরুদ্ধে।’ এ ৯০ শতাংশ মানুষ এখন বিএনপিকে চায় না। আমরা মনে করি, বিএনপির বিরুদ্ধে ৯০ শতাংশ মানুষ, না আওয়ামী লীগের পক্ষে ৯০ শতাংশ, সেটি পরীক্ষার জন্য সিটি করপোরেশন নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হওয়া প্রয়োজন। এর আগে বিএনপির নেতারা সিটি করপোরেশন নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না বলে মন্তব্য করেছিলেন। দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না, এটি প্রমাণ করতেই তাঁরা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে যাচ্ছেন। জবাবে ওবায়দুল কাদের বলেছেন, বিএনপির নেতাদের বক্তব্য হাস্যকর। তাঁরা গণতন্ত্রের ভাষা বোঝেন না, তাঁরা আইন-আদালত কিছুই মানেন না। তাঁদের একমাত্র লক্ষ্য যেকোনো উপায়ে ক্ষমতায় যাওয়া এবং হত্যা, খুন এবং লুটপাটের রাজনীতি চর্চা করা।

ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের নির্বাচন কোনো জাতীয় নির্বাচন নয়। এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী পরাজিত হলে সরকারের পতন হবে না। বিএনপির প্রার্থী জিতলে তারাও সরকার গঠন করতে পারবে না। শুধু ঢাকার দুই সিটির নির্বাচন নয়, সব নির্বাচনকেই সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য দেখতে চায় মানুষ। কিন্তু দুর্ভাগ্য, দু-একটা নির্বাচন ছাড়া দীর্ঘদিন পর্যন্ত আর দেখা হয়ে ওঠেনি। রাজনৈতিক দলে গণতন্ত্রের চর্চা না থাকলে দেশে সঠিক গণতান্ত্রিক ধারা আশা করা যায় না। আজ পর্যন্ত কোনো রাজনৈতিক দলে মতপ্রকাশের বিধিবিধানের যথাযথ প্রয়োগ দেখতে পাওয়া যায়নি। দলগুলোর কেন্দ্রীয় কমিটিসহ সব কমিটিতে অগণতান্ত্রিক নেতৃত্ব! যেখানে গণতন্ত্রের গন্ধও পাওয়া যায় না। তবু আশা করে মানুষ। অন্ধকার সুড়ঙ্গের অপর প্রান্তে দেখতে চায় আলোর রশ্মি। জরাজীর্ণ অতীত আর সমস্যাসংকুল বর্তমানকে ভুলে আমরা একটি সুন্দর ভবিষ্যৎ চাই। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মহানগরবাসী তাঁদেরই নির্বাচিত করবেন, যাঁরা তাঁদের কাছে অধিকতর যোগ্য ও সমাদৃত বলে গণ্য হবেন। আমরা আশা করি, মহানগরবাসীর গণরায় যেন সুষ্ঠুভাবে প্রতিফলিত হয়। জনগণের দেওয়া রায় যেন ভূলুণ্ঠিত না হয়।

মোহাম্মদ আবু নোমান: কদমতলী, ঢাকা
[email protected]