সুখের স্মৃতিতে বান্দরবান

যেন মেঘ আর পাহাড় একসঙ্গে মিশেছে। ছবি: লেখক
যেন মেঘ আর পাহাড় একসঙ্গে মিশেছে। ছবি: লেখক

বেড়ানোটা রক্তের মধ্যে মিশে আছে। আর এটা আমরা পেয়েছি মায়ের কাছ থেকে। তখন তো রাস্তাঘাট উন্নত ছিল না। তাই বিভিন্ন শহরে বেড়াতে যাওয়া কল্পনাই করা যেত না। তাই নিজ শহরের মধ্যে যে আত্মীয়স্বজন থাকতেন, মূলত এরা নিজেদের মধ্যে সুন্দর একটা যোগাযোগ রাখতেন। ছোটবেলায় দেখেছি, প্রায়ই মা রাতে সবাইকে খাইয়েদাইয়ে লন্ঠন হাতে করে আমাদের সব ভাইবোনকে নিয়ে আমাদের বাড়ির আশপাশে মায়ের যেসব চাচা–ফুপুরা থাকতেন, তাঁদের বাসায় বেড়াতে যেতেন। আব্বা অবশ্য রাতে বেড়ানো একদম পছন্দ করতেন না। তবে মা এ বিষয়টিকে মোটেই পাত্তা দিতেন না। এসব কথা লিখলাম এ কথাটা বোঝাতে যে কীভাবে আমরা বেড়ানোর অভ্যাস পেলাম।

আমার ঠিক ওপরের বোন তাহমিদা। ওর অর্কিড নিয়ে পাগলামী সীমার বাইরে। এবার দেশে এসে ওর অর্কিডের নেশার সঙ্গে আমিও যুক্ত হয়েছি। আমি ফুল ভালোবাসি। তবে বাগান বানিয়ে ফুলের সেবা করা আমার কাছে কষ্টকর মনে হয়। তবে ইনডোর প্ল্যান্ট আমি পছন্দ করি। তবে ফুল কেই–বা না ভালোবাসে! আর অর্কিডের সৌন্দর্য দেখলে যে কেউ এর প্রেমে পড়ে যাবে।

তাহমিদা বাংলাদেশ অর্কিড সোসাইটির একজন সদস্য। ওর সঙ্গী ডা. এলা ওই সোসাইটির জেনারেল সেক্রেটারি। আর এলা আপা আরেক অর্কিড–পাগল মানুষ। অর্কিড সম্পর্কে ওদের ক্রেজি বললে অত্যুক্তি হবে না।

তাঁরা পরিকল্পনা করেছিল, পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন নার্সারি ঘুরে বিভিন্ন প্রজাতির অর্কিড সংগ্রহ করবেন। সেই মতো তাঁরা অর্কিড সংগ্রহ করে বেড়াচ্ছেন। আমি ওদের সঙ্গী মাত্র। বেড়ানোতে আমার অতীব আগ্রহ। তাই নিজে যেচে সঙ্গী হিসেবে যোগ দিয়েছি। এই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ইতিমধ্যে আমরা ঘুরে এসেছি ভালুকার দীপ্ত নার্সারি, শাহবাজপুরের ক্যামেলিয়া ফাউন্ডেশন। দেশে এখন কীভাবে যে অর্কিড চাষ হচ্ছে, তা না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। এরই অংশ হিসেবে আমাদের এবারের যাত্রা ছিল বান্দরবান।

উঁচু পাহাড়ে বসে প্রকৃতি দেখার ব্যবস্থা আছে বান্দরবানে। ছবি: লেখক
উঁচু পাহাড়ে বসে প্রকৃতি দেখার ব্যবস্থা আছে বান্দরবানে। ছবি: লেখক

প্রথম আলোর সাপ্লিমেন্টগুলোতে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বিষয়ের ওপর লেখা ছাপা হয়। এ রকম একটা লেখা ছাপা হয়েছিল একজন অর্কিডপ্রেমীর সংগ্রহের ওপরে। অর্কিডপ্রেমী এ ব্যক্তি স্কুলের প্রধান শিক্ষক। তাঁর কর্মক্ষেত্র রুমা থানার একটি সরকারি প্রাথমিক স্কুলে। বান্দরবান শহরে তাঁর স্ত্রী–সন্তানেরা থাকেন। তাহমিদা সেটা পড়ে মাথায় রেখেছে। এরই ফলে বান্দরবানে অর্কিড সংগ্রহের পরিকল্পনা।

ব্যস মহা উৎসাহে আমরা নেমে পড়লাম দিন–তারিখ ঠিক করে। এলা আপাকে ছুটির ব্যবস্থা করতে হবে। তিনি বারডেমে চাকরি করেন। তাই ঠিক হলো ২৫ ডিসেম্বর ভালো সময়। ২৬ তারিখ ছুটি নিলে পরের দিন শুক্রবার তাহলে ওই সময়ের মধ্যে অনেক কিছু দেখা যাবে। অর্কিডের খোঁজ করা হবে আর বান্দরবানও দেখা হবে। কারণ, আমাদের মধ্যে এযাবৎ কেউ বান্দরবান যাননি। যেই ভাবা, সেই কাজ শুরু হয়ে গেল। তাহমিদা এদিক–সেদিক ফোন করতে থাকলেন। কোনো বাস ভালো কোনটা নয়। নন–এসি, না এসি—সেটাও একটা ভাবনার বিষয়। কোন কোম্পানির বাস ভালো। কারণ, আমরা শুধু মেয়েরা যাব। তাহমিদা ডা. এলার সঙ্গে কথা বলে শ্যামলী পরিবহনের রাতের নন–এসি বাসের পাঁচটি টিকিট কিনে রাখলেন। এ বিষয়ে আমার দেবর শাহেদ এবং তাঁর এক আত্মীয় সাহায্য করেছিল। কিন্তু দুদিন পরে এলা আপা বললেন যে তিনি নন এসি বাসে যাবেন না। তাঁদের জন্য আবার এসি বাসের টিকিট কেনা হলো। আর নন–এসি বাসের টিকিটগুলো বাস কোম্পানি বিক্রয় করার ব্যবস্থা করবের বলে কথা দিলেন।

আমাদের যাত্রা আর একসঙ্গে হলো না। ছেলেমেয়েকে নিয়ে এলা আপা যাত্রা করলেন ২৪ তারিখ সকাল ১০টার শ্যামলীর বাসে। আর আমরা রওনা দিলাম ২৪ তারিখ রাত পৌনে ১১টার শ্যামলী নন–এসি বাসে। বাস ছাড়তে ছাড়তে রাত একটা। রাতের বাসে যাওয়াতে পথের ধারের সৌন্দর্য একটুও উপভোগ করতে পারিনি। আর ঘুমেরও ব্যাঘাত হয়েছিল। পণ করা হলো আর রাতের যাত্রা করব না।

বান্দরবানের পুরো ম্যাপ এখানে পাবেন। ছবি: লেখক
বান্দরবানের পুরো ম্যাপ এখানে পাবেন। ছবি: লেখক

পথে বাসটা একবার থেমেছিল খাবারের জন্য। তবে খুব বেশি স্পিডে নয়, ধীর লয়ে একতালে চালিয়ে আমাদের বান্দরবান নিয়ে পৌঁছাতে পেরেছিল। বাস থেকেই আমরা আমাদের গন্তব্য হোটেল হিল ভিউ দেখতে পেলাম। হোটেলে পৌঁছে দেখি রুম তখনো খালি হয়নি। যাঁরা আছেন, তাঁরা কিছুক্ষণর মধ্যে রুম ছাড়বেন। পরিষ্কার হবে, এরপর আমরা পাব।

ট্যুরিস্ট সিজন। এর ওপর হোটেলটি বাসস্ট্যান্ড–সংলগ্ন হওয়ায় প্রতিদিনই প্রচুর লোকের সমাগম হয়। হোটেলটি থ্রিস্টার। ভেতরের ব্যবস্থা ভালো, খাবারও মানসম্মত। শহরের ঠিক মাঝখানে এর অবস্থান। হোটেলটির ঠিক সামনেই বিশাল পাহাড়। পাহাড়ের গায়ে লম্বা টুকরা টুকরা বাঁশের মধ্যে গাঁদা ফুলের গাছ লাগানো হয়েছে। তাতে বিভিন্ন রঙের গাঁদা ফুল ফুটে হোটেলের সৌন্দর্যকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। পাহাড়ের সৌন্দর্যকেও।

তো সেদিন আমরা কক্ষ না পেয়ে নাশতা শেষ করে এলা আপার ঘরে আমাদের মালপত্র রেখে হাতমুখ ধুয়ে তৈরি হয়ে নিলাম। এলা আপা তাঁর পরিচিত লোক দিয়ে আগে থেকেই চাঁদের গাড়ি ঠিক করে রেখেছিলেন। আমাদের বান্দরবানের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখার যাত্রা শুরু হলো।

বান্দরবানে গেলে স্বর্ণমন্দির সবারই ঘোরা উচিত। ছবি: লেখক
বান্দরবানে গেলে স্বর্ণমন্দির সবারই ঘোরা উচিত। ছবি: লেখক

প্রথম দিন ছিল নীলগিরি, চিম্বুক পাহাড়, জলপ্রপাত, স্বর্ণমন্দির আর স্থানীয় বাজার পরিদর্শন। মাহিন্দ্রার জিপে করে আমরা যখন বান্দরবানের রাস্তায় প্রবেশ করলাম, তখন এক অদ্ভুত অনুভূতি। পাহাড়, সমুদ্র, নদী—এগুলো সমতলের মানুষকে কাছে টানে, আকৃষ্ট করে। অভিভূত করে তোলে। আঁকাবাঁকা পথে সবুজের মধ্য দিয়ে যেতে যেতে আমরা প্রকৃতির মাঝে নিজেদের হারিয়ে ফেলেছিলাম। মাটি আর প্রকৃতির সোঁদা গন্ধ মনকে উদাস করে তুলেছিল। পাহাড়ের এই সবুজের মাঝ দিয়ে চলার পথ একসময় ফুরিয়ে গিয়ে আমরা নীলগিরির দেখা পেলাম। আহা! কী মনোরম, নয়নাভিরাম দৃশ্য। পরিষ্কার বাতাস। প্রাণভরে সবাই নিশ্বাস নিলাম। ঢাকা শহরে গিয়ে তো আর এ রকম বিশুদ্ধ বাতাস পাব না। নীলগিরি ক্যাফেতে মুরগি বিরিয়ানি দিয়ে দুপুরের খাবার খেয়ে আর নীলগিরির মৃদুমন্দ শীতল বাতাস গায়ে মেখে, নীলগিরিকে আবার আসার প্রতিশ্রুতি দিয়ে আমরা আবার সেই মনভোলানো পাহাড়ি পথ ধরলাম।

পরের গন্তব্য চিম্বুক পাহাড়। সেই ছোটবেলা থেকে শুনতে শুনতে চিম্বুক পাহাড় নিয়ে এক অন্য রকম চিত্র মনে আঁকা রয়েছিল। এবার সে চিম্বুককে দেখে হতাশ হয়েছি। হেলিপ্যাড আর ইট সুরকির দালান নিয়ে এ এক অন্য চিম্বুক। কল্পনার সঙ্গে মেলাতে পারিনি।

পথে পড়েছিল রিঝুক জলপ্রপাত। কিন্তু শীত মৌসুমে পানির ধারা কমে যায়, তা ঝরনার সে সৌন্দর্য প্রতিভাত হয় না। তাই আমরা সেখানে সময় না দিয়ে বৌদ্ধদের স্বর্ণমন্দিরের দিকে পা বাড়ালাম। এদিকে সন্ধ্যাও ঘনিয়ে আসছিল।

স্বর্ণমন্দিরটি পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত। মন্দির থেকে বান্দরবান শহরের প্রায় সবটাই দেখা যায় এবং সেটাও এক নয়নাভিরাম দৃশ্য। তবে প্রকৃতির ডাক পেলে খবর আছে। পাহাড়ের চূড়ায় মন্দির তো পাহাড়ের নিচে টয়লেট। তখন দিনের আলো বলতে নেই। তাই আমরা আর সেখানে সময় ব্যয় না করে সোজা হোটেলে ফিরে এলাম। রাতজাগা ভ্রমণ, সারা দিন পাহাড়ে ওঠা–নামার কারণে সবার ওপর দিয়ে বেশ একটা ধকল গিয়েছিল। তাই সবাই হোটেলে ফেরার তাগিদ বোধ করছিলাম। চাঁদের গাড়ি আমাদের হোটেলে নামিয়ে দিয়ে চলে গেল।

পাহাড়ে এমন দৃশ্য সব সময় দেখা মেলে। ছবি: লেখক
পাহাড়ে এমন দৃশ্য সব সময় দেখা মেলে। ছবি: লেখক

রাতজাগা যাত্রায় সারা দিন খুব খারাপ কেটেছে। কেমন যেন ঘুম ঘুম ভাব। ঘুমিয়ে ঘুমিয়েই রাস্তা পার করেছি। আগামীকাল আমাদের থানচি যাওয়ার প্ল্যান। টরোন্টে আসব বলে পরের দিনে আমার সেই ৮৯ কিলোমিটার থানচি যাওয়ার পরিকল্পনা বাদ দিলাম। এলা আপা তাঁর ছেলেমেয়ে নিয়ে অনেক ভোরে থানচি রওনা দেবেন ঠিক হলো। আমাদের সঙ্গে রুটি আর আপেল ছিল। তাই সকালে অনেক দেরি করে ঘুম থেকে উঠে নাশতা ঘরেই সেরে নিয়ে তাহমিদা ও আমি একটা সিএনজি সারা দিনের জন্য ভাড়া নিয়ে বান্দরবান শহরটাকে ঘুরেফিরে দেখার প্ল্যান করলাম। একজন তরুণ সিএনজিচালিত অটোরিকশার চালকও পেয়েও গেলাম। চালক স্থানীয় এবং এদের ভাষা জানে। বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত সে আমাদের নীলাচল, মেঘলা পার্ক ছাড়াও সুন্দর সুন্দর অন্য জায়গা ঘোরাবে। আর যেহেতু স্থানীয়, তাই আমাদের সেই অর্কিডপ্রেমী শিক্ষকের কাছে নিয়ে যাবেন।

আমাদের যাত্রা শুরু হলো শিক্ষককে খুঁজে বের করা নিয়ে। যে প্রতিবেদনটি কাগজে প্রকাশিত হয়েছিল, তাতে তাঁর শুধু পাড়ার নাম দেওয়া ছিল। বাড়ির কোনো কিছু ছিল না। তাই স্থানীয় লোকের সাহায্যের প্রয়োজন ছিল। এই সিএনজিচালিত অটোরিকশাচালক আমাদের পথপ্রদর্শক হলেন। রাস্তার দোকানে জিজ্ঞাসা করাতে সহজেই লোকে চিনে ফেললেন শিক্ষককে। সহজেই তার বাড়ি খুঁজে পাওয়া গেল।

পাহাড়ে বাঁশ ও শণ দিয়ে ছোট এই ঘরে মাটির ঘটে রাখা আছে পানি। উঁচু পাহাড়ে উঠতে উঠতে পিপাসা নিবারণের জন্য এ ব্যবস্থা। ছবি: লেখক
পাহাড়ে বাঁশ ও শণ দিয়ে ছোট এই ঘরে মাটির ঘটে রাখা আছে পানি। উঁচু পাহাড়ে উঠতে উঠতে পিপাসা নিবারণের জন্য এ ব্যবস্থা। ছবি: লেখক

শিক্ষকের বাসা একটা উঁচু টিলার ওপর। ওপরে ওঠার পায়ে চলার পথের দুই পাশে অর্কিড আর বিভিন্ন প্রজাতির গাছ ঝুলে আছে। ঘরের পেছনে আসল অর্কিডের শেড। কত প্রজাতির যে অর্কিড সেখানে আছে, তা না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। স্থানীয় প্রজাতির অর্কিডের সংখ্যাই বেশি। প্রতিবেশী দেশ থেকে এনেছেন। পরিবারের সবাই এই অর্কিড চাষের সঙ্গে জড়িয়ে আছেন। অর্কিড বেঁচে যে অর্থ তিনি পান, তা দিয়ে ২৬ জন অনাথের ব্যয় বহন করেন। তাদের লেখাপড়ার আর খাওয়া বাবদ ব্যয় করেন এ অর্থ। এতে ঘাটতি হলে বাকিটা তিনি তাঁর বেতনের টাকা থেকে মেটান। তাঁর স্ত্রী বাড়ি বাড়ি বিনা মূল্যে মুরগির টিকা দিয়ে থাকেন। তিনি এই কাজটি ইউএনডিপির থেকে শিখেছেন। আর বাড়িতে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সাহায্যার্থে একটি নার্সারি স্কুল চালান। এর জন্য তিনি কিছু পারিশ্রমিকও পান। পাহাড়ের ওপরের জমিটি তাঁদের নিজস্ব। তাঁর সঙ্গে বেশ কিছু সময় কাটিয়ে, আতিথেয়তা সেরে আমরা আমাদের মূল পরিকল্পনামতো যাত্রা শুরু করলাম।

প্রথমেই মেঘলা পার্ক। কৃত্রিম লেক বানিয়ে সেখানে প্যাডল বোট নামানো হয়েছে। লেকের ওপরে ঝুলন্ত সেতু। আছে কেবল কার। বিস্তীর্ণ জায়গাজুড়ে উপভোগ করার মতো অনেক উপাদান। আমরা শুধু কেবল কারে চড়লাম। লেকের দুই ধারে সবুজ বনানী। বসে থেকে বুক ভরে সবুজ প্রকৃতির স্বাদ নিয়ে আবার আমরা পথে নামলাম। এবারের গন্তব্য নীলাচল।

নীলাচল যেতে এক মজার ঘটনা ঘটল। আমার বোন আর আমি দুজনই ষাটোর্ধ্ব। তাই মাথার চুলে পাক ধরেছে। নীলাচলে প্রবেশের আগে আমাদের সিএনজিচালিত চালককে যখন টাকা দিতে নেমেছে, তখন টোল স্টেশনের দুজন যুবক এসে আমার বোনকে বলেন, দাদি, আপনার বয়স কত? পাহাড়ে হাঁটতে পারবেন তো? খালাম্মা নয়, সোজাসুজি দাদি। এখানে দাদি ডাকটি খুবই প্রচলিত। মজাই লাগছিল। এত দিন তো সবখানে খালাম্ম শুনেছি।

পাহাড়ে এমন দোকানের দেখা মেলে মাঝেমধ্যে। ছবি: লেখক
পাহাড়ে এমন দোকানের দেখা মেলে মাঝেমধ্যে। ছবি: লেখক


পাহাড়ের মাথায় ইংরেজি অনলাইন স্কুল
নীলাচল যেতে চারদিক মেঘলা হয়ে এল। কেমন যেন মন খারাপ ভাব। মেঘলা দিন দেখলে আমি বেশ ডিপ্রেসড হয়ে যাই। নীলাচলের পাহাড় থেকে দূরের বান্দরবান দেখে পাহাড় থেকে নেমে এলাম। দুপুরের খাবার পার্কের বাইরের এক রেস্তোরাঁয় খেয়ে শহরের পথ ধরলাম। পাহাড় থেকে নামতে নামতে আমাদের ‘পাইলট’ এক জায়গা দেখার জন্য অন্য পথ ধরলেন। কখনো ধারণা করতে পারিনি আমাদের সামনে এক বিস্ময় আসছে। সিএনজি তখন পাহাড়ের গা বেয়ে এক সরু পথ ধরেছে। যে পথে দুটি বাহন একসঙ্গে চলতে পারে না। কখনো দুই পাহাড়ের মাঝে, কখনো বা এক পাশে উঁচু পাহাড়, আরেক পাশে গভীর খাদ, কখনো মেঠো পথ, কখনো ভাঙা কংক্রিটের পথ, কখনো হেরিংবোন, দুহাতে শক্ত করে সিএনজির রড ধরে খোদাকে স্মরণ করছি। একটু এদিক–ওদিক হলে পপাত ধরণিতল। আর জীবন নিয়ে ফিরে আসতে হবে না। পুরোটা পাহাড় জনমানবহীন। কোনো জনবসতি চোখে পড়ল না। আর এদিকে আমরা উঠছি তো উঠছি। সিএনজিটা যখন শেষমেশ এক পাহাড়ের চূড়ায় এসে থামল, আমরা তখন বাক্‌হারা। এত বিস্ময় আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পারিনি। এই নির্জন অনেক উঁচু পাহাড়ের মাথায় ইংরেজি ভাষায় পরিচালিত এক অনলাইন স্কুল। পাহাড়ের গোড়ায় বাঁশ ও শণ দিয়ে ছোট এক ঘর বানিয়ে তাতে দুটি মাটির ঘটে পানি ঢাকা দেওয়া। পানি পান করার জন্য রশি দিয়ে ছোট দুটি মাটির গ্লাস ঝোলানো। উঁচু পাহাড়ে উঠতে উঠতে পিপাসা নিবারণের জন্য এই ব্যবস্থা। কত ফুট উঁচু পাহাড় কে জানে। তাকিয়ে দেখি গভীর খাদ আর সবুজ আর সবুজ। সে সবুজও কত প্রকারের। মনটা জুড়িয়ে গেল। অবাক হওয়ার আরও যে বাকি ছিল তা বুঝিনি। সিএনজি আবার চলা শুরু করল। আরও খানিকটা খাড়া পথ যাওয়ার পর সিএনজিচালিত অটোরিকশা আরও এক উঁচু পাহাড়ের পাদদেশে এসে দাঁড়াল।

পাহাড়ের গা ঘেঁষেই বোম জাতির বসবাস। পরিপূর্ণ গৃহস্থালি। সুস্থ ছয়টি ছাগল বেড়ার সঙ্গে বাঁধা তাজা কলাপাতা চিবুচ্ছে। দুটি টার্কি পরীক্ষামূলকভাবে পোষা হচ্ছে। ছোট একটা চায়ের দোকান। সেখানে ছোট সাইজের তিনটি টেবিলে পরিষ্কার প্লাস্টিকের কাপড় বিছানো। দোকানের এক কোনায় রকমারি পণ্য। বসার জন্য বেঞ্চ পাতা। চা খেতে চাইলাম। কিন্তু বানাতে দেরি হবে বলে চা বাতিল হলো। তবে তরতাজা বেশ কিছু কলা কেনা হলো। দোকানের মালিক ও তাঁর পরিবারের সঙ্গে কিছু সময় কাটিয়ে আবার আমরা ধরলাম ফিরে আসার পথ।

পাহাড়ে বোমদের বাড়িতে টার্কি পরীক্ষামূলকভাবে পোষা হচ্ছে। ছবি: লেখক
পাহাড়ে বোমদের বাড়িতে টার্কি পরীক্ষামূলকভাবে পোষা হচ্ছে। ছবি: লেখক

এত উঁচুতে পানি পেতে অনেক কষ্ট। কীভাবে এরা জীবনধারণ করে ভাবতে অবাক লাগে। পাহাড়ি পথে ওপরে উঠতে যত কষ্ট, নামতে তত নয়। অনেক কম সময়ের মধ্যে আমরা আবার সেই চড়াই–উতরাই পেরিয়ে সমতলে এসে হাজির। যথারীতি সিএনজির পাইলট আমাদের বান্দরবানের প্রায় সারা শহর ঘুরিয়ে দেখিয়েছেন। এশিয়ান হাইওয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে চওড়া রাস্তা তৈরি হচ্ছে। সর্বত্র উন্নয়নের ছাপ পরিলক্ষিত হলো। অনেক রাত অবধি আমরা বেড়িয়েছি। কিন্তু নিরাপত্তার অভাব বোধ করিনি। শহরটাও বেশ পরিচ্ছন্ন।

আমাদের বেড়ানোর সময় শেষ। সিএনজি পাইলটকে বললাম আমাদের বার্মিজ বাজারে নামিয়ে দিতে। সেখানে পার্বত্যবাসীর হাতে বানানো জিনিসপত্র দেখে অল্প কিছু কিনে হোটেলের দিকে পা বাড়ালাম। পথে দু–এক ফোঁটা বৃষ্টি নিয়ে রিকশাভাড়া মিটিয়ে রুমের দিকে রওনা হলাম। তখন সন্ধ্যা ছয়টা।

আমাদের বাস রাত নয়টায়। তাই হাতে অনেকটা সময়। বাসস্ট্যান্ড হোটেলের ঠিক পাশেই। তাই আমাদের কোনো তাড়াহুড়া নেই। আমরা হোটেলের নিচে স্থানীয় অধিবাসীদের দোকান ঘুরে আমাদের অলস সময় পার করতে থাকলাম। একসময় তা–ও ফুরিয়ে এল। হোটেল ডাইনিংয়ের খাবার খেয়ে এলা আপাদের বিদায় জানিয়ে বাস ধরতে রওনা হলাম।

‘দেখিতে গিয়েছি পর্বতমালা,/ দেখিতে গিয়েছি সিন্ধু।/
দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া/ ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া/ একটি ধানের শিষের উপরে/ একটি শিশিরবিন্দু।’

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতার এই পঙ্‌ক্তিগুলো আমার জীবনে একেবারে সত্যি। ১৯৭৯ সাল থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত ভারতের জয়পুর, কাশ্মীর, মুম্বাই, দার্জিলিং, সম্প্রতি কানাডার আটলান্টিক ঘুরে দেখেছি। কিন্তু আমার দেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এগুলোর চেয়ে কোনো অংশে কম নয়—এ কথা বুঝতে পারলাম ৪০টি বছর। বান্দরবানের প্রকৃতির যে সোঁদা গন্ধ, তা আপনি আর কোথায়ও খুঁজে পাবেন না।