'জিতই আবা দিয়া গুটি ধররে হেইও...'

‘হুমগুটি’ নিয়ে মাঠে যাচ্ছেন গতবারের বিজয়ীরা। ছবি: লেখক
‘হুমগুটি’ নিয়ে মাঠে যাচ্ছেন গতবারের বিজয়ীরা। ছবি: লেখক

জনশ্রুতি আছে, প্রজাদের শক্তি পরীক্ষার জন্য নাকি জমিদারেরা একটি খেলার প্রচলন করেছিলেন, যার স্থানীয় নাম ‘হুমগুটি’ খেলা। কোন এলাকার মানুষের শক্তি কত বেশি, কোন এলাকায় রয়েছে পরগনার সবচেয়ে শক্তিশালী পালোয়ানেরা, তা জানা যায় এ খেলায়।

হুমগুটি হচ্ছে পিতলের তৈরি ৪০ কেজি ওজনের গোলাকার একটি বস্তু। এ বস্তু নিয়ে হাজারো মানুষ কাড়াকাড়িতে মেতে থাকে। সবার মুখে উচ্চারিত হয়, ‘জিতই আবা দিয়া গুটি ধররে হেইও...’

ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলার দেওখোলা ইউনিয়নের লক্ষ্মীপুরের বড়ইআটায় জমিদার আমলের গুটি খেলা গত মঙ্গলবার বিকেল সাড়ে চারটায় শুরু হয়।

খেলায় ঢাকঢোল পিটিয়ে নিজেদের শক্তি পরীক্ষায় জন্য খণ্ডে খণ্ডে বিভক্ত হয়ে শতাধিক খেলোয়াড়ের দল গুটি নিয়ে কাড়াকাড়ি শুরু করে। খেলা শুরু হয় উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব ও পশ্চিমে বিভক্ত হয়ে। রাত যত গভীর হয়, খেলা ততই জমে ওঠে। এবারের খেলাটি ছিল ২৬১তম।

ময়মনসিংহ জেলা পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান মমতাজ উদ্দিন লক্ষ্মীপুর গ্রামের মণ্ডলবাড়ি থেকে গুটি খেলার উদ্বোধন করেন। উদ্বোধনের পর দল বেঁধে গুটি নিয়ে যাওয়া হয় তালুক-পরগনা সীমানায় বড়ইআটা নামক স্থানে। সেখানে এক মণ ওজনের পিতলের গুটি নিয়ে খেলোয়াড়দের মধ্যে শুরু হয় টানাটানি–কাড়াকাড়ি।

খেলতে আসা জোরবাড়িয়া গ্রামের বারেক জানান, তাঁরা দল বেঁধে খেলতে এসেছেন। গতবারও তাঁরা খেলেছিলেন। কিন্তু গতবার গুটি নিয়ে গিয়েছিল অন্য দল। এবার তাঁরা গুটি নেওয়ার চেষ্টা করবেন।

গুটি সংরক্ষণকারী মণ্ডল পরিবারের এ বি ছিদ্দিক জানান, খেলায় কোনো পুরস্কারের ব্যবস্থা না থাকলেও প্রতিবছর লক্ষাধিক দর্শকের সমাগম হয়। কখন খেলায় শেষ হবে, তা জানতে চাইলে তিনি বলেন, তা সঠিক করে বলা মুশকিল। তবে গভীর রাত পর্যন্ত খেলা চলে, আবার কয়েক দিন ধরেও খেলা চলতে থাকে।

মাথার ওপর এক মণ ওজনের পিতলের হুমগুটি নিয়ে খেলছেন খেলোয়াড়েরা। আসলে তাঁরা খেলোয়াড় ও পালোয়ান। ছবি: লেখক
মাথার ওপর এক মণ ওজনের পিতলের হুমগুটি নিয়ে খেলছেন খেলোয়াড়েরা। আসলে তাঁরা খেলোয়াড় ও পালোয়ান। ছবি: লেখক

ব্যাপক উৎসাহ–উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠিত হয় ফুলবাড়িয়ার ঐতিহ্যবাহী হুমগুটি খেলার। হাড়কাঁপানো শীত উপেক্ষা করে এবারও অংশগ্রহণকারী খেলোয়াড় ও লাখো দর্শকের উপচেপড়া ভিড় ছিল। খেলাকে কেন্দ্র করে উপজেলার লক্ষ্মীপুর, দেওখো, বালিয়ান, ফুলবাড়িয়া, কাতলাসেনসহ পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলোয় দুদিন আগে থেকেই খেলার দিন পর্যন্ত চলে উৎসবের আমেজ।

কথিত আছে, মুক্তাগাছার জমিদার শশীকান্তের সঙ্গে ত্রিশালের বৈলরের জমিদার হেমচন্দ্র রায়ের জমির পরিমাপ নিয়ে বিরোধ সৃষ্টি হলে দুই জমিদার তাঁদের প্রজাদের মধ্যে শক্তি পরীক্ষা ও জমির পরিমাপের বিষয় নিয়ে সৃষ্ট বিরোধ মীমাংসাকল্পে এমন অদ্ভুত খেলার প্রচলন করেন। উপজেলা সদর থেকে ৫ কিলোমিটার উত্তরে লক্ষ্মীপুর ও ১০ মাইলের মাঝামাঝি বড়ইআটা বন্ধ নামক বড় মাঠ হলো খেলার কেন্দ্রস্থল। জায়গাটি মুক্তাগাছা-ত্রিশাল জমিদার আমলে তালুক (৯ শতাংশে ১ কাঠা) বনাম পরগনার (সাড়ে ৬ শতাংশে ১ কাঠা) সীমানা ছিল।

স্থানীয় মোড়ল পরিবার ধারাবাহিকভাবে প্রতিবছর পৌষের শেষ বিকেলে হুমগুটি খেলা চালিয়ে আসছে বলে জানিয়েছেন মোড়ল পরিবারের কাদু মোড়ল (৫৫)।

পৌষ মাসের শেষ দিনকে ফুলবাড়িয়া উপজেলায় আঞ্চলিক ভাষায় বলা হয় পুহুরা। এ দিনেই অনুষ্ঠিত হচ্ছে হুমগুটি খেলা। উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব ও পশ্চিম ভাগ-বাঁটোয়ারা করে খেলা শুরু হলেও পরে আর কোনো দিক থাকে না খেলোয়াড়দের। পিতলের গুটি মাঠে আসার পরই এর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে হাজারো জনতা। টানাহেঁচড়া–ধাক্কাধাক্কি সবই হয় এ খেলায়। অনেক সময় এই খেলায় অংশ নিতে এসে পদদলিত হয়ে মারাও গেছে অনেকে। তবু গ্রামের মানুষ এ ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে এখনো বিনোদনের খোরাকের পাশাপাশি কোন ইউনিয়নের মানুষ বেশি শক্তিশালী, সেই পরীক্ষায় নামে।

হুমগুটি খেলোয়াড় ৮৫ বছর বয়স্ক ওমর আলী চৌধুরী বলেন, তিনি ৬৫ বছর ধরে প্রতিবছর পৌষের এই দিনে খেলেছেন। এখন বয়সের ভারে আর খেলতে পারেন না। তবে এই খেলা দেখার জন্য প্রতিবছর ছুটে আসেন। খেলোয়াড়দের তিনি শেখান নানা কৌশল।

হুমগুটির ২৬১তম খেলার আসরে দর্শকের ভিড়। ছবি: লেখক
হুমগুটির ২৬১তম খেলার আসরে দর্শকের ভিড়। ছবি: লেখক

অপর খেলোয়াড় বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত ডেপুটি রেজিস্ট্রার আবদুল খালেক জানান, হুমগুটি খেলা হলো পাবলিক খেলা। তাঁর বাপ–দাদারা এ খেলা খেলেছেন। খেলায় বিজয়ী হওয়ার জন্য বিভিন্ন গ্রামের শত শত মানুষ জড়ো হয়। হুমগুটি খেলা কখনো কখনো এক দিনের বেশি চলে। টানা তিন দিন খেলা চলার রেকর্ড রয়েছে বলে তিনি জানান। তবে কয়েক বছর ধরে খেলাটি চলে গভীর রাত পর্যন্ত।

বিকেল সোয়া চারটায় খেলা শুরু হয় এ বছর। এবারও ময়মনসিংহ সদর, মুক্তাগাছা, ত্রিশাল ও ফুলবাড়িয়া উপজেলার খেলোয়াড়েরা এসেছিলেন। লক্ষ্মীপুরের বড়ইআটায় এ খেলা শুরু হলেও কখনো কখনো খেলাটি ছড়িয়ে পড়ে পাঁচ থেকে আট কিলোমিটার দূরে গ্রামের মানুষের মধ্যে। প্রতি ঘণ্টায় খেলাটির রূপ বদলায়। আর রাতের খেলার দৃশ্য যেন অন্য রকম। হাজারো টর্চলাইটের আলোয় যেন এক অপরূপ দৃশ্য। আজও ফুলবাড়িয়ার মানুষ এ খেলা খেলে নেহাত আনন্দের জন্যই। খেলার জন্য নানা গ্রামের মানুষের মধ্যে কিছুদিনের জন্য হলেও ভ্রাতৃত্ববোধ ও আত্মীয়তা বাড়ে। এটাই–বা কম কিসের। তা ছাড়া খেলাকে কেন্দ্র করে লক্ষ্মীপুরসহ আশপাশের গ্রামগুলোয় মেহমানদের ভিড় বেড়ে যায়। নাইওর আসে বউ-ঝিরা, বাড়ি বাড়ি ধুম পড়ে খাওয়াদাওয়ার। খেলায় যে ইউনিয়নের লোকেরা হুমগুটি ঘরে নিয়ে যেতে পারে, তাদের জন্য ভোজের ব্যবস্থা করেন ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান।

মঙ্গলবার বিকেল চারটায় খেলা শুরু হয়। কয়েক ঘণ্টা খেলা চলার পরে হুমগুটি পাওয়া যায় পার্শ্ববর্তী ফুলবাড়িয়া ইউনিয়নের কালাকান্দা গ্রামে। ফুলবাড়িয়া ইউপির চেয়ারম্যান জয়নাল আবেদীন বলেন, ‘এবার প্রথমবারের মতো আমি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছি। খেলায় আমাদের ইউনিয়নের পালোয়ানেরা হুমগুটি ছিনিয়ে আনেন। এ জন্য আমি খুব আনন্দিত। এমন সাহসী মানুষের পাশে থাকতে পেরে খুব ভালো লাগছে।’

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করছেন, বর্তমান সময়ে মাদকের ভয়াল থাবা যুবসমাজকে ধ্বংস করে দিচ্ছে, কমে যাচ্ছে মাঠ। বিনোদনের কসরতগুলো হারিয়ে যাচ্ছে মানুষের অস্তিত্ব থেকে। তাই শুধু ফুলবাড়িয়া না, এই হুমগুটি খোলার মতো আরও অনেক ঐতিহ্যবাহী খেলা আছে, যা প্রত্যন্ত অঞ্চলে বিখ্যাত। সেসব খেলাকে সদর্পে টিকিয়ে রাখতে সামাজিক সংগঠনের পাশাপাশি সরকারেরও উদ্যোগ নেওয়া উচিত।