পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সন্ধ্যাকালীন কোর্স বন্ধের অপ্রাসঙ্গিকতা প্রসঙ্গে

অনেকেই চান সন্ধ্যাকালীন কোর্সের পড়া পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বন্ধ করা হোক। ছবি: সংগৃহীত
অনেকেই চান সন্ধ্যাকালীন কোর্সের পড়া পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বন্ধ করা হোক। ছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি একজন অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ এবং চিন্তক। বহুবছর টানা সফল রাজনীতির পর তিনি জাতীয় সংসদের স্পিকারের আসন এবং বর্তমানে রাষ্ট্রপতির আসনকে অলংকৃত করছেন। তবে এ দেশের রাজনীতির খেকো মাঠে তাঁর সুস্থ চিন্তার মূল্যায়ন কেমন করা হয়, সেই ব্যাপারে তিনি বেশ কয়েকবারই মন্তব্য করেছেন। তাই তিনি যখনই সুযোগ পান, বিভিন্ন সময়েই বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর চিন্তা নিয়ে সাধারণ জনগণের সঙ্গে খোলামেলাভাবেই আলোচনা করেন এবং প্রতিটি বিষয়েই আমাদের কাছে তাঁর সেই অভিজ্ঞ চিন্তকের ভূমিকার দেখা মেলে—যা বর্তমানে নিতান্তই দুষ্প্রাপ্য।

চিন্তকের সাফল্য তর্কালোচনার বিষয়বস্তু উত্থাপনে এবং পরিবেশনে। সেটা আমাদের রাষ্ট্রপতি সব সময় বেশ ভালোভাবেই করে থাকেন। তবে বেশির ভাগ সময়ই আমরা যেটা ভুলে যাই, তা হলো, চিন্তকের চিন্তার উপস্থাপনার পরবর্তী ধাপে সাধারণত যুক্তিতর্কের অবস্থান হয়ে থাকে। অর্থাৎ রাষ্ট্রপতির প্রতি পূর্ণ সম্মান রেখে এবং তাঁর চিন্তক ভূমিকার সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে আমি কিছুদিন আগেই তাঁর উত্থাপিত বিষয় নিয়ে সেই দ্বিতীয় ধাপে আগাতে চাই। বিষয়টি হলো, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সন্ধ্যাকালীন কোর্স চালু রাখা যৌক্তিক কি না?

আলোচনার শুরুতেই বলে রাখা ভালো, আমার বিশ্ববিদ্যালয়ভিত্তিক পড়াশোনা প্রথমে একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসা প্রশাসনে নিয়মিত ছাত্র হিসেবে। পরে আরেকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নয়ন অধ্যয়নের সন্ধ্যাকালীন ছাত্র হিসেবে। তাই এ লেখায় এখন অনেকেই আবেগ আশা করলেও সর্বোচ্চ চেষ্টা থাকবে যুক্তির কাঁধেই ভর দিয়ে হাঁটার। আলোচনার উত্থাপন এবং স্তিমিত হওয়ার ঘটনা যদিও বেশ আগের তা পুনরুত্থাপন এবং বাস্তবায়নের কাজকে বেগবান করার সম্পূর্ণ কৃতিত্ব রাষ্ট্রপতির। আর সেই প্রক্রিয়া শুরু হয় গত বছরের ৯ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫২তম সমাবর্তনে রাষ্ট্রপতির ভাষণের পর থেকে। আমার আলোচনার বিষয় সেই ভাষণে উল্লেখিত আলোচ্য বিষয়–সংক্রান্ত কিছু কথা, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) প্রতিক্রিয়া এবং মন্তব্য আরও বেশ কিছু সময় ধরে লোকমুখে প্রচলিত আরও কিছু কথা।

২.
প্রথমেই রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের ভাষণের কথায় আসা যাক। ভাষণে তিনি বলেন, সন্ধ্যাকালীন কোর্সের কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সন্ধ্যার পরে কোনো পরিবেশ বজায় থাকে না। এখানে একটা বিষয় হলো, সন্ধ্যকালীন শিফটের সব ক্লাস ৬টা থেকে ৬টা ৩০ মিনিটে শুরু হয়ে একটানা ৩ ঘণ্টা ক্লাস হওয়ার পরে শেষ হয় ৯টা থেকে ৯টা ৩০ মিনিটের মধ্যে। এর মাঝে ১০-১৫ মিনিট অফিশিয়ালি বা আন অফিশিয়ালি বিরতি দেওয়া হয়। সন্ধ্যা থেকে শুরু করে বেশ রাত পর্যন্ত সন্ধ্যকালীন ছাত্ররা মূলত শ্রেণিকক্ষেই অবস্থান করেন। ক্যাম্পাসের বিভিন্ন জায়গায় বা রাস্তায় তাঁদের ভিড় করার সুযোগ থাকে না। তবে সত্যিই কিন্তু ক্যাম্পাসে তখন ভিড় বেড়ে যায়।

এখন প্রশ্ন এত মানুষ আসে কোত্থেকে? প্রথমত, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরই বিভিন্ন হলের শিক্ষার্থীরা আড্ডা বা বিনোদনের বা পরিচিতজনের সঙ্গে দেখা করার জন্য ক্যাম্পাসে বা ক্যাম্পাস এলাকার বিভিন্ন রাস্তার পাশের ফুটপাতে, চত্বরে অবস্থান করেন; যা খুবই স্বাভাবিক। দ্বিতীয়ত, টিএসসি, মধুর ক্যানটিন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের আরও কয়েকটি পয়েন্ট বহুল আলোচিত এবং পরিচিত মিলনস্থল হওয়ায়, বহিরাগত অনেকেই সেখানে পরিচিতজনের সঙ্গে দেখা করার জন্য বা নিজেরা ভালো একটা সময় কাটানোর উপযুক্ত জায়গা হিসেবে বেছে নেন এবং এটাও খুবই স্বাভাবিকও। যৌবনের কারিগরের বাড়ির উঠান সুনসান আর নিস্তব্ধ আশা না করাটাই মনে হয় উচিত হবে। এ কারণেই, শুধু যুবক বয়সীরাই নন, বিভিন্ন বয়সী (এমনকি বয়োবৃদ্ধরাও), বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ সন্ধ্যার পরে নিজেদের অবসর সময়ে যুবকদের মধ্যে অবস্থান করে নিজের পুরোনো স্মৃতি রোমন্থন করতেও এখানে নিয়মিত হাজির হন। অনেকে হাজির হন পরিবারকে নিয়েও। মোটকথা, সন্ধ্যার পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস হয় ভিন্ন এক মিলনমেলা। রাত ৯টা থেকে ৯টা ৩০ মিনিটের দিকে ভিড় কমতে শুরু করলে, কিছু সন্ধ্যকালীন শিক্ষার্থী হয়তোবা এ আনন্দে শামিল হন কিন্তু রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের অবস্থানও খুব বেশি সময়ের জন্য টেকে না। দেশের অন্য সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি যত দূর দেখেছি, বেশির ভাগ জায়গাতেই এমনটা হয়ে থাকে। এখন, এমন সুন্দর একটা জিনিস ক্যাম্পাসের ভাবমূর্তি নষ্ট করে এমন দোহাই দিয়ে অন্য আরেকটা সুন্দর জিনিসকে কেন আমরা বন্ধ করতে চাচ্ছি? আমার মূল আলোচনার সঙ্গে দ্বিমত পোষণকারী অনেকেই হয়তোবা এখানে এসে থমকে গেলেন। আমি কি ‘সন্ধ্যকালীন পড়াশোনা’কে ‘অন্য আরেকটা সুন্দর জিনিস’ বললাম? অবশ্যই। তবে কেন বললাম, সে আলোচনায় যাচ্ছি।

৩.
পৃথিবীব্যাপী, প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়েই সন্ধ্যকালীন পড়াশোনা আছে। শুধু তাই বলেই কি আমাদের দেশে চালু রাখতে হবে? না, এর পেছনের কারণটাও খতিয়ে দেখতে হবে। দেশের বেশির ভাগ শিক্ষার্থীর উচ্চশিক্ষার বিষয় নির্ধারিত হয় পরিবারের জ্যেষ্ঠ সদস্যদের (মূলত মা–বাবার) ইচ্ছায়, তা সেটা দেশীয় শ্রমবাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হোক বা না হোক। তাই, স্নাতক সম্পন্ন হওয়ার পরে তারা দুভাগে ভাগ হয়। কেউ কেউ পেশাজীবী হয়, কেউ হয় না। না হওয়ার পেছনে কারণ অনেক, আর সেই আলোচনাও আরও বড়, তাই সেদিকে যাচ্ছি না। তবে যারা শ্রমবাজারে যায় না বা যেতে পারে না, তাদের ছোট একটা অংশ নিজেদের পছন্দের বিষয়ে বা শ্রমবাজারে চাহিদা আছে এমন বিষয়ে অথবা যারা বিদেশে উচ্চশিক্ষায় আগ্রহী তারা সেখানে চাহিদা আছে এমন বিষয়ে আবার স্নাতকোত্তর করতে চায়। আমাদের দেশে এমন শিক্ষার্থীদের জন্য দুটি রাস্তা খোলা—এক, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এবং দুই, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সন্ধ্যাকালীন কোর্স। এদের সঙ্গে যোগ দেন অনেক পেশাজীবী, যাঁদের স্নাতক বিষয়ের পড়াশোনা আর তেমন কাজে লাগছে না অথবা যাঁদের নতুন অন্য বিষয়েরও জ্ঞান প্রয়োজন অথবা পদোন্নতিসহ অন্য কোনো কারণে স্নাতকোত্তর ডিগ্রির প্রয়োজন অথবা যাঁদের পড়াশোনা করাটাই একটা পছন্দের কাজ। বড় পরিসরের এই দুটো ছোট দলকে পুরোপুরিভাবেই বাধ্য করতে চাচ্ছি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বারস্থ হতে। এদের একটা অংশ অবশ্য প্রথমেই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে ঝুঁকে পড়ে।

দর্শন অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়ের দরজা সবার জন্য সব সময় খোলা। সেটা আক্ষরিক আর লাক্ষণিক দুই অর্থেই। বিশেষ কারণবশত সম্ভব না হলেও বিশ্ববিদ্যালয় সপ্তাহে ৭ দিন এবং দিনরাত ২৪ ঘণ্টা খোলা থাকবে এটা পৃথিবীর কোনো প্রান্তেই ভুরু কোঁচকানোর মতো কোনো বিষয় নয়। বিশ্বের অনেক দেশেই যাদের পক্ষে তা পরিচালনা করা সম্ভব, সেখানে গবেষক এবং গবেষণার শিক্ষার্থীদের স্বার্থে বিশ্ববিদ্যালয়ের অফিস, লাইব্রেরি, শ্রেণিকক্ষ ২৪ ঘণ্টাই চালু থাকে। এমনকি সবার সুবিধার্থে কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের শাটল বাস সার্ভিসও একইভাবে চালু রাখা হয়। নির্দিষ্ট সময় পরপর গন্তব্যের উদ্দেশে বাস ছাড়ে পুরো বাসে ১-২ জন যাত্রী থাকলেও। আমাদের দেশেও যে তা করতে হবে এমনটা আমি বলার চেষ্টা করছি না। তবে যতটুকু আমরা করতে পারছি, ততটুকুইবা আমরা কেন চালিয়ে যাব না, সেটা আপনাদের জন্য আমার প্রশ্ন। এ গেল আক্ষরিকের কথা। এবার লাক্ষণিক আলোচনায় আসি। নিয়মিত ছাত্রদের শুধু রেখে আমরা অনিয়মিত এবং পেশাজীবীদের প্রাইভেটের দিকে ঠেলে দিতে চাইছি (এর পেছনের কারণগুলো নিয়েও আমরা কথা বলব)।

প্রথমে বুঝতে হবে, পেশাজীবীদের বিশ্ববিদ্যালয়েই কেন আসতে হবে? কারণ, বিষয়ভিত্তিক তাত্ত্বিক শিক্ষা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মমাফিক গণ্ডি ছাড়া কোন শর্ট কোর্স বা প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আয়ত্ত করা সম্ভব নয়। ঠিক তাহলে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কেন নয়? সেই আলোচনায় আসবে ‘মান, উপযোগিতা আর খরচ’–এর কথা। সব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কি খরচের সঙ্গে তাল মিলিয়ে মান আর উপযোগিতা নিশ্চিত করতে পারছে? আবার যারা মান আর উপযোগিতা নিশ্চিত করছে, তারা কি খরচকে সাধারণের নাগালের মধ্যে রাখতে পারছে? দুটোরই উত্তর অব্যশই না। তাহলে এত বড় একটা জনসম্পদের অংশ তাদের এই চাহিদা পূরণ করতে পারে কোথায়? একমাত্র পথ খোলা থাকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। সেখানে নিয়মিত শিক্ষার্থী হওয়ার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায় বয়স আর সময়। তাই বিশ্বব্যাপী বেসরকারি পাশাপাশি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও এই সমস্যার সমাধান করে থাকে সন্ধ্যাকালীন কোর্সে পড়াশোনার মাধ্যমে। এ পড়াশোনা তারা যখন সাফল্যের সঙ্গে শেষ করে দেশব্যাপী আর বিশ্বব্যাপী যখন তারা ছড়িয়ে পড়েন, তারা একই সঙ্গে স্ব–স্ব বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যালামনাই এবং সেই সঙ্গে প্রতিনিধি। দেশব্যাপী আর বিশ্বব্যাপী তাদের সফলতা অনেকাংশেই বিশ্ববিদ্যালয়েরও সফলতার নামান্তর মাত্র।

৪.

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সন্ধ্যাকালীন কোর্স চালু রাখা যৌক্তিক কি না, তা নিয়ে বিতর্ক আছে। ছবি: সংগৃহীত
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সন্ধ্যাকালীন কোর্স চালু রাখা যৌক্তিক কি না, তা নিয়ে বিতর্ক আছে। ছবি: সংগৃহীত

এখন দেখা যাক, সন্ধ্যাকালীন কোর্সে পড়াশোনা চালু থাকলে বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ভালো কি থাকে? যেসব পেশাজীবী সন্ধ্যকালীন পড়াশোনা করতে আসেন, তাঁরা তাঁদের সঙ্গে করে নিয়ে আসেন শ্রমবাজারের সঙ্গে সম্পর্ক আর একরাশ অভিজ্ঞতা। তাতে কি উপকার? আমাদের শিক্ষামন্ত্রী মাসখানেক আগেই আলোচনাসভায় বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কর্ণধারদের বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে শ্রমবাজার সম্পর্ক আর সামঞ্জস্যতা গড়ে তুলতে। এতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে কী, কেমনভাবে পড়ানো উচিত তা যেমনভাবে নিশ্চিত করা যাবে, একই সঙ্গে শিক্ষার্থীদের শ্রমবাজারে সহজে যুক্ত হওয়ার কাজটাও সহজ হবে। বিভাগভেদে স্নাতক ছাত্রদের শেষ বর্ষে ‘শিক্ষানবিশ’ হিসেবে কাজের অভিজ্ঞতা নেওয়া এবং সেই অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান প্রতিবেদন আকারে বিভাগে জমা দেওয়া তাঁদের স্নাতক সম্পন্ন করার জন্য বাধ্যতামূলক। যেসব বিভাগে সন্ধ্যাকালীন কোর্সে পড়াশোনা চালু আছে, সেখানকার এই স্নাতক ছাত্রদের বড় একটা অংশের সময়মতো ‘শিক্ষানবিশ’ হওয়ার পথ সহজ করে দেন সন্ধ্যাকালীন কোর্সের পেশাজীবী শিক্ষার্থীরা।

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা যেহেতু প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতে যান, সেহেতু সন্ধ্যাকালীন কোর্সে পড়াশোনা বন্ধ করে দেওয়াটা তাঁদের আরও বেশি করে বেসরকারিমুখী করারই নামান্তর হবে মাত্র। আবার সবদিক আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে বন্ধ করাটাও কারও জন্য সুখকর কিছু হবে না, কারণ, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের (সব বিশ্ববিদ্যালয় নয়, কিছু কিছু) শিক্ষার মান বজায় রাখার জন্যও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সেখানে এখনো সময় দেওয়াটা বাঞ্ছনীয়। আর শুধু শিক্ষকদের জন্যেই যদি হয় এত বাধা, তাহলে মেধাবীদের এই খাতে যোগদানও ধীরে ধীরে কমে যাওয়ার আশঙ্কা অমূলক হবে না। যার ফলে অপব্যবহারমনা ক্ষমতাধরের রোপণকৃত আগাছায় ভরে যাবে সব বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণ।

বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের পরামর্শে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) তৈরি করে ২০ বছর মেয়াদি একটি কৌশলপত্র। এর উদ্দেশ্য ২০২৬ সালের মধ্যে ৪ ধাপে উচ্চশিক্ষায় রাষ্ট্রীয় ভর্তুকির ৫০ ভাগ হ্রাস করা। সাদা-কালো বিবেচনায় পপুলিস্ট মতের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কোনো গবেষণা বা প্রয়োজনীয় ভাবনার জায়গাতেও না গিয়ে ইউজিসির সন্ধ্যকালীন এই পড়াশোনা বন্ধের ব্যবস্থাটা তাদের নিজেদের পূর্বপরিকল্পনার সঙ্গেও সাংঘর্ষিক এবং পরস্পরবিরোধী অবস্থান নেয়। ইউজিসির ২০২৬ সালকে সামনে রেখে নেওয়া এই পরিকল্পনাটাই বা কতটা বাস্তবমুখী আর সত্যিকার অর্থেই উন্নয়নমুখী কি না, তা যদিও সব সময়ই আমার কাছে প্রশ্নবিদ্ধ, তবু সেই ভিন্ন আলোচনায় এখন যাব না। আর রাষ্ট্রপতির ভাষণ–পরবর্তী ১১ ডিসেম্বর ২০১৯-এ প্রকাশিত ইউজিসির প্রজ্ঞাপনে সন্ধ্যকালীন কোর্স বন্ধ করা কেন প্রয়োজন তার কারণ দর্শানো হয় এভাবে, ‘সন্ধ্যকালীন কোর্স পরিচালনা করা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈশিষ্ট্য ও ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করে বিধায় সন্ধ্যকালীন কোর্স বন্ধ হওয়া বাঞ্ছনীয়।’ শুধু তাই নয় সন্ধ্যকালীন পড়াশোনাকে এই প্রজ্ঞাপনে ‘উচ্চশিক্ষা প্রশাসনে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি’র কারণ হিসেবেও ধরা হচ্ছে।

ঢাবির সমাবর্তনে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ সন্ধ্যাকালীন কোর্স নিয়ে কথা বলায় বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন তা বন্ধের কথা জানিয়েছে। ছবি: সংগৃহীত
ঢাবির সমাবর্তনে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ সন্ধ্যাকালীন কোর্স নিয়ে কথা বলায় বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন তা বন্ধের কথা জানিয়েছে। ছবি: সংগৃহীত

৫.
এবার ওপরের ফেলে আসা আলোচ্য বিষয়গুলোতে ফেরা যাক। সন্ধ্যাকালীন কোর্স–বিষয়ক অনেক সমস্যা যে আমাদের আছে, তা মানতেই হবে। যেহেতু ব্যক্তিগত স্বার্থেই শিক্ষার্থীরা সন্ধ্যাকালীন কোর্সে পড়াশোনায় রত হন, তাই তাঁদের পেছনে রাষ্ট্রের দায়ভার কিছুটা হলেও কম বই–কী। সেই বাড়তি দায়ভারটা শিক্ষার্থীর কাঁধে যাওয়াটাই যৌক্তিক। কিন্তু তবু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অতিরিক্ত ব্যবসায়িক মনোভাব মানায় না। তাই অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক বিভাগের অন্যায্য বাড়তি কোর্স ফি দুশ্চিন্তার উদ্রেক করে। কারণ, বাড়তি কোর্স ফি বিভিন্ন বিভাগ এবং অনুষদের অতি–উৎসাহের কারণ হয়, যা তাদের নিয়মিত শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে আনে। এ ছাড়া, ভর্তির ব্যবস্থাপনাও দেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে একই মানসম্মত নয়। সব বিষয়ের সন্ধ্যাকালীন কোর্সে পড়াশোনার চাহিদা নেই। এ জন্য বাজার পর্যালোচনাও প্রয়োজন। সন্ধ্যাকালীন কোর্স থেকে প্রাপ্ত আয় সঠিক নিয়মমাফিক বণ্টন হচ্ছে কি না, তা–ও নিশ্চিত করা প্রয়োজন। তাই এ কোর্সে পড়াশোনার ওপর নিয়মিত পড়াশোনার মতো বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় পরিচালনা কমিটির ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করা প্রয়োজন। আর সব থেকে বেশি প্রয়োজন এ–সংক্রান্ত একটি নীতিমালা, যার দায়িত্ব ইউজিসিকেই নিতে হবে। আর পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সন্ধ্যাকালীন কোর্সে পড়াশোনা বন্ধ হলে সবচেয়ে লাভবান হবেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিকপক্ষের লোকেরাই। হলফ করে বলতে পারি, আর কেউ নন।

তবে, সন্ধ্যকালীন পড়াশোনা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বন্ধ করা যেতেই পারে। সঠিক গবেষণার মাধ্যমে দুটো সিদ্ধান্তেরই ভালো এবং খারাপ দিকগুলো পরিমাপ করে যদি দেখা যায়, খারাপকে দূর করা কোনোভাবেই সম্ভব নয় এবং খারাপের ফল ভালোকেও ছাড়িয়ে যাচ্ছে শুধু তখনই তা করা যেতে পারে। দেশের সাধারণ মানবসম্পদ এবং একই সঙ্গে পেশাজীবী মানবসম্পদের তাত্ত্বিক উন্নয়নের কথা বিবেচনায় এনে সাদাকালো বিবেচনায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সন্ধ্যকালীন পড়াশোনা বন্ধের নির্দেশনা না দিয়ে, বিষয়টি বিবেচনাধীন রেখে আরও খতিয়ে দেখার নির্দেশনা দেওয়ার জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে এবং তাঁর চিন্তক সত্তার কাছে আকুল আবেদন জানাচ্ছি।

*হোসাইন মোহাম্মদ ওমর খৈয়াম: লেখক ও গবেষক ([email protected])