বঙ্গবন্ধু স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসতেন

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ফাইল ছবি
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ফাইল ছবি

বিজ্ঞানী আইনস্টাইন বলেছিলেন মহাত্মা গান্ধীর বিষয়ে, বিশ্বাস করতেই কষ্ট হয় রক্ত–মাংসের একজন মানুষ এই পৃথিবী চষে গেছেন। মহাত্মা গান্ধীকে নিয়ে আইনস্টাইনের মন্তব্য ছিল অসাধারণ। আমাদের সৌভাগ্য যে এ বাংলার মাটিতে একজন বাঙালি সন্তান হেঁটে চলে গেছেন আমাদের আঙিনায়। সেই মহান মানুষ আমাদের জাতির জনক স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

এ পৃথিবীর ঘূর্ণন কোনো দিন যদি থেমেও যায়, নতুন কোনো গ্রহ তার বুকে ধারণ করে মানবসভ্যতার বিস্তার, আমি তো চোখ বন্ধ করে বলব, আরেকজন বঙ্গবন্ধুর আবির্ভাব ঘটবে না কোনো দিন। তাঁকে যাঁরা চিনতে পারেননি, সেসব মানুষকে ধিক্কার। ১৫ আগস্ট চিরদিন হাহাকার করে ফিরবে আকাশে-বাতাসে পৃথিবী থেকে ভিন্ন পৃথিবীতে, মানুষের অস্তিত্ব থেকে অস্তিত্ব সংসারে। কোনো দিনও হারিয়ে যাবে না পৃথিবীর ছায়া থেকে সেই নিষ্পাপ মুখ।

বঙ্গবন্ধু স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসতেন। সেই স্বপ্ন নিজের জন্য নয়। সমস্ত বাঙালির স্বপ্নের বোঝা কাঁধে নিয়েছিলেন যে মানুষ, তার উপহার আমরা ভালোই দিয়েছি সেই ১৫ আগস্টে। তিনি আমাদের ভালোবাসতেন, বিশ্বাস করতেন, সেই ভালোবাসা ও বিশ্বাসের উপহারও আমরা উজাড় করে দিয়েছি সেই আগস্টে। পৃথিবী যত দিন বেঁচে থাকবে, মানুষের ভালোবাসা ও বিশ্বাসগুলো প্রশ্নবিদ্ধ থাকবে আগস্টকে মনে হলেই। আগস্ট আমাদের এই সত্যটাও শিখিয়ে দিয়েছে, আর যা–ই করো, বাঙালিকে অন্তত বিশ্বাস কোরো না। আগস্ট আমাদের কোনো দিন ক্ষমা করবে না, কোনো দিনও না।

মনে পড়ছে যিশুকে, সমস্ত মানুষের পাপের বোঝা বহন করতেই এসেছিলেন। সেই মানুষেরাই যিশুর নিষ্পাপ শরীরে বিঁধিয়েছিল লৌহপেরেক। কী সাংঘাতিক উপহার ও প্রতিদান ঈশ্বরের পুত্রকে। যাঁকে নিয়ে আইনস্টাইন আশ্চর্য হয়েছিলেন, এমন মানুষও কি সম্ভব। সেই বাপুজি জীবনটাই কাটালেন অহিংসভাবে। তিনিও বৃদ্ধ বয়সে একটি বুলেট উপহার পেলেন, হে রাম বলে সেই বুলেটও গ্রহণ করলেন সানন্দে।

বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম একজন। বঙ্গবন্ধু যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের সরকারের প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেছিলেন। একটি প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলের হলেই কিংবা সরকারে নিজেকে দায়িত্বরত করলেই অন্যদের মতো বঙ্গবন্ধুকে দলীয় পরিচয়ে কিংবা সেই দলের হয়ে সরকারে ছিলেন, এমন বিবেচনা করা যায় না। সে সত্যটি বাংলাদেশের অন্য সব রাজনৈতিক দল কোনো দিনও বুঝল না। সেটা আমাদের লজ্জা। বঙ্গবন্ধু যে সবার। এই বাংলার প্রতিটি অণুতে বঙ্গবন্ধু। রাজনীতি করেছিলেন মানুষের জন্য। রাজনৈতিক দল গঠনও মানুষের প্রয়োজনে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান

একজন মানুষের ডাকে স্বাধীনতার জন্য একটি দেশ যুদ্ধে লড়ে। আর সেই যুদ্ধ মানুষের মুক্তির যুদ্ধ, মানুষের স্বাধীনতার যুদ্ধ। নিশ্চয়ই সেই মানুষ কোনো সাধারণ মানুষ নয়, অন্যদের থেকে অবশ্যই আলাদা। এই সাধারণ বিষয়টা বোঝার ক্ষমতা একজন মানুষ হিসেবে, রাজনীতিক হিসেবে এই সবুজ–শ্যামল বাংলাদেশের সমস্ত রাজনৈতিক দল যদি একবার আন্তরিকভাবে উপলব্ধি করত, কতই–না সুন্দর হতো। বাংলার আকাশে-বাতাসে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নগুলোও মুক্তি পেত। বিষয়টা একেবারেই সহজ। দল যার যার, বঙ্গবন্ধু সবার। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দল যদিও আওয়ামী লীগই ছিল, বঙ্গবন্ধু তো তাঁর দলকে ছাড়িয়ে সরকারি ক্ষমতা ছাড়িয়ে সমস্ত বাঙালির সমস্ত বিশ্বের হয়ে গিয়েছিলেন, সেই সত্যটা চোখে পড়ল না অন্য সব নবগঠিত রাজনৈতিক দলের, এটা আফসোসের।

সেই আগস্টে বঙ্গবন্ধুকে আড়াল করার যে চেষ্টা, তা অব্যাহত রেখেছিল পরবর্তী বাংলার অবৈধ-বৈধ শাসকেরা। সেই আগস্টকেই যেন বাংলার মানচিত্রে চিরদিন আঁকতে চেষ্টা করে গেছে সামরিক রাজনীতিক মুখোশের কুশীলবেরা। বাংলার ধারা গতিপথ উল্টো দিকেই ঘুরিয়ে দিয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন হাহাকার করে ছুটেছে বাংলার আকাশে-বাতাসে। এক অচেনা–অজানা বাংলাদেশ যেন মুখ থুবড়ে পড়েছিল মানচিত্র আড়াল করে।

বাংলাদেশ হারিয়ে গিয়েছিল আগস্টেই। বাংলাদেশ ঘুমিয়ে গিয়েছিল আগস্টেই। বাংলাদেশের সৌন্দর্য ম্লান হয়ে গিয়েছিল আগস্টেই। এই বাংলার বুকেই চেপে ধরেছিল প্রেতাত্মার ঝাঁক সেই আগস্টেই।

বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে তাঁর স্বপ্নগুলোও প্রাণ পেত, সেই স্বপ্নগুলো ফুটে উঠত বাঙালির জীবনে। স্বপ্নময় বাংলাদেশ হতো আমাদের। যেখানে মানুষের অধিকার চিন্তাচেতনাগুলো মুক্তি পেত। এমন স্বপ্নই যে রচনা করেছিলেন বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের প্রথম সংবিধানে, যা পরবর্তী দস্যুরা মুছে দিয়েছে, বঙ্গবন্ধুর আঁকা স্বপ্নের ক্যানভাস। বাংলাদেশকে নিয়ে কতই–না ইচ্ছা–আকাঙ্ক্ষা, বাঙালির মনের ভেতরের সুপ্ত বাসনাগুলো জানতেন বঙ্গবন্ধু। বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে নিশ্চয়ই তিনিই জানতেন কেমন বাংলাদেশ রচনার শিল্পগুণ ধারণ করেছিলেন, লালন করেছিলেন হৃদয়ে। শিল্পী মাত্রই তো জানেন, মনে মনে কী আঁকতে চাইছেন তিনি। আর কেউ কী করে জানবে শিল্পীর হৃদয়ের অনুভব। যতক্ষণ না শিল্পী তা ক্যানভাসে নামিয়ে আনেন, ব্রাশ স্পর্শ দিয়ে গভীর মমতায়।

এই বাংলাদেশকেও আঁকতে চেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু, গভীর মমতায় আঁকা বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ হয়তো আমরা পেতাম। সৃজনশীল, রুচিশীল বাংলাদেশ আঁকবেন বঙ্গবন্ধু, সেটা ঠিকই টের পেয়েছিল মধ্যযুগীয় চিন্তার অসুন্দরের রুচিহীন, সৃজনশীলধ্বংসী, কুসংস্কারে আচ্ছন্ন শয়তানের প্রেতাত্মারা। যারা পেছনের দিকেই যেতে বদ্ধপরিকর, স্বপ্নসুন্দরের এগিয়ে যাওয়া বাংলাদেশ তাদের স্বস্তি দেয় না।

ঘুষ–দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ, সমস্ত অনাচার, কুসংস্কার ও ধর্মীয় মতভেদমুক্ত বাংলাদেশ যাদের চিন্তায় বিষের মতো বিঁধে যায়, তারাই আগস্টের নির্মম ইতিহাসের জন্ম দিয়েছিল। এক স্বপ্ন চুরির মাস সেই আগস্ট, বাঙালির স্বপ্ন মরে গিয়েছিল সেসব মূর্খ–লুটেরাদের হাতে। স্বপ্ন চুরি যাওয়া বাংলা মা আমার কাঁদে, কাঁদে আগস্ট নিজেও। তার বুকেই যে এক মহান পিতার রক্তগঙ্গা বয়ে গেছে। বাংলা, বাঙালি, বাংলাদেশ, বাংলাদেশের রাজনীতি, যতনীতি শতনীতি, সবার ওপরে হাত উঁচিয়ে ছায়ার মতো দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু, তাঁকে ছোঁয়া এত সহজ নয়। এই বাংলার মাটিতে লক্ষ কোটি রাজনীতিকের জন্ম হবে যুগে যুগে, কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে বঙ্গবন্ধুর উচ্চতাকে হাত দিয়ে স্পর্শ করার যোগ্যতা কোনো দিনও হবে না। সবার ওপরে বঙ্গবন্ধু চিরন্তন।

আমি মনে করি না বঙ্গবন্ধুকে বুঝতে, খুঁজতে নিজেকে কোনো বিশ্ব পরিচিত রাজনৈতিক দলে নাম লেখানোর দরকার আছে। এমনকি বঙ্গবন্ধুর প্রতিষ্ঠিত, স্বনামধন্য বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রাচীন ও জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগেও নিজেকে সমর্পণ করে আওয়ামী লীগার সাজারও প্রয়োজন পড়ে না। বঙ্গবন্ধু কি শুধুই রাজনীতিক? ভুল, বঙ্গবন্ধু আমার কাছে একজন স্বপ্নদ্রষ্টা, বাংলাদেশের মানচিত্রের ওপর ভেসে থাকা এক নিষ্পাপ মুখচ্ছবি। জীবনানন্দ দাশের কথায়, ‘বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি, তাই পৃথিবীর রূপ খুঁজিতে যাই না...।’ আমিও বলি, বঙ্গবন্ধুকে বুঝিয়াছি, খুঁজিয়াছি, আর কিছুই খুঁজতে যাই না, বুঝতেও যাই না।

লেখক: অভিনয়শিল্পী ও কবি