'মাডির এ জীবন ভালা নাই বাফু', মৃৎশিল্পীর আকুতি

উপজেলার পুটিজানা ইউনিয়নের বেরিবাড়ি গ্রামের কুমারবাড়ির মৃৎশিল্পী অনিতা পাল প্রায় ৪০ বছর ধরে নিপুণশৈলীতে মাটির বাসনপত্র তৈরি করে আসছেন। ছবি: লেখক
উপজেলার পুটিজানা ইউনিয়নের বেরিবাড়ি গ্রামের কুমারবাড়ির মৃৎশিল্পী অনিতা পাল প্রায় ৪০ বছর ধরে নিপুণশৈলীতে মাটির বাসনপত্র তৈরি করে আসছেন। ছবি: লেখক

‘১৪ বছরে বিয়া হইছে আমার। দেখতে দেখতে ৪০ বছর এই পালবাড়ির উসারায় মাডি গুইলা বাসনপত্র বানাইয়া জীবন পার কইরা দিলাম। অহন আর পারি না, খালি কোনোমতে দুই বেলা ভাত খাওনের লাইগা দিন-রাইত মাডির বাসন বানাই কম দামে বেচি। মাডির জীবন ভালা নাই বাফু...এ যেন এক কালান্তরের উপখ্যান।’

পালবাড়িতে এভাবেই এক কিশোরীকে পড়াশোনার পাশাপাশি তৈরির পর পুতুলে রং করতে দেখা গেছে। ছবি: লেখক
পালবাড়িতে এভাবেই এক কিশোরীকে পড়াশোনার পাশাপাশি তৈরির পর পুতুলে রং করতে দেখা গেছে। ছবি: লেখক

এক নিমেষেই শিবগঞ্জ পালবাড়ির বয়োবৃদ্ধ শিল্পী অনিতা পাল কয়লার ইঞ্জিনের মতো চলতে থাকা শ্বাস–প্রশ্বাসের ভেতর চাপাপড়া কথাগুলো বললেন। যাঁদের কাছে জীবনটাই হলো কাদা–মাটির, মাটিই যাঁদের ভগবান, রোজ পূজার আরতিতে সাজায় মাটির ভগবানকে, যেই মাটিতেই মিশে যাবে যাঁদের চিতায় পোড়া অন্তিম ছাইভস্ম, তাঁরা আসলেই কেমন আছেন? তবুও অনিতা পাল এ মাটিকেই জীবনের শেষ আরাধনায় এখনো নতুন নতুন রূপে গড়ে যান তাঁর নিপুণ চিন্তাশৈলী।

পৃথিবীর প্রতিটি দেশে রয়েছে যার যার নিজস্ব সংস্কৃতি। কেননা মানুষ তার নিজস্ব সংস্কৃতি-কৃষ্টি–কালচারের আদলেই প্রতিনিয়ত বেড়ে উঠতে থাকেন। আমাদের বাঙালি সংস্কৃতির শিকড়ে আছে গৌরবান্বিত হাজার বছরের ঐতিহ্য। আর সেই শিকড়ের মূলেই রয়েছে গ্রামীণ সংস্কৃতি, যার গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে মৃৎশিল্প। বাঙালির প্রাণের উৎসব বাংলা নববর্ষের বৈশাখী মেলাসহ যেকোনো উৎসব, পূজা–পার্বণে যুগ যুগ ধরে মাটির তৈরি জিনিসপত্র ব্যবহার করে আসছে বাঙালি।

ফুলবাড়িয়ার আঞ্চলিক ভাষায় বলা হয় খুড়া বা ঢাকনা। খুড়া তৈরির পর রোদে দেওয়া হয়েছে। ছবি: লেখক
ফুলবাড়িয়ার আঞ্চলিক ভাষায় বলা হয় খুড়া বা ঢাকনা। খুড়া তৈরির পর রোদে দেওয়া হয়েছে। ছবি: লেখক

মৃৎশিল্পী অনিতা পাল বলেন, ‘আমি কুমারের মাইয়া, মাডির মতো কালা আরার শইল্যের রং। বাবায় কইছে আমি নাহি দেখতে ঠাকুমার মতো হইছি, কুচকুচা কালা। ছোটবেলা মায় শিখাইছে কেমনে বানাইতে হয় মাডির (মাটির) পুতুল, পোলা পুতুল মাইয়া পুতুল। আমি বাড়িতে বইয়া পুতুল, বাচ্চাগর খেলনার মাডির হাঁড়ি–পাতিল, হাতি-গুড়া (ঘোড়া) এসব বানাইতাম, রং করতাম। বৈশাখ আইলেই আমগর কুমার বাড়িত কামের চাপ বাড়ত, মেলায় বাবায় আমার গড়া পুতুল গুলাইন লইয়া বেইচা আসত, যেদিন পুতুল গুলাইন বেচতে নিত হেই দিন খুব মনডা বেজায় খারাপ থাকত, পুতুলের টেকা দিয়া বাবায় আমার লাইগা হাট থেইকা লাল পিরান কি না আনত, চুড়ি ফিতা আনত, বাসনা তেল কিনা দিত। একদিন বিয়ার লোকজন আমগো বাড়িতে আমারে দেখতে আইলো, তারা দেইখা আমারে পছন্দ করে নাই, তয় আমার হাতের কাম দেইখা তারা মেলা খুশি, কুমারবাড়ির মাইয়াগর রূপ লাগে না বাফু, জানতে হয় মাডি আর পানি খেলা, পেক-কেদা দিয়া কেডায় কত সুন্দর কইরা মাডির মালপত্রর বানাইতে পারে। এই বাড়িতে নতুন বউ হয়া আওনের পর আমার পুতুল বানানি বন্ধ, শিখতে থাকলাম কেমনে বানাইতে হয় মাটির হাঁড়ি–পাতিল, থালা, গেলাস, কলসি, সংসারের বেবাক বাসনপত্র। ১৪ বছরে বিয়া হইছে আমার আর চোক্ষের পলকে দেখতে দেখতে ৪০ বছর এই পাল বাড়ির উসারায় মাডি গুইলা বাসনপত্র বানাইয়া এক জীবন পার কইরা দিলাম। অহন আর পারি না, পোলাপান বড় হইছে। তারা তাগো সংসার নিয়া চলে, মাডির বাসনপত্র আর কেউ নেয় না অহন। খালি কোনোমতে দুই বেলা ভাত খাওনের লাইগা অহনো দিনরাইত মাডির বাসন বানাই কম দামে বেচি। এই মাডির জীবন ভালা নাই বাফু।’ এ যেন এক কালান্তরের উপখ্যান।

উপজেলার বড়িলপাড়ায় মৃৎশিল্পী লক্ষ্মী রানী মাটির খেলনায় রং করছেন। ছবি: লেখক
উপজেলার বড়িলপাড়ায় মৃৎশিল্পী লক্ষ্মী রানী মাটির খেলনায় রং করছেন। ছবি: লেখক

একসময় ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলার নাওগাঁও, পুটিজানা, কালাদহ, আছিম, দেওখলাসহ বিভিন্ন ইউনিয়নের কুমারদের বাড়িগুলোতে মাটির তৈরি বিভিন্ন খেলনাসহ সংসারের নিত্যপ্রয়জনীয় মাটির জিনিসপত্রের কদর ছিল দেশব্যাপী। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে যেকোনো উৎসব–অনুষ্ঠানে ফুলবাড়িয়ার কুমারবাড়িগুলোতে মাটির তৈরি পণ্য কিনতে ক্রেতারা আসতেন। কালের বিবর্তনে প্লাস্টিক পণ্যে বাজার সয়লাবের কারণে এখন আর সেই কুমারবাড়ির ঐতিহ্য নেই। আগের মতো আর পোষায় না বলে অধিকাংশ পালবাড়ির নারী-পুরুষ এখন পেশা পরিবর্তন করে অন্য পেশায় কর্মসংস্থানে জড়িয়ে পড়ছেন।

জনশ্রুতি আছে, একসময় গ্রামবাংলার বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অতিথিদের খাবার পরিবেশনে ব্যবহার করা হতো মাটির তৈরি সানকি (থালা), যার ব্যবহার এখন প্রায় বিলুপ্তির পথে। এ ছাড়া চৈত্রের প্রখর খরতাপ থেকে ফিরে ক্লান্ত কেউ মাটির কলসের এক গ্লাস পানি খেলে বুক জুড়িয়ে যেত। সেই মাটির কলসের বুক জুড়িয়ে যাওয়া ঠান্ডা পানির স্বাদ আমাদের নতুন প্রজন্ম এখন জানে না বললেই চলে। বাঙালি সংস্কৃতির এই শত শত বছরের ঐতিহ্য যেটুকুই আছে, সেটুকু টিকিয়ে রাখতে হলে এখনই এই মৃৎশিল্পীদের সরকারি বা বেসরকারিভাবে পুনর্বাসনের মাধ্যমে এই শিল্পকে টিকিয়ে রাখার উদ্যোগ গ্রহণ জরুরি। না হলে বাঙালি সংস্কৃতি থেকে এই গুরুত্বপূর্ণ অংশটি বিলীন হওয়ার আশঙ্কা করছেন মৃৎশিল্পীসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

কুলা আর চালনিতে লাল টকটকে মাটির পুতুল রোদে শুকাচ্ছেন এভাবে। ছবি: লেখক
কুলা আর চালনিতে লাল টকটকে মাটির পুতুল রোদে শুকাচ্ছেন এভাবে। ছবি: লেখক

এঁটেল মাটি কেনেন মৃৎশিল্পীরা
ফুলবাড়িয়ার বিভিন্ন ইউনিয়নের গ্রামগুলো থেকে কৃষকের জমির আবাদি ফসল ধানের মূল্যের বিনিময়ে এঁটেল মাটি কিনে আনে পালপাড়ার মৃৎশিল্পীরা। প্রথমে মাটিগুলোকে ছোট ছোট টুকরা করে নেওয়া হয়। এরপর মাটির টুকরাগুলো পানিতে ভিজিয়ে পা দিয়ে কাদার মিশ্রণ তৈরি করেন কুমাররাড়ির নর-নারীরা। এভাবে পরপর তিনবার পানি দিয়ে ভিজিয়ে মাটিকে ভালোভাবে মিশ্রণ করে নেন। মাটির টুকরা অনুযায়ী মাটিকে মৃৎশিল্পীরা নানা রূপে আকৃতি দেন বলে জানান তাঁরা। কার্তিক থেকে চৈত্র মাসের শেষ দিন পর্যন্ত পুরোদমে চলে মাটির তৈরি খেলনা, হাঁড়ি, পাতিলসহ নানান জিনিস তৈরির কাজ, যা বাড়ির কর্তাব্যক্তি থেকে শুরু করে শিশুরাও তাদের সঙ্গে তালমিলিয়ে মাটির জিনিসপত্র তৈরিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।

মৃৎশিল্পীর নিপুণ হাতের ফসল পুতুলগুলো। ছবি: লেখক
মৃৎশিল্পীর নিপুণ হাতের ফসল পুতুলগুলো। ছবি: লেখক

উপজেলার পুটিজানা ইউনিয়নের বেড়িবাড়ি গ্রামের মৃৎশিল্পী এবং প্রতিমা কারিগর নিরত চন্দ্র পাল (৫৫) বলেন, ‘ফুলবাড়িয়ায় বেড়িবাড়ি কুমারপাড়া গ্রামের মৃৎশিল্পীরা অন্যান্য ইউনিয়নের চেয়ে সবচেয়ে বেশি মাটির জিনিসপত্র তৈরি করেন। তবে এখন আর আগের মতো মাটির জিনিসপত্র কেনে না মানুষ। শুধু বৈশাখ এলেই স্থানীয় বৈশাখী মেলাগুলোর চাহিদা মিটিয়ে পণ্যগুলো ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলার ক্রেতাদের কাছে বিক্রি করে দিই আমরা। বছরে মেলাগুলো কেন্দ্র করে যা পাই, তা দিয়েই চলতে হয়। তবে এখনো গ্রামে দরিদ্র মানুষ মাটির থালা, কলস ব্যবহার করে।’

পুটিজানা ইউনিয়নের বেড়িবাড়ি কুমারপাড়া ঘুরে দেখা গেছে, বৈশাখী মেলা ও মৌসুমি কিছু মালপত্র তৈরির জন্য এখন থেকেই ৫০ থেকে ৭০ প্রকারের মাটির খেলনা, পরিবারের মাটির তৈরি নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র তৈরির কাজ শেষ করে রং লাগাতে ব্যস্ত মৃৎশিল্পীরা।

নিপুণ হাতের রংতুলির আঁচড়ে সেজেছে বাহারি পুতুলগুলো। ছবি: লেখক
নিপুণ হাতের রংতুলির আঁচড়ে সেজেছে বাহারি পুতুলগুলো। ছবি: লেখক

নাওগাঁও পালবাড়ির মৃৎশিল্পী সুশান্ত কুমার চন্দ্র পাল জানান, বাজারে প্লাস্টিকের তৈরি খেলনা, আসবাবসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ব্যবহার ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পাওয়ায় মাটির তৈরি খেলনাসহ বিভিন্ন জিনিসের চাহিদা ক্রমেই কমে যাচ্ছে। কারিগরেরা দিন–রাত পরিশ্রম করেও মাটির তৈরি এসব পণ্যের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছে না।

জানা যায়, সুশান্ত কুমার চন্দ্র পালের দুই সন্তান পেশায় প্রথমে মৃৎশিল্পকে বেছে নিলেও পরবর্তী সময়ে চলে যান অন্য পেশায়। এর কারণ হিসেবে তাঁর স্ত্রী সুচন্দা রানী পাল বলেন, ‘আগের মতো মৃৎশিল্পীরা আর পারিশ্রমিক পান না। তাই বাধ্য হয়ে আমি আমার সন্তানদের অন্য পেশায় কাজে দিচ্ছি।’

নাওগাঁও পালবাড়ির মৃৎশিল্পী সুশান্ত কুমার চন্দ্র পাল জানান, বাজারে প্লাস্টিকের তৈরি খেলনা, আসবাবসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ব্যবহার ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পাওয়ায় মাটির তৈরি খেলনাসহ বিভিন্ন জিনিসের চাহিদা ক্রমেই কমছে। ছবি: লেখক
নাওগাঁও পালবাড়ির মৃৎশিল্পী সুশান্ত কুমার চন্দ্র পাল জানান, বাজারে প্লাস্টিকের তৈরি খেলনা, আসবাবসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ব্যবহার ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পাওয়ায় মাটির তৈরি খেলনাসহ বিভিন্ন জিনিসের চাহিদা ক্রমেই কমছে। ছবি: লেখক

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করেন, বর্তমানে পৃথিবীর মানুষ মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে বসবাস করছে। দৈনন্দীন জীবনে আগ্রাসনের মতো গ্রাস করা প্লাস্টিক পণ্যের ব্যবহারের কারণে মানবদেহে বাসা বাঁধছে নানা রোগবালাই। দেশে এই পণ্যের ব্যবহারের মাত্রা কমিয়ে মাটির পণ্য ব্যবহারের দিকে নজর দেওয়ার মাধ্যমে নতুন প্রজন্মকে একটি সুন্দর পৃথিবী উপহার দেওয়া উচিত। পাশাপাশি সরকারি ও বেসরকারিভাবে গ্রামের এই মৃৎশিল্পীদের পৃষ্ঠপোষকতার মাধ্যমে বাঙালির এই শত বছরের ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখা প্রয়োজন বলে মনে করেন তাঁরা।

মাটির সবুজ পুতুল। ছবি: লেখক
মাটির সবুজ পুতুল। ছবি: লেখক