২০০ শীতার্তের মধ্যে ভালোবাসার উষ্ণতা ছড়িয়ে দিল কুজেস

রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলায় শীতার্ত ১০০ মানুষের মধ্যে ‘উষ্ণতা’ বিতরণ করে কুমিল্লা জেলা সমিতি (কুজেস) রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। ছবি: লেখক
রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলায় শীতার্ত ১০০ মানুষের মধ্যে ‘উষ্ণতা’ বিতরণ করে কুমিল্লা জেলা সমিতি (কুজেস) রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। ছবি: লেখক

ঘুম ভেঙেছে ভোররাত সাড়ে ৪টায়। ৬টা ২০ মিনিটে ট্রেন। বাইরে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি, সঙ্গে ঘন কুয়াশা। হালকা বৃষ্টি মাথায় করে ঘুটঘুটে অন্ধকারে বেরিয়ে পড়লাম আমরা ১২ জন। উদ্দেশ্যে শীতার্তদের মধ্যে উষ্ণতা ছড়িয়ে দেওয়া।

উদ্যোগটি ছিল কুমিল্লা জেলা সমিতি (কুজেস) রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের। সবকিছু ঠিক করে ভোর সাড়ে পাঁচটার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের মেইন গেটে গেলাম। আশপাশে তখন যানবাহনের চিহ্নমাত্র নেই। বৃষ্টি আরও বেড়ে যেতে লাগল। আমরা তখন কোনো কিছু চিন্তা না করে সামনে হাঁটতে থাকলাম। তখনই আশার আলো হয়ে দেখা দিল একটি লেগুনা। সেখানেও মানুষে ভর্তি! যেভাবেই হোক সময়মতো স্টেশন পৌঁছাতে হবে। তাই কষ্ট করে কয়েক ইঞ্চি জায়গা খালি করে এর মধ্যে উঠে গেলাম।

আমরা স্টেশনে পৌঁছালাম। কিন্তু সঙ্গের দুজনের আসতে দেরি হলো। ততক্ষণে ট্রেন হর্ন দিয়ে ছেড়ে দিয়েছে। ওরা তখনই স্টেশনের সামনে এসে নামল। ট্রেনের যে গতি, ওরা ট্রেনটাই মিস করত। তাই আমাদের মধ্যে শাইদুল নামের একজন কোনো কিছু চিন্তা না করেই ট্রেনের চেইন ধরে টান দিল। আর এর মধ্যেই ওরা ট্রেনে উঠে গেল।

ট্রেন আবার চলতে শুরু করল। মাঠঘাট, বিলের মাঝখান দিয়ে ট্রেন চলেছে চিলাহাটির দিকে। টানা ছয় ঘণ্টার ভ্রমণ শেষে আমরা পৌঁছালাম নীলফামারীর সৈয়দপুরে। ততক্ষণে সূর্য মাথার ওপর, স্টেশনের কাছেই একটা হোটেলে দুপুরের খাবার খেয়ে নিলাম। রাজশাহী থেকে আমরা শুধু মোজা আর মাফলার কিনেছিলাম। সৈয়দপুর থেকে কম্বল কিনব বলে রাজশাহী থেকে নিয়ে যাওয়া হয়নি।

সৈয়দপুর এলাকায় ক্যাম্পাসের এক পরিচিত বন্ধুর মাধ্যমে খোঁজ নিলাম কোথায় ভালো কম্বল পাওয়া যায়। ওই বন্ধু তাঁর পরিচিত এক চাচার কম্বলের গোডাউনে নিয়ে গেলেন। পছন্দ করে সেখান থেকে আমরা নিলাম ২০০ কম্বল। তুলনামূলক তিনি আমাদের থেকে দাম কমই রাখলেন। কম্বলগুলোর ১০০টি বিতরণ করা হবে রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলায়। বাকি ১০০টি বিতরণ হবে পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া উপজেলায়।

পিকআপ ভাড়া করে মিঠাপুকুরের উদ্দেশে রওনা দিলাম। যখন মিঠাপুকুরের দিকে রওনা হলাম, তখন তাপমাত্রা ছিল প্রায় ১০-এর কোঠায়। হু হু করে বাতাস বইছে। পিকআপের গতির সঙ্গে বাতাসের বেগও বাড়তে শুরু করল। শীতে কাঁপুনি ধরে যাচ্ছিল সবার। অবস্থা এমন, পিকআপ থামিয়ে দিয়ে আগুন জ্বালিয়ে কিছুক্ষণ তাপ নিতে পারলে ভালো লাগত, কিন্তু আমরা নিরুপায়। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পৌঁছাতে হবে মিঠাপুকুরে। আমাদের মধ্যে একজনের জ্বরও ছিল। জ্বরকে মাথায় করে দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে আমাদের সঙ্গে একটা মহৎ কাজের সাক্ষী হতে চলছে সে। ঘণ্টা দুয়েকের ভ্রমণ করে আমরা পৌঁছালাম মিঠাপুকুর বাজারে। পিকআপভর্তি কম্বল আর আমাদের দেখে উৎসুক কয়েকজন জনতা চারপাশ ঘিরে দাঁড়াল। পূর্বপরিচিত ফরিদ আহমেদ ভাই আমাদের একটা স্কুলের ঘরে থাকার ব্যবস্থা করে দিলেন। রাতের খাবারের ব্যবস্থাও তিনি করে দিয়েছেন। স্কুলের তিনটি রুমে ভাগ হয়ে সেই কম্বলগুলো জড়িয়ে কোনো রকম রাতটা পার করলাম।

কুমিল্লা জেলা সমিতি (কুজেস) রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সদস্যরা শীতার্ত মানুষের পাশে। ছবি: লেখক
কুমিল্লা জেলা সমিতি (কুজেস) রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সদস্যরা শীতার্ত মানুষের পাশে। ছবি: লেখক

মিঠাপুকুর এলাকার বিধবা, প্রান্তিক সাঁওতাল এবং যে পরিবারগুলো আসলেই সাহায্য পাওয়ার মতো—এমন ১০০ জনের তালিকা আগেই করে রেখেছেন ফরিদ ভাই। পরদিন সকাল ১০টায় নদীর ধারে একটি স্থানে ওই তালিকার শীতার্ত মানুষ উপস্থিত হলেন। এক এক করে নাম ডেকে ‘উষ্ণতা’ বিতরণ করলাম সবার মধ্যে।

বিতরণের মাঝখানে হ্যান্ডমাইকে নাম ঘোষণা হচ্ছিল। এক বৃদ্ধা মাইকে কিছু বলতে চাইলেন। খুব আবেগজড়ানো কণ্ঠে তিনি বললেন, ‘বাহে হামার, এলাকায় এর আগেও বন্যা হচিল, বুক পর্যন্ত পানিত হামরা ডুবি যাওচিনো। এই বাবারাই হামাক তখন সাহায্য করচিল। এবারও এরায় আলচে। আল্লাহ তোমাক হায়াত দান করুক। তোমার অনেক সুনাম ইউক।’

দুপুরে খেয়ে বাসে করে পঞ্চগড়ের জন্য রওনা হয়েছি। বিকেল নাগাদ পৌঁছে যাই। সেখান থেকে একটা লোকাল বাসে চড়ে তেঁতুলিয়া গেলাম। আমাদের পরিচিত এক বন্ধুর বাবা তেঁতুলিয়া উপজেলার পরিষদের চেয়ারম্যান। উনি ওখানে আমাদের থাকার ও খাওয়ার ব্যবস্থা করলেন। পরদিন স্থানীয় একটি বালিকা বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষকের করা তালিকা অনুযায়ী ৮০ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে কম্বল বিতরণ করা হলো। তুলনামূলক সুবিধাবঞ্চিত ও মেধাবী শিক্ষার্থীরা এই লিস্টের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ওই দিনই ভোরবেলা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় ভাই তেঁতুলিয়া উপজেলার সহকারী কমিশনারের (ভূমি) সঙ্গে গ্রামে গ্রামে ঘুরে আমরা ২০ জন মানুষের কাছে কম্বল বিতরণ করি। উনার সঙ্গে কম্বল বিতরণের পদ্ধতি ছিল ভিন্ন। ওই পদ্ধতিতে প্রকৃত শীতার্তের হাতে কম্বল দেওয়া গিয়েছিল।

পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া উপজেলার একটি বালিকা বিদ্যালয়ের ৮০ শিক্ষার্থীর মধ্যে কম্বল বিতরণ করে কুমিল্লা জেলা সমিতি (কুজেস) রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। ছবি: লেখক
পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া উপজেলার একটি বালিকা বিদ্যালয়ের ৮০ শিক্ষার্থীর মধ্যে কম্বল বিতরণ করে কুমিল্লা জেলা সমিতি (কুজেস) রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। ছবি: লেখক

এ বিষয়ে জেলা সমিতির সভাপতি জামসেদ সবুজ বলেন, ‘আমাদের নৈতিক দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে শীতার্তদের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছি। আর আমি বিশ্বাস করি, মানবসেবা করতে বিত্তবান হয়ে হয় না, শুধু সদিচ্ছা থাকলেই হয়। আর ব্যক্তি যা পারে না, সংগঠন তা করে দেখায়। তাই প্রমাণ করেছে কুমিল্লা জেলা সমিতি, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।’ এ কাজে যাঁরা আমাদের সার্বিকভাবে সাহায্য করেছেন সবাইকে ধন্যবাদ জানান তিনি।

শাহীন আলম: শিক্ষার্থী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়