স্বচ্ছ সলিলা সুন্দরী শীতলক্ষ্যা

শীতলক্ষ্যায় মাঝিদের ব্যস্ততা। ছবি: অপু দেবনাথ
শীতলক্ষ্যায় মাঝিদের ব্যস্ততা। ছবি: অপু দেবনাথ

ভরদুপুরে সুনসান গোসিংগা বাজার। ঘাটে নোঙর ফেলা নৌকাটা দুলছে। বইঠা হাতে দোল খাচ্ছেন মাঝিও। রোদে পুড়ছে যাত্রীর অপেক্ষায়। এখানে বেশ প্রশস্ত নদীটা। ক্রমশ সরু হয়ে এগিয়েছে দক্ষিণে।

পানির কিনারায় আপন মনে চরে বেড়াচ্ছে গরুর পাল। দুপারে গাছপালায় ছাওয়া সড়ক। ফাঁকে ফাঁকে বসতি, বাজার। জলপ্রবাহ বেশ নিচে, মন্থর। ভরা বর্ষাতেও উপচে পড়ে না স্রোত। প্লাবিত হয় না অববাহিকা। তাই পাড় ভাঙার দুর্নামও নেই। এমন শান্ত নদী সচরাচর দেখা যায় না।

একটু ভাটিতে পশ্চিম পারে দস্যু নারায়ণপুর। কী অদ্ভুত নাম! কোনো দস্যুর নামে আর কোথাও কোনো জায়গার নাম আছে কি না, কে জানে! আরও খানিক ভাটিতে পশ্চিম পারেই কাপাসিয়া বাজার।

কার্পাসের জন্য জগদ্বিখ্যাত এই কাপাসিয়ার একটু ভাটিতে রানীগঞ্জ। নদীর অপর পারে পুরোনো ব্রহ্মপুত্রের একটা শাখা এসে মিলেছে। জায়গাটার নাম লাখপুর।

‘ঢাকার ইতিহাস’ গ্রন্থে যতীন্দ্রমোহন রায় লিখেছেন, ‘সম্ভবত লাখপুর গ্রামের নামের সহিত লাক্ষ্যা নদীর সম্বন্ধ বিজড়িত আছে।’

কার্যত কিশোরগঞ্জের টোকের কাছে পুরোনো ব্রহ্মপুত্র থেকে বেরিয়ে আসা স্রোতোধারা এই লাখপুর পর্যন্ত বানার নামেই পরিচিত। লাখপুর থেকেই তার নাম হয়েছে শীতলক্ষ্যা।

গোসিংগা বাজারের কাছে শীতলক্ষ্যা। ছবি: লেখক
গোসিংগা বাজারের কাছে শীতলক্ষ্যা। ছবি: লেখক

পুরাণ ও ইতিহাসে
স্বচ্ছ সলিলা এই স্রোতস্বিনীর পানি অতি নির্মল ও সুস্বাদু হওয়ায় শীতলক্ষ্যা নামে অভিহিত বলেও মনে করেন যতীন্দ্রমোহন রায়। আর স্থানীয় জনশ্রুতিতে, যে নদীর পানি শীতল ও লক্ষ্মী, তারই নাম শীতলক্ষ্যা। এই লক্ষ্মী নদীর বিশুদ্ধ পানির খ্যাতি একদা ছড়িয়ে পড়েছিল জগৎজুড়ে। জাহাজে জাহাজে যেত ‘পিওর শীতলক্ষ্যা ওয়াটার’–এর চালান। একসময় ইংল্যান্ডের কোম্পানিগুলো ওষুধ তৈরির কাজে এই নদীর স্বচ্ছ সুশীতল পানি ব্যবহার করত বলে বলা আছে জাতীয় তথ্য বাতায়নে।

কোনো শিল্পকারখানা গড়ে না ওঠায় এদিকটার পানি এখনো নির্মল। পারের অনেক বাসিন্দার ঘর-গৃহস্থালির অন্যতম পানির উৎস। এই শীতলক্ষ্যা ও ব্রহ্মপুত্রের সম্পর্ক নিয়ে পৌরাণিক আখ্যান আছে। তাতে, মহামুনি জমদগ্নির আদেশে পুত্র পরশুরাম কুঠারের আঘাতে বধ্‌ করেন নিজের মাকে। মাতৃহত্যার পাপে তাঁর হাতেই আটকে যায় সেই কুঠার। শত চেষ্টাতেও তা ছাড়াতে না পেরে হতাশ পরশুরাম বেরিয়ে পড়েন ব্রহ্মপুত্রের খোঁজে। একসময় পর্বতের নিম্নদেশে প্রবাহিত ব্রহ্মপুত্রের সন্ধান পেয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন। তাঁর হাত থেকে ছুটে যায় কুঠার।

একডালার পাশে শীতলক্ষ্যা। ছবি: লেখক
একডালার পাশে শীতলক্ষ্যা। ছবি: লেখক

তারপর পরশুরাম মহাপবিত্র সেই হ্রদের পানি মর্ত্যে পৌঁছে দেওয়ার মানসে কুঠারটি লাঙলাবদ্ধ করেন। চালিত করেন পর্বতের মধ্য দিয়ে। সেই লাঙল পর্বত ফুঁড়ে বেরিয়ে আসে। ব্রহ্মপুত্রকে চালিত করে সমভূমিতে। লাঙলের গমন পথে তৈরি হয় নদী। লাঙল এসে যেখানে আটকে যায়, তার নাম হয় লাঙ্গলবন্দ। যেখানে লাঙল থেমে যায়, তার পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন চঞ্চলা, যৌবনগর্বিতা, অনিন্দ্যসুন্দরী শীতলক্ষ্যা। তাঁকে দেখতে দুকূল ভেঙে ধাবিত হন ব্রহ্মপুত্র।
প্রবল পরাক্রমশালী ব্রহ্মপুত্রকে দেখে ভীত শীতলক্ষ্যা নিজের রূপ লুকিয়ে বৃদ্ধার বেশ নেন। নিজেকে উপস্থাপন করেন বুড়িগঙ্গারূপে। ব্রহ্মপুত্র তাঁকে বলেন, ‘মাতঃ, শীতলক্ষ্যা কত দূরে?’ জবাবে বৃদ্ধাবেশী বলেন, ‘আমারই নাম শীতলক্ষ্যা। আমি আপনার ভীষণ রবে ভীত হয়ে বৃদ্ধার বেশ ধারণ করেছি।’ এ কথা শুনে দ্রুত ধাবিত হয়ে শীতলক্ষ্যার অবগুণ্ঠন ছিঁড়ে ফেলেন ব্রহ্মপুত্র। তাঁদের মিলন হয়। এক স্রোতে মিশে যায় দুই নদী।

অপর এক আখ্যানে, জমদগ্নিরই অভিলাষ ছিল শীতলক্ষ্যার সঙ্গে ব্রহ্মপুত্র নদের সংযোগ সাধনের। তীর্থরাজরূপে জগতে শ্রেষ্ঠ করার। কিন্তু অজ্ঞাতসারে শীতলক্ষ্যার দর্শনাভিলাষে গমন করেন ব্রহ্মপুত্র। তারপর বৃদ্ধাবেশী শীতলক্ষ্যার প্রকৃত পরিচয় পেয়ে আগন্তুক হয়ে লাঙ্গলবন্দে প্রত্যাগমন করেন। ওদিকে ব্রহ্মপুত্রের এমন কাণ্ডে অসন্তুষ্ট হন পরশুরাম। তিনি অভিশাপ দেন। শুরু হয় ব্রহ্মপুত্রের অনুনয়। একসময় প্রসন্ন হন জমদগ্নি। বলে দেন, প্রত্যহ তীর্থরাজ না হয়ে বছরের এক অশোকাষ্টমীতে তীর্থরাজ হবে। গঙ্গায় অবগাহন করলে যে পুণ্যসঞ্চার বা পাপক্ষয় হয়, ব্রহ্মপুত্রের পশ্চিম কূলে স্নান করলেও তা হবে।

ডেমরা সেতুর কাছে শীতলক্ষ্যার কালো পানি। ছবি: লেখক
ডেমরা সেতুর কাছে শীতলক্ষ্যার কালো পানি। ছবি: লেখক

সেই থেকে প্রতি অশোকাষ্টমীতে ব্রহ্মপুত্র যখন তীর্থরাজ হন, তখন পৃথিবীর সব তীর্থ, নদী বা সাগর তার কাছে আসে। লাঙ্গলবন্দে তখন পুণ্যস্নানের ঢল নামে।

শীতলক্ষ্যার উজান ধারায় লাখপুরের একটু নিচেই তারাগঞ্জ। এখানে লম্বাটে একটা দ্বীপ গড়ে উঠেছে নদীর মাঝ বরাবর। নাম রাখা হয়েছে মাঝের চর। ওটা পেরোলেই পশ্চিম পারে একডালা।

যতীন্দ্রমোহন রায় লিখেছেন, মহারাজ বল্লাল সেন (প্রথম) একডালায় দুর্গ নির্মাণ করেন। সেন বংশীয় রাজাদের কেউ কেউ একডালাতে বাস করেই এই অঞ্চলে শাসন পরিচালনা করতেন। পরবর্তী সময়ে এখানে ছিল ঈশা খাঁর দুর্গ।

অনুবাদক, ইতিহাসবিদ ও গবেষক নুরুদ্দীন ফতেহপুরীর মতে, এখানে নদীর খাড়া পাড় অনেকটাই প্রাকৃতিক প্রতিরক্ষা প্রাচীর হিসেবে কাজ করত।

প্রাচীরের মতো সেই খাড়া পাড় ক্ষয় হতে হতে এখনো অনেকটাই খাড়া। গাছগাছালিতে ছাওয়া। পুরো এলাকাটাই ছায়াশীতল। এখনো মাটি খুঁড়লে পুরোনো ইট পাওয়া যায় নদী পাড়ে।

হাজীগঞ্জ দুর্গের কাছে শীতলক্ষ্যার ঘাট। ছবি: লেখক
হাজীগঞ্জ দুর্গের কাছে শীতলক্ষ্যার ঘাট। ছবি: লেখক

একডালা ছাড়িয়ে আরও ভাটিতে নামলে পশ্চিম পারে গাজীপুরের কালীগঞ্জ, পূর্ব পারে নরসিংদীর ঘোড়াশাল। ভাটিতে রূপগঞ্জ। তার নিচে ডেমরার কাছে বালু নদীকে বুকে নিয়ে দক্ষিণে এগিয়েছে শীতলক্ষ্যা। আদমজী জুট মিলস পেরিয়ে সিটি করপোরেশনকে দুই ভাগ করে বয়ে চলেছে। পূর্ব তীরে ঐতিহাসিক তীর্থ কদম রসুল, বন্দর থানা। পশ্চিম পারে মোগল আমলের স্মৃতিধন্য হাজীগঞ্জ দুর্গের ভাটিতে নারায়ণগঞ্জ বন্দর।

জাতীয় তথ্য বাতায়নে বলা হয়েছে, অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্ত নারায়ণগঞ্জ নামে কোনো নগরীর অস্তিত্ব প্রাচীন বাংলার মানচিত্রে পাওয়া যায় না। আগে এর নাম ছিল খিজিরপুর।

নারায়ণগঞ্জ বন্দরের কাছে শীতলক্ষ্যা। ছবি: অপু দেবনাথ
নারায়ণগঞ্জ বন্দরের কাছে শীতলক্ষ্যা। ছবি: অপু দেবনাথ

‘কিংবদন্তির ঢাকা’ গ্রন্থে নাজির হোসেন লিখেছেন, পলাশীর যুদ্ধের পর ভিকন ঠাকুর নামে এক প্রভাবশালী ব্যক্তি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পক্ষে এখানে কার্য পরিচালনা করতেন। তিনি এখানে নারায়ণচক্র প্রতিষ্ঠা করে একটি বাজার বসান। তাতে জায়গাটি পরিচিত হয়ে ওঠে নারায়ণগঞ্জ নামে।

যতীন্দ্রমোহন রায় লিখেছেন, মগদের মোকাবিলায় শায়েস্তা খানের আমলে শতাধিক রণতরি নারায়ণগঞ্জের বন্দরে মোতায়েন থাকত। এখান থেকে ইন্ডিয়া জেনারেল স্টিম নেভিগেশন কোম্পানির স্টিমার প্রতিদিন শিলশর যেত ব্রিটিশ আমলে। কলকাতা ও আসাম থেকে যাত্রী এবং মালামাল নিয়ে নারায়ণগঞ্জ নৌবন্দরে স্টিমার ভিড়ত। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য স্থানে ভ্রমণের একমাত্র পথ ছিল নারায়ণগঞ্জ নদীবন্দর। এ জন্য নারায়ণগঞ্জকে বাংলা ভ্রমণের প্রবেশদ্বার বলা হতো।

একসময় প্রাচ্যের ডান্ডি খ্যাত নারায়ণগঞ্জ এখনো দেশের অন্যতম নৌবন্দর। ভাটিতে টানবাজার, তারপর চাল-আটার অন্যতম বৃহৎ পাইকারি বাজার নিতাইগঞ্জ। উল্টো দিকে নবীগঞ্জ থানা, ঈশা খাঁর স্মৃতিধন্য সোনাকান্দা দুর্গের সামনে ইনস্টিটিউট অব মেরিন টেকনোলজি।

টানবাজার ঘাটে নোংরা পানিতেই গৃহস্থালি। ছবি: অপু দেবনাথ
টানবাজার ঘাটে নোংরা পানিতেই গৃহস্থালি। ছবি: অপু দেবনাথ

কিংবদন্তির সেই স্বচ্ছ সলিলা সুন্দরী নদীর পানি এদিকে শিল্পবর্জ্যে কালো। কার্যত ডেমরার উজান থেকেই পচতে থাকা পানির দুর্গন্ধ এদিকে আরও প্রকট। দূষিত ওই পানিতেই তবু বেজে চলেছে জীবনের গান। নোংরা পানিতেই চলছে কাপড় ধোয়া। ওই পানিতেই স্নান সেরে নিচ্ছে নারী-শিশুর দল। দুই পারে সারি সারি বহুতল, শিল্পকারখানা। আর গোটা নদীটাই যেন ওই কারখানাগুলোর খোলা নর্দমা।

শহরের সীমানা ছাড়িয়ে নদীপারে সবুজ খেত। দূষিত পানির সেচেই বেড়ে উঠছে শীতের সবজি। তাতে বাতাসের দামাল নাচ, রোদের হাসি। এ হাসিও শিগগির চাপা পড়বে পাকা দালান, কারখানার নিচে। স্থানে স্থানে গেড়ে রাখা সাইনবোর্ডে তারই চোখ রাঙানি।

সামনে ধলেশ্বরীর মোহনা। শীতলক্ষ্যা গিয়ে ওই ধলেশ্বরীতেই মুখ লুকিয়েছে। ১১০ কিলোমিটার দীর্ঘ প্রবাহ পথের ওখানেই আত্মাহুতি।

লেখক: ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক