অনুভূতিহীন এক জীবনের গল্প

দুর্ঘটনায় পা হারান মধুপুরের নূর নবী। ছবি: লেখক
দুর্ঘটনায় পা হারান মধুপুরের নূর নবী। ছবি: লেখক

‘আমার বড় মাইয়া জুলেখার জন্মের তিন বছর পর জন্ম ছোডডার। তখন ছোড পুরীর (ছোট মেয়ে) বয়স ১১ দিন। নাম রাহি নাই, আমার মায় পুরীর নাম রাখবো কইছিল। মালেক মিয়ার গ্যারেজ থেইকা ৬০ টেকা জমায় ভ্যান চালাইয়া সারা দিন দুই-তিন শ যা পাই, তা-ই দিয়াই বুড়া বাপ, মা, বউ, পোলাপাইন লইয়া কোনোমতে দিন পার করি।

‘হেদিন আছিলো শনিবার। ভুরবেলা আনারসের খ্যাপ লইয়া গেছি গারর বাজার। ফিরতে ফিরতে হেই বেলা তল হয়া গেছিল, বাড়িত থেইকা আব্বায় খবর আনছে জুলেখার মেলা জ্বর। হুইনাই মতিন ডাক্তরের দোকান গিয়া জ্বরের ওষুধ কিনা বাড়িত যাইতাছিলাম। এমন সময় আমার চাচাতো ভাই মকবুল কাডের (কাঠের) বেপারি, নেদুর বাজারে তার বড় কাডের টেক (অনেক কাঠ জড়ো করে রাখার জায়গা) আছে, হে ডাক দিয়া কইলো, মিয়া ভাই, আমারে দুইডা কাড টেরাকে তুইলা দেন। ছোড ভাই মানুষ, অর কথা ফালাই কেমনে? ১০ জন মানুষ মিলা বড় একটা আস্ত গাছের গুঁড়ি টেরাকে তুইলা দিতাছিলাম। আমি আছিলাম গাছের নিচে। হঠাৎ কইরা দড়ি ছিঁড়া পড়ার কারণে সবাই গাছের গুঁড়িটা ছাইড়া দিল, আর ধুরুম দিয়া গাছটা আয়া পড়লো আমার কোমরের উপরে। আমি লগে লগে বেহুঁশ হয়া গেলাম, মিয়া ভাই...।

‘হুঁশ হইয়া দেহি আমার সারা শরীর অবশ, জমিন-জিরাত, গরু-ছাগল যা আছিল সব বেইচা চিকিৎসা কইরাও আর ভালা হইলাম না। আমি বাঁইচা আছি না মইরা গেছি বুঝি না, আমার শরীরে কোনো ঠাহর (অনুভূতি) নাই। একদিন মেহনত কইরা রোজগার করতাম, অহন ভিক্ষা কইরা সংসার চালাই, অহন আমার ছোড পুরীডার বয়স ৪ বছর, মায় নাম রাখছে শেফালি।

এক জীবনের তাবৎ আক্ষেপ নিয়ে কথাগুলো বলছিলেন মধুপুরের নূর নবী (৪৫)। কয়েক বছর আগেও একজন কঠোর পরিশ্রমী মানুষ ছিলেন নূর নবী। ছোট্ট একটা সুখের সংসার ছিল। সারা দিন কাজ করে পরিবারের সদস্যদের জন্য দুমুঠো অন্ন জোগাড় হলেই তৃপ্তি পেতেন, যা এখন তাঁর কাছে কেবল শুধুই অনুভূতিহীন স্মৃতির দীর্ঘ কাফেলা।

মানুষের এই নশ্বর জীবন, কাকে কখন কোথায় নিয়ে যায়, তা কেবল সেই মানুষটাই জানেন। নূর নবী জীবনের এই হৃদয়বিদারক ঘটনা আহামরি কোনো জীবন গল্প না, এমন অসংখ্য নূর নবী আমাদের দেশে আছেন। তবে তাঁর একটি কথা সাংঘাতিকভাবে ভাবিয়ে তোলে, ‘অনুভূতিহীন জীবন’। সত্যিই যে জীবনের কোনো অনুভূতি নেই, সে আবার কেমন জীবন...? যে বাবা তাঁর প্রিয় সন্তানের স্পর্শে বুঝতে পারে না, সে আবার কেমন বাবা? কেমন হয় বাবার বুকের ভেতরের তীব্র যন্ত্রণাটুকু?

টাঙ্গাইলের মধুপুর উপজেলার শেষ সীমানায় মধুপুর চৌরাস্তা নামক গ্রামে নূর নবীর বাড়ি। চৌরাস্তার পরেই নেদুর বাজার, পুরো এলাকা মূলত বন এলাকা। কৃষি বলতে ধান, আনারসসহ মৌসুমি সবজির আবাদ করেই জীবিকা নির্বাহ করে এ এলাকার মানুষ। যাঁরা নূর নবীর মতো অতি দরিদ্র, তাঁরা ভ্যানগাড়ি, ঠেলাগাড়ি, মহিষের গাড়ি চালানোসহ অন্যের জমিতে কামলা দেন।

দুর্ঘটনার পর নিজের চিকিৎসার খরচ জোগাতে সহায়সম্বল সব বিক্রি করে এখন নিঃস্ব নূর নবী। তবু জীবন কি পিছু ছাড়ে। পরিবারের ক্ষুধার্ত মুখের দিকে তাকিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছেন তিনি।

এখনো সপ্তাহের নির্দিষ্ট দিন হাটবারের প্রচলন রয়েছে গ্রামের বাজারগুলোয়। পুরো সপ্তাহের বাজারসদাই কিনতে হাটে আসে মানুষ। লোকসমাগম বেশি হয় বলে মধুপুর উপজেলার মটের বাজার, গারোর বাজার, নেদুর বাজারসহ বেশ কয়েকটি হাটে ভাঙা নড়বড়ে হুইলচেয়ারটি নিজে নিজেই ঠেলে সাহায্য তুলতে যান নূর নবী। প্রতিদিন ২০০ থকে ২৫০ টাকা পান। তা-ই দিয়েই চলে নূর নবীর সংসার।

পিচঢালা পথ ধরে হুইলচেয়ারের নয় জীবনের চাকা ঘোরাচ্ছেন নূর নবী। ছবি: লেখক
পিচঢালা পথ ধরে হুইলচেয়ারের নয় জীবনের চাকা ঘোরাচ্ছেন নূর নবী। ছবি: লেখক

নেদুর বাজারের মুদির দোকানদার আবদুল মালেক বলেন, ‘নূর নবী খুব পরিশ্রমী একটা মানুষ আছিলো। একটা আঘাত তাঁর জীবনডাই শেষ কইরা দিল। তাও ভালা আল্লাহ পাক তারে বাঁচায়া রাখছে।’

কোনো এক শুক্রবারের ভরদুপুরে মধুপুরের রাস্তায় নূর নবীর সঙ্গে আমার দেখা। চা খেতে খেতে কিছুক্ষণ কথা বলবার সুযোগ হয়েছিল। তাঁর খুব বেশি কিছু ব্যক্তিগত জীবনের গল্প শুনতে চাইনি। কেননা, এমনিতেই কথা বলে এই জীবনসংগ্রামী মানুষটির সময় নষ্ট করেছি। তবু শেষ একটি প্রশ্ন আমি বরাবরই এমন জীবন বয়ে বেড়ানো লোকজনকে করে থাকি, নূর নবীকেও করেছি।

জীবনে কী ইচ্ছা ছিল, যা পূরণ হলো না আজও?

চোখ মুছতে মুছতে নূর নবী বলেন, ‘কিছু না, দোয়া কইরেন আমি যেন ভালা হইয়া যাই, মিয়া ভাই...।’ এই বলে পিচঢালা রাস্তাটা ধরে হুইলচেয়ারের চাকা ঠেলতে ঠেলতে হাটের দিকে চলে যেতে থাকেন। শুধু পড়ে রইল অনুভূতিহীন এক জীবনের গল্প।