ক্যানসারজয়ী এক বাবার গল্প

বাবা যখন ক্যানসারের সঙ্গে জীবন–মরণ লড়াই করেন, তখন আমি ক্লাস সিক্সে পড়ি। ক্যানসার কী, তা জানতাম না। শুধু বাড়ির এবং এলাকার মানুষদের মুখে শুনতাম, বাবা আর বেশি দিন বাঁচবেন না। পেশায় পল্লিচিকিৎসক বাবা গ্রামের মানুষের চিকিৎসাসেবা প্রদান পবিত্র দায়িত্ব বলে মনে করতেন। চিকিৎসক হয়েও কখনো বুঝতে পারেননি যে তিনি নিজের শরীরে ক্যানসারকে লালন করে আসছেন।

২০০৬ সাল, হঠাৎ টিউমারজাতীয় একটা কিছু দেখা দিলে তিনি নিজের প্রেসক্রিপশনের ওষুধ খেয়ে একরকম সুস্থ হয়ে যান। পুনরায় একই সমস্যা দেখা দিলে যথারীতি ঝাড়ফুঁক এবং পানিপড়া নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। এভাবেও যখন সুস্থ হচ্ছেন না, তখন শরণাপন্ন হলেন গ্রামের এক কবিরাজের কাছে।

কবিরাজ বাবার অসুস্থতাকে অর্শ্ব বা গেজ–জাতীয় একটা রোগ বলে বেশ কিছু মলম দেন। এভাবে আরও কিছুদিন চলার পর দেখলেন রোগের ধরনটা অন্য রকম। তাই, মলম বন্ধ করে আমাদের জেলা শহরের কয়েকটা হাসপাতালে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হলেও তাঁরা রোগ শনাক্ত করতে পারেননি। চিকিৎসকের পরামর্শক্রমে ঢাকায় এসে হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা নেওয়া শুরু করেন। এক–দুই মাস পরপর বাবা ঢাকায় এসে ওষুধ নিয়ে যেতেন। ওষুধের মূল্য, যাতায়াত ভাড়া ও আনুষঙ্গিক সব খরচ মিলিয়ে অনেক টাকার প্রয়োজন হতো, যা বাবার পক্ষে বহন করা খুবই কষ্টসাধ্যই ছিল। তবু বাবা ধারদেনা করে এসে ওষুধ নিয়ে যেতেন। প্রায় এক বছর হোমিওপ্যাথি খাওয়ার পরও কোনো উন্নতি হচ্ছিল না।

২০০৭ সালের মধ্যবর্তী সময়ে হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা বন্ধ করে বাবা ঢাকার গ্রিনরোডের একটি বেসরকারি হাসপাতালের এক চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন। চিকিৎসক রোগ শনাক্ত করতে পারেননি। পরবর্তী সময়ে অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর চিকিৎসকেরা উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছেন যে বাবা প্রাণঘাতী রোগ ক্যানসারের শিকার হয়েছেন। বাবার যে ক্যানসার হয়েছে, তা ‘র‌্যাকটাম ক্যানসার’। চিকিৎসকের পরামর্শক্রমে বাবা ‘জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে’ ভর্তি হন। তত দিনে ক্যানসার বাবার শরীরে অনেকটা ছড়িয়ে গেছে। চিকিৎসক বললেন, হোমিওপ্যাথি খাওয়ার ফলে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। পরবর্তী সময়ে চিকিৎসক জানালেন, বাবার ক্যানসার তত দিনে গ্রেড-২–এ পৌঁছে গেছে। তখন আমি অনেক ছোট ছিলাম। ক্যানসার সম্পর্কে সুস্পষ্ট কিছু জানতাম না। গ্রামের অনেক মানুষ বলাবলি করতেন, বাবা আর বাঁচবেন না। চিকিৎসায় অর্থ ব্যয় না করে, তা দিয়ে বাজার-সদাই করে আমাদের খাওয়ার পরামর্শও দেওয়া হতো। তখন গ্রামের অনেক মানুষ সান্ত্বনা দেওয়া তো দূরের কথা উল্টো মনোবল ভেঙে দিতেন। কিন্তু আমার মা হাল ছাড়েননি, কারণ হাল ছেড়ে দেওয়া মানেই তো জীবন ছেড়ে দেওয়া। অথচ তখন একজন রোগী ও তাঁর পরিবারের জন্য এ সময়ে পর্যাপ্ত কাউন্সেলিং এবং ভালো পরামর্শ খুবই জরুরি।

পরবর্তী সময়ে মা ঢাকায় এলেন, বাবার কাছে। শুরুর দিকে হাসপাতালের বারান্দায় কিংবা পাশের হোটেলে ভাড়া রুমে থেকে চিকিৎসক দেখাতেন। পরে তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করালেও হাসপাতালের অপর্যাপ্ত বেড ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে এত মুমূর্ষু রোগী নিয়ে থাকা সম্ভব হচ্ছিল না। কিছুদিন হাসপাতালে থাকার পর এক নার্সকে এ ব্যাপারে অবগত করলে তিনি মোহাম্মদপুরে অবস্থিত ‘দিগন্ত মেমোরিয়াল ক্যানসার হোমের’ ঠিকানা দিলেন। দিগন্ত ক্যানসার হোমে আসার পর থেকে নিয়মিতভাবে ডাক্তার দেখাতে লাগলেন। কিন্তু আব্বুর অবস্থা তখনো আগের মতোই। এভাবে কয়েক দিন হাসপাতালে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার পর ডাক্তার বললেন ২৮টি রেডিওথেরাপি দিতে। ২৮টি রেডিও থেরাপি দেওয়া শেষ হয়। তখন তাঁর অবস্থা একটু উন্নতির দিকে। আবার ডাক্তারের কাছে যাওয়ার পর ডাক্তার ৬টি কেমোথেরাপি দেওয়ার জন্য বলেন, যা অত্যন্ত ব্যয়বহুল ও সময়সাপেক্ষ। অনেক কষ্ট করে কেমোথেরাপির খরচ জোগাড় করে ৬টি কেমোথেরাপি দেওয়া হয়। কিন্তু একেবারেই হাঁটাহাঁটি করতে পারেন না। পরবর্তী সময়ে ডাক্তার জানালেন, বাবার পায়ুপথে অপারেশন করতে হবে এবং এটাও জানিয়ে দিলেন, বাবার পায়ুপথ চিরদিনের জন্য কেটে ফেলে দিয়ে সেখানে ‘কলোস্টমি ব্যাগ’ করে দেবেন।

২০০৯ সালের শুরুর দিকে বাবার অস্ত্রোপচার করা হলো। অপারেশন–পরবর্তী সময়ে আরও তিনটি কেমোথেরাপি দেওয়া হয়। তাঁর অবস্থা তখন অনেকটা উন্নতি হয়েছে। চিকিৎসক বলেছেন, এখন তিনি শঙ্কামুক্ত। চিকিৎসার সময়ে মা সব সময় বাবার সঙ্গে ছিলেন এবং তাঁকে নিরবচ্ছিন্ন সেবা এবং মনোবল জোগাতেন।

ক্যানসারের আক্রান্ত একজন রোগীর জন্য চিকিৎসার পাশাপাশি মনোবল জোগানোটা খুবই জরুরি। কেননা, একজন রোগীর আত্মবিশ্বাস তাঁকে রোগমুক্তির ক্ষেত্রে অনেকটা সহায়তা করে। বর্তমানে উপযুক্ত কাউন্সেলিংয়ের অভাবে অধিকাংশ রোগী সময়মতো উপযুক্ত চিকিৎসা গ্রহণ করতে পারেন না।

ক্যানসারের কারণে একজন রোগী তাঁর জীবনের রঙিন অধ্যায়ের ইতি টেনে থাকেন। হারিয়ে ফেলেন তাঁর জীবনের একটা অংশ। ঠিক তেমনটা আমার বাবাও। থেরাপির পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় তাঁর অনেক স্বাদ-আহ্লাদ বিসর্জন দিতে হয়েছে।

বাংলাদেশে ক্যানসারে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা নেহাতই কম নয়। সচেতনতা এবং গ্রামাঞ্চলে পর্যাপ্ত হাসপাতালের অভাবে নারীদের জরায়ু ক্যানসার, স্তন ক্যানসার এবং পুরুষদের ফুসফুস ক্যানসার, কোলন ক্যানসারসহ ব্লাড ক্যানসারে আক্রান্ত শিশুর সংখ্যা দিনদিন বেড়েই চলছে। ক্যানসার হাসপাতালে গেলে রোগীদের চিৎকার আপনাকে মর্মাহত করবে। তা ছাড়া ওষুধের অত্যধিক মূল্যসহ সরকারি হাসপাতালগুলোয় দালালের উপদ্রব এবং চিকিৎসকদের বেসরকারি ক্লিনিকমুখী হয়ে যাওয়ার কারণে অধিকাংশ মানুষ ক্যানসারের ফলাফল মৃত্যুকে মেনে নিতে বাধ্য হন। তাই জেলা শহরের সরকারি হাসপাতালগুলোয় ক্যানসার ইউনিট খোলা এবং ক্যানসারসহ সব ভয়াবহ রোগের ওষুধের মূল্য হ্রাস এবং ক্যানসার নির্মূলে ব্যাপক সচেতনতা কার্যক্রম গ্রহণ করার জন্য সংশ্লিষ্ট মহলের প্রতি আকুল আহ্বান জানাই।

লেখক: সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকটিভিস্ট
[email protected]