পাহাড়িয়া গল্পকথন

পাবর্ত্য জেলাগুলো ঘোরার জন্য চাঁদের গাড়ির কোনো বিকল্প নেই। ছবি: লেখক
পাবর্ত্য জেলাগুলো ঘোরার জন্য চাঁদের গাড়ির কোনো বিকল্প নেই। ছবি: লেখক

আমি বাসে সাধারণত ঘুমাই না। এমনকি এসি বাসে কম্বল মুড়ি দিয়েও। সারা রাত চোখ বন্ধ করে থাকার পর শেষ রাতের দিকে একটু ঘুমিয়েই পড়েছিলাম। ভোররাতে যখন ধড়ফড়িয়ে উঠে বাসের জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম, তখন দেখি সারি সারি পাহাড়! পার্বত্য জেলা বান্দরবান। অবশেষে চলেই এলাম!

অনেক দিন আগে থেকেই ইচ্ছা ছিল কোথাও ঘুরতে যাব। কিন্তু হয়ে উঠছিল না। শেষে একদম হুট করেই টিকিট কাটা হয়ে গেল। এরপর রাত ১২টার সেন্টমারটিন হুন্দাইয়ে (বান্দরবানে যাওয়ার ওয়ান অব দ্য বেস্ট বাস সার্ভিস, আমার অভিজ্ঞতায়) চড়ে গন্তব্যে পাড়ি জমালাম। অতঃপর সকাল ৬টা ২০ মিনিটে পৌঁছালাম। এবারে হোটেল খোঁজার পালা। ঢাকায় বসেই বুকিং দিতে চেয়েছিলাম। তাতে খরচ অনেকটাই বেশি। পরে ফেসবুকের ট্রাভেল গ্রুপগুলোতে গিয়ে দেখি যে অনেকেই লিখেছে খুব বিলাসীভাবে যদি থাকতে না চান, তবে অগ্রিম বুকিং না দিয়ে একটু খুঁজলেই ভালো হোটেল পাওয়া যায়। আমরা পেয়েও গেলাম। শহরের একদম মূল সড়কটির পাশেই পেয়ে গেলাম ‘হোটেল হিল কুইন’। বাসস্ট্যান্ড থেকে ১৫–২০ টাকা রিকশাভাড়া। চাইলে হেঁটেও যাওয়া যায়।

হোটেলে জিনিসপত্র রেখেই দ্রুত সকালের নাশতা সেরে নিলাম। এরপর ট্যুর প্ল্যান অনুযায়ী বগা লেকের উদ্দেশে রওনা হলাম। আমাদের প্রথম গন্তব্য রুমা বাজার। আমরা একটি সিএনজি নিলাম। আপনার দল ভারী থাকলে চাঁদের গাড়ি নিতে পারেন। এতে খরচ কম পড়বে আর দুই পাশের মোহিনী সৌন্দর্যও দেখতে পারবেন মন ভরে। রুমা বাজারে যাওয়ার পথে বুঝলাম বান্দরবান কতটা দুর্গম এলাকা। পথের সৌন্দর্য যেমন মুগ্ধ করছিল, তেমনি বেশ ভয়ও লাগছিল। আমরা তিনটি মেয়ে আর সঙ্গে মাত্র একজন ছেলে, সুতরাং ভয়টা একটু বেশি লাগারই কথা। তবে ভরসা ছিল, এখানে জায়গায় জায়গায় সেনাবাহিনীর চেক পয়েন্ট আর কড়া পাহারা। যেতে যেতে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর অনেক মানুষের সঙ্গে দেখা হলো। ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী ছোট বাচ্চারা খুব প্রাণোচ্ছল। ওরা নতুন মানুষ দেখলে হাত নেড়ে স্বাগত জানায়। আমাদেরও জানাচ্ছিল। চলতি পথে বেশ কয়েকটি ছোট বাজার পড়ল। সেখানে দেখলাম কেউ বা কতগুলো বরবটি, কেউ বেগুন, কেউ মুলা বিক্রি করছেন। সব বাজারেই দুটি কমন জিনিস। কলা আর পেঁপে। পাহাড়ি কলা আর পেঁপের স্বাদ অতুলনীয়! বান্দরবান গেলে এই দুটি জিনিস অবশ্যই মিস করবেন না। কলা চাষ পাহাড়িদের আয়ের অন্যতম প্রধান উৎস। রুমা বাজারে যাওয়ার পথে দুই পাশে যে পাহাড়গুলো দেখা যায়, তার প্রায় সব কটিতেই রয়েছে কলাগাছের সারি। সিএনজিচালিত অটোরিকশা থেকে বারবার বাইরে তাকাচ্ছিলাম। আশা...ইশ্‌...একটি হাতির দেখা যদি পাই!

হাতির দেখা না পেলেও গহিন বনে উপজাতিদের ঝুপড়িগুলো দেখে মিশ্র অনুভূতির জন্ম নিল। একবার মনে হচ্ছিল, ওরা কি অমানবিক কষ্ট করে জীবন নির্বাহ করে। প্রতিদিন কলা, ফল, সবজি, লাকড়ি—এগুলো ঝুড়িবোঝাই করে মাথায় বা পিঠে চাপিয়ে নিয়ে মাইলের পর মাইল দুর্গম পথ পাড়ি দেয়! আবার মনে হচ্ছিল, ওরা অনেকেই শহরে যায়নি। তাতে কি? ওদের প্রয়োজনও পড়েনি। দিব্যি হেসেখেলে জীবন কাটাচ্ছে! সবকিছু ছাপিয়ে যে অনুভূতিটা জেঁকে বসেছিল, তা হলো সংসারের মায়া ত্যাগ করা। বিশাল বিশাল পাহাড়ের নিস্তব্ধতা যেন দুহাত বাড়িয়ে ডাকছিল। চুম্বকের মতো আকর্ষণ করছিল। মনে হুচ্ছিল, সবকিছু ছেড়ে দিয়ে এই পাহাড়ের চূড়ায় গিয়ে বাস করি। অথবা মিশে যাই ওই সহজ–সরল হাসিমাখা মুখের উপজাতিদের ভিড়ে...! পাহাড়ের নিস্তব্ধতার আছে এক সম্মোহনী শক্তি। এটা বলে বোঝানোর মতো নয়। শুধু অনুভব করা যায়।

অবশেষে আমরা রুমা বাজারে পৌঁছালাম। এখানে তুলনামূলক ঘনবসতি। বান্দরবান সদরের পর সম্ভবত এ জায়গাটাতেই সবচেয়ে বেশি মানুষ বসবাস করে। যাহোক, রুমা বাজারে দেখলাম নানা জিনিসের পসরা। চায়ের দোকান থেকে শুরু করে বার্মিজ স্টল সব রয়েছে সেখানে। দুপুরে ওখানেই একটা হোটেলে ভাত খেলাম সাঙ্গু নদের ছোট মাছ দিয়ে। আহ...একেই বুঝি বলে অমৃতের স্বাদ!

রুমা আসার পথে সাঙ্গু নদ দেখতে থেমেছিলাম। সাপের মতো এঁকবেঁকে চলা নদটা যেন আরেক সম্মোহনী সৌন্দর্যের আধার! মুগ্ধ হয়েছিলাম সেই সৌন্দর্যে।

বগা লেক। ছবি: লেখক
বগা লেক। ছবি: লেখক

এবারে চাঁদের গাড়িতে করে বগা লেক যাওয়ার পালা। এবার আমরা চারজনের একটা ট্রাভেলার গ্রুপ পেলাম। ওরা বেশ মজার। আটজনের এই দলটি বেশ ভালোই ছিল। রুমা বাজারের চেকপয়েন্টে সাইন করে সবাই গাড়িতে চেপে বসলাম। একটু দূর এগোতেই পেলাম ঝুলন্ত সেতু। সেখানে কিছুক্ষণ ফটোসেশন চলল। খেয়াল করলাম মেয়েদের চেয়ে ছেলেরাও এখন এদিক দিয়ে কম যায় না!

বগা লেক যাওয়ার রাস্তাটা যেমন সুন্দর, তেমন ভয়ংকরও! খাড়া পাহাড়ের ঢাল বেয়ে ওঠা আবার নামা! উঠতে গেলে মনে হয় এই বুঝি পিছলে নিচে পড়ে গেলাম, আবার নামতে গেলে মনে হয় এই বুঝি ব্রেক ফেল হয়ে গেল! তবে সবাই মিলে তারস্বরে চিৎকার করলে অবশ্য অতটা ভয় লাগে না! ঠিক রোলারকোস্টারে চড়ার মতো! সবচেয়ে বড় ঢালটা ৮০ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলের তো হবেই। এখান দিয়ে ওঠার সময় গাড়ির হ্যান্ডেল শক্ত করে ধরে ফেলতে হবে। আপনি যদি শক্ত হার্টের না হন, তবে চোখ বন্ধ করে ফেলুন! তবে আই বেট-এটা করলে আপনি মিস করবেন!

বগা লেকে যাওয়ার সময় রোদ ঝলমল করছিল। চকচকে সবুজে ভরা প্রকৃতি আর সাদা মেঘ উড়ে বেড়ানো নীল আকাশ মনকে আনন্দে ভরে দিচ্ছিল। আমাদের সময় বেঁধে দেওয়া হলো আড়াই পর্যন্ত। কারণ পাঁচটার আগেই চেকপয়েন্টে হাজিরা দিয়ে বের হতে হবে যদি রাতে না থাকি। সুতরাং আমাদের হাতে খুব বেশি সময় নেই। গাড়ি থেকে নেমে সরাসরি বগা লেকের পাড়ে গেলাম। নীল শাপলা চোখে পড়ল। ওপর থেকে বোঝার উপায় নেই যে পাহাড়ের গহিনে এ সৌন্দর্য লুকিয়ে আছে। চারপাশের গাছগুলো লেকটাকে যেন গুপ্তধনের মতো লুকাতে চাইছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা তাকিয়ে থাকা যায় ওই শান্ত মৃদু ঢেউখেলানো পানির দিকে। কেউ কেউ দেখলাম জামাকাপড় নিয়ে গোসলের জন্য তৈরি হয়ে আছে।

এখান থেকে সাড়ে তিন ঘণ্টা ট্র্যাকিং করলে কেওকারা ডং। আমাদের ওখানে যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল না। তবে আমরা ওই পথেই অনেক দূর ট্র্যাকিং করলাম। নিচে পিচঢালা রাস্তা আর ওপরে সবুজ গাছের ফাকে নীল আকাশ, রাস্তার দুই পাশে নানা রকমের বুনো ফুলের ঝোপঝাড়।

দলবেঁধে এখন অনেকেই পাহাড়ে ঘুরতে যান। ছবি: লেখক
দলবেঁধে এখন অনেকেই পাহাড়ে ঘুরতে যান। ছবি: লেখক

বগা লেকের আশপাশে উপজাতিদের বেশ কিছু দোকান, হোটেল ইত্যাদি রয়েছে। এখানে চাইলে রাতে থাকা যায়। রাতের বেলা চাঁদের আলোয় নাকি লেকের আসল সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়।

এবার ফেরার পালা। রুমা বাজার পার হয়ে সদরে যাওয়ার রাস্তাটাকে এখন আর অত ভয়ংকর মনে হলো না। বরং কেমন যেন একটা অনুভূতি পেয়ে বসছিল। বারবার মনে হচ্ছিল কী যেন রেখে যাচ্ছি...! মন খারাপ করে দেওয়া একটা অনুভূতি।

পাহাড়ের আকর্ষণ, পাহাড়ের সম্মোহন...বারবার পিছু ডাকে।
দূর থেকে আলোকচ্ছটা চোখে পড়ছে। হ্যাঁ, পৌঁছে গেছি সদরে।

সহকারী শিক্ষক, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়
প্রাক্তন শিক্ষার্থী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা

লেখক: সহকারী শিক্ষক, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, সাবেক শিক্ষার্থী, জাবি