যে শহরে পোড়ে রুবিনা-সুরভিদের স্বপ্ন

মাত্র কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে চোখের সামনেই পুড়ে ছারখার হয়ে গেল রুবিনা আর ছোট বোন সুরভির স্বপ্নগুলো। ছবি: লেখক
মাত্র কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে চোখের সামনেই পুড়ে ছারখার হয়ে গেল রুবিনা আর ছোট বোন সুরভির স্বপ্নগুলো। ছবি: লেখক

‘আমার জ্ঞান হওনের পরে থেইক্কা দেখি আব্বায় প্রতিবন্ধী, আমার বড় চার ভাই, তহনো সুরভির জন্ম হয় নাই। আম্মায় সকালে মাইনসের বাড়িত কামে যায় আর আয়ে সন্ধ্যায়। সারা দিন কাম কইরা দুই সের চাইল পায়, কাফরের আচলে বাইন্দা হেই চাইলগুলাইন ভাত রাইন্ধা আমগরে মায় খাওয়াত। শইল্যের রক্ত পানি কইরা মায় খাওয়াইছে, পিন্দাইছে কামাই কইরা আমগরে। ভাইগুলাইন লেখাপড়া করে নাই, খুব ইচ্ছা আছিলো লেখাপড়া করমু, চাকরি কইরা সংসারের হাল ধরমু। কিন্তু পেটে খিদা লইয়া আর কতদূর পড়তে পারি, ক্লাস নাইন পর্যন্ত পড়ছি অভাবের লাইগা আর পড়তে পারলাম না। মায়ও কাম কইরা যে টেকা পায়, তা দিয়া সংসার চালাইতে পারতাছে না। তাই মার ইচ্ছায় আমরা সবাই গেল সপ্তাহে ঢাকায় আইসা এই বস্তির একটা ঘর ভাড়া নিয়া সবাই মিলাঝিলা থাকতে শুরু করি। মায় দুইডা বাসায় ছুডা বুয়ার কাম পাইছে, ভাইগুলাইন কাম খুঁজতাছে। আমি ভাবতাছিলাম গার্মেন্টসে কাম নিমু, লগে লেখাপড়াও করমু, সুরভিরে ভর্তি করাইছি ক্লাস ফাইভে, স্কুলে নতুন বই পায়া বইনটা মেলা খুশি হইছিল। গত রাইতে সবাই যহন ঘুমে, তহন মায় আগুন আগুন কয়া চিল্লাই উঠল, ঘর থেইকা সবাই বাইরে আয়া দেহি আগুন আর আগুন। মনে অইছিল কিয়ামত হইতাছে, এত বড় আগুন জীবনে দেহিনাই, চোখের পলকে আমার মার নতুন সংসারের সব পুইড়া ছাই হয়া গেল, সুরভির বইগুলাইন পুইড়া গেছে। অহন কই যামু আমরা, মায় কানতে কানতে আধা পাগল, আব্বার মুখে কথা নাই, ভাইগুলাইন দুইডা খাবারের লাইগা পাগলের মত কাম খুঁজতাছে...’

কতইবা হবে বয়স, কতটুকুই–বা দেখেছে জীবনে? তবুও হৃদ্‌পিণ্ড থেকে যেন ঝাঁজালো বিষের মতোই একনিমেষে উগলে দিল তার এক জীবনের সব তিক্ত আক্ষেপ। ১৫ বছরের এই কিশোরীর নাম রুবিনা।

মাত্র কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে চোখের সামনেই নাগরিক শহরে পুড়ে ছারখার হয়ে গেল পরিবারকে নিয়ে দেখা রুবিনা আর তার ছোট বোন সুরভির স্বপ্নগুলো। ভোলার বোরহানউদ্দিনের উদয়পুর বাজারের প্রতিবন্ধী ইসলাম মিয়া ও ময়নুল বেগমের চার ছেলে আর দুই মেয়ের মধ্য বড় মেয়ে রুবিনা এবং ছোট মেয়ে সুরভি। ঘর পুড়ে যাওয়ায় খোলা আকাশের নিচে ঠাঁই হয়েছে রুবিনা আর সুরভিসহ গোটা পরিবারের।

আগুনে পুড়ে সব হারিয়ে বিলাপ করছেন জাহানারা বেগম। ছবি: লেখক
আগুনে পুড়ে সব হারিয়ে বিলাপ করছেন জাহানারা বেগম। ছবি: লেখক

রুবিনার মা ময়নুল বেগম অশ্রুসিক্ত হয়ে বলেন, ‘নিজে তো অন্যের বাড়ি ঝিয়ের কাম কইরা জীবনডা কয়লা করছি, বাপ তো থাইকাও নাই। কত আশা লইয়া আইছিলাম ঢাকায়, পোলারা কাম করব, মেয়া দুইডারে লেহাপড়া করাইয়া ভালা গরে বিয়া দিমু, গেরামে ঘরবাড়ি করমু। আহ আর কিছুই হইল না।’

তবুও ভেঙে পড়তে রাজি নয় রুবিনা, সে এ শহরেই ১০টা কিশোরীর মতো বেড়ে উঠতে চায় সমানতালে, ঘুরে দাঁড়াতে চায় আবার। লেখাপড়া করে চাকরি করতে চায় এবং ছোট বোন সুরভির লেখাপড়ার খরচ চালানোর জন্য একটা চাকরির সন্ধান চালিয়ে যেতে চায় পাশাপাশি।

সেফালির পরিবারে আছে বাবা, মা, ভাই, বোনসহ আট সদস্য। অনাহারে আছেন সবাই। ছবি: লেখক
সেফালির পরিবারে আছে বাবা, মা, ভাই, বোনসহ আট সদস্য। অনাহারে আছেন সবাই। ছবি: লেখক

গত শুক্রবার আনুমানিক মধ্যরাতে বনানীর টিঅ্যান্ডটি কলোনির পাশের বস্তিতে আগুন লেগে পুড়ে গেছে বস্তির অনেকগুলো ঘরবাড়ি। ঘরবাড়ি হারিয়ে ভিটায় পুড়ে যাওয়া টিন, আসবাবের কয়লার ওপর বসে আহাজারি করছে হাজারো মানুষ। এ আহাজারি দেখতে জনতার উপচেপড়া ভিড় যেন লোকে লোকারণ্য পোড়া ঘরবাড়িগুলোর ওপরে। কোথায় যাবে এই মানুষগুলো। কী খাবে, কী পরবে—সবই যেন অনিশ্চিত এই ভাগ্যান্নেষী মানুষগুলোর কপালে এখন। সংশ্লিষ্ট মহলগুলো থেকে নানান আশ্বাসের কথা মিললেও আদতে সবারই এখন অবধি শূন্য হাত ছড়ানো পোড়া মাটির ওপরেই। সারা বস্তি ঘুরে খুঁজে পাওয়া যায়নি একটি অক্ষত ঘর, কোথাও স্তূপাকারে পড়ে আছে পোড়া বই, রান্নার ডেকচি, কলস, পোড়া জামাকাপড়ের স্তূপ, সারা বস্তির অলিগলি দাবড়ে বেড়ানো একটা দুরন্ত শিশুর পুড়ে যাওয়া ছোট্ট বাইসাইকেল।

অদূরেই বসে বিলাপ করছেন ৫০ বছর বয়সী জাহানারা বেগম। দৃষ্টি এড়ানো গেল না কোনোভাবেই। আগুনে পুড়ে গেছে তাঁর সব, কাপড়ে আগুন লেগে যাওয়ায় জীবন বাঁচাতে শাড়ি খুলে ফেলে জীবন রক্ষা করেন তিনি। অন্য একজনের পোশাক পরে থাকা জাহানারা বেগমের চোখে এখন শুধুই অন্ধকার।

বস্তির অলিগলি দাবড়ে বেড়ানো দুরন্ত এক শিশুর পুড়ে যাওয়া ছোট্ট বাইসাইকেল। ছবি: লেখক
বস্তির অলিগলি দাবড়ে বেড়ানো দুরন্ত এক শিশুর পুড়ে যাওয়া ছোট্ট বাইসাইকেল। ছবি: লেখক
কোথাও স্তূপাকারে পড়ে আছে পোড়া বই। ছবি: লেখক
কোথাও স্তূপাকারে পড়ে আছে পোড়া বই। ছবি: লেখক

জাহানারা বেগম বলেন, ‘গত রাইতে ঘুমের মধ্য লাফ দিয়া উইঠা দেহি, কাফরের আঁচলে আগুন, জীবন বাঁচানের লাইগা, গতর থেইকা কাপড় খুইলা ফেলাই। গত রাইতে খাইছিলাম, সারা দিন খাওন–পানি নাই, শইল্যের জামাডা আরেকজনে দিছে পিন্দনের লাই। আল্লারস্তে আমগরে কিছু খাওন দেন, থাহার জায়গা দেন বাবা, শীতের কম্বল দেন।’

এরপর কথা হয় সেফালির পরিবারের সঙ্গে। সেফালির পরিবারে মা–বাবা, ভাইবোন মিলে সদস্য আটজন। অনাহারে থাকা এ মানুষগুলোর জন্য আকুতি তার।

পুরো বস্তি ঘুরে খুঁজে পাওয়া যায়নি একটিও অক্ষত ঘর। ছবি: লেখক
পুরো বস্তি ঘুরে খুঁজে পাওয়া যায়নি একটিও অক্ষত ঘর। ছবি: লেখক

‘ভাই, আমার দুইডা বাচ্চা, শীতের কোনো কাপড় নাই। কিচ্ছু খাওন নাই, আশফানের (আকাশের) নিচে কতক্ষণ থাকন যায়? কই যামু আমরা? বাচ্চাগুলাইনের লাইগা গরম কাপড় দেন।’

খোলা আকাশের নিচে সবচেয়ে কষ্টে দিন কাটাচ্ছে শিশুসহ বৃদ্ধরা। নিরাপদ পানিসহ খাবারের তীব্র সংকট রয়েছে বলে অভিযোগ নিরীহ মানুষদের। সহায়–সম্বলহীন মানুষগুলোর ভাগ্যে কী রয়েছে কেউ বলতে পারেন না।

সংগ্রামী মানুষগুলোর জীবন এখন কীভাবে কাটবে। ছবি: লেখক
সংগ্রামী মানুষগুলোর জীবন এখন কীভাবে কাটবে। ছবি: লেখক

প্রতিনিয়ত উচ্ছেদ আতঙ্কে কাটে এদের জীবন। তবুও জীবন তাদের কাছে সুন্দর এবং অনাবিল। জীবনসংগ্রামী এ মানুষগুলো জীবনের সঙ্গে যুদ্ধ করেই প্রতিদিন বাঁচেন। তাই সরকারের উচিত, অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে হতদরিদ্র পরিবারগুলোর পাশে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া।