বিলুপ্তির পথে মশাল জ্বালানো উৎসব

খুলনার কয়রা উপজেলার হাতিয়ার ডাংগা পশ্চিম চক গ্রামে ‘মশাল জ্বালানো উৎসব’। ছবিটি ২০১৮ সালে তোলা। ছবি: সুবিনয় বাছাড়
খুলনার কয়রা উপজেলার হাতিয়ার ডাংগা পশ্চিম চক গ্রামে ‘মশাল জ্বালানো উৎসব’। ছবিটি ২০১৮ সালে তোলা। ছবি: সুবিনয় বাছাড়

ছোটবেলার গ্রামের অনেক স্মৃতির মধ্যে অন্যতম একটি হলো ‘মশাল জ্বালানো উৎসব’। সন্ধ্যা হওয়ামাত্রই মশাল জ্বালিয়ে বাদ্যযন্ত্রের তালে তালে শুরু হতো উৎসব। সঙ্গে সঙ্গে পটকাবাজিও চলত। কিন্তু কালের পরিক্রমায় সেই ‘মশাল উৎসব’ আজ প্রায় বিলুপ্তির পথে। এখন আর খুব একটা হয় না এ আয়োজন।

সন্ধ্যার পর রাতে মশালের আলোয় গ্রামের মেঠোপথ অপরূপ ধারণ করত। মশালের আলোর সঙ্গে চলত ছোট ছোট মজার মজার স্লোগান। আশপাশের গ্রামের ছেলেমেয়েদের মধ্যে অঘোষিত একটা প্রতিযোগিতা হয়তো মশাল নিয়ে, কারা কত বেশি মশাল জ্বালাতে পারছে। মূলত পোকামাকড় তাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে প্রতীকী উৎসব হিসেবে চলত মশাল জ্বালানো।

ছোটবেলার গ্রামের অনেক স্মৃতি মাঝেমধ্যে খুব মনে পড়ে। এর একটা স্মৃতি হলো ‘মশাল জ্বালানো উৎসব’। সাধারণত বাংলা আশ্বিন মাসের শেষ দিনের সন্ধ্যাবেলায় এ উৎসব পালন করা হতো। স্কুল থেকে ফিরে এসে চলত মশাল বানানো প্রস্তুতি। ছেঁড়া কাপড়ের টুকরা, পাটের দড়ির সঙ্গে কেরোসিন তেল মিশিয়ে মশাল তৈরি করা হতো। সন্ধ্যা হওয়ামাত্রই মশাল জ্বালিয়ে সঙ্গে বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে শুরু হতো উৎসব। সেই সঙ্গে কেউ কেউ পটকাবাজিও ফুটাত। সমবয়সী বন্ধুরা, বড়, ছোট ভাই সবাই মিলে মশাল নিয়ে রাস্তায় বের হয়ে আসতাম। মশালের আলোয় রাতের আঁধার দূর হয়ে গ্রামের মেঠোপথ এক অপরূপ ধারণ করত। মশালের আলোর সঙ্গে চলত গ্রামীণ ভাষায় ছোট ছোট স্লোগান। স্লোগানগুলোর ভাষা ছিল এ রকম, ‘আমাদের পাড়ার পোকামাকড়, ওই পাড়াতে যা’...! এই ধরনের মজার স্লোগান। আশপাশের গ্রামের ছেলেমেয়েরা সবাই মশাল জ্বালাত। আমাদের মধ্যে একটা অঘোষিত প্রতিযোগিতা কাজ করত, সেটা হলো কারা কত বেশি মশাল জ্বালাতে পারবে। বড়দের মুখ থেকে শুনতাম, এই উৎসবটা অনেক আগে থেকে গ্রামে চলে আসছে। তাঁদের ভাষ্যমতে, এ মশাল জ্বালানো হতো মূলত পোকামাকড় দূর করার জন্য প্রতীকী উৎসব হিসেবে। আমরা জানি পোকামাকড় আগুনকে ভয় পায়। মশাল জ্বালানো এই উৎসব শেষ হতে হতে রাত আটটা–নয়টা বেজে যেত। উৎসব শেষ করে সবাই মিলে মজা করতে করতে বাড়িতে ফিরে আসতাম। উৎসবটা আরও বেশি মজার হয়ে উঠত আমাদের কাছে। এর কারণ ওই দিন সন্ধ্যাবেলায় বই নিয়ে পড়তে বসতে হতো না। কিন্তু কালের পরিক্রমায় সেই ‘মশাল উৎসব’ আজ প্রায় বিলুপ্তির পথে।

গ্রামে আর আগের মতো পালন হয় না সেই মশাল উৎসব। আশ্বিন মাসের শেষ সন্ধ্যাটা কেটে যায় নীরবে। আধুনিকতার ছোঁয়ায় গ্রামের রাস্তাঘাট আজ পাকা হয়েছে। মেঠো সেই পথঘাট আর নেই। যেখানে থাকি তবু আশ্বিন মাসের শেষ সন্ধ্যা এলে আজও চোখের সামনে ভেসে ওঠে ছোটবেলার সেই স্মৃতি। চোখ বন্ধ করলে দেখতে পাই মশালগুলো মিটমিট করে জ্বলছে।

*লেখক: অ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার, সোনালী ব্যাংক লিমিটেড।