যে গল্পে ভালোবাসা রয়ে যায়

হেমন্তের পড়ন্ত বিকেলে পিঁড়িতে বসে প্রিয়তমা স্ত্রীর চুলে বিনুনি দেওয়ায় যে ভালোবাসার জন্ম, তা কি পরিমাপ করা যায়। ছবি: লেখক
হেমন্তের পড়ন্ত বিকেলে পিঁড়িতে বসে প্রিয়তমা স্ত্রীর চুলে বিনুনি দেওয়ায় যে ভালোবাসার জন্ম, তা কি পরিমাপ করা যায়। ছবি: লেখক

‘চুল তার কবে কার অন্ধকার বিদিশার নিশা

মুখ তার শ্রাবস্তির কারুকার্য...’
কিংবা যদি বলি
‘আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন
আমারে দু’দণ্ড শান্তি দিয়েছিল নাটোরের বনলতা সেন ।’

কিন্তু না এমন কাব্য তিনি জানেন না। জানেন না কে এই উর্বশী বনলতা। কেনই বা জীবনানন্দ তাঁর কবিতার অমোঘ আলোয় চেয়েছিলেন দুদণ্ড শান্তি; সেই মায়াবিনীর পাখির নীড়ের মতো শান্ত-স্থির চোখে চেয়ে।

কী করে জানবে বিশু দা? জীবন তাঁকে কবিতায় নয়, বেঁধেছে দারিদ্র্যের নিষ্ঠুর বেড়াজালে। বাবা-কাকার সূত্রে পাওয়া চুনের ব্যবসা করে চলে রোজকার জীবন। সেখানে কবিতা কিংবা ভালোবাসার শৌখিনতা বা বিলাসিতা যা-ই বলি না কেন, তা নিতান্তই বাড়াবাড়ি। তাই বাস্তবতার তপ্ত পথে হেঁটে হাট থেকে ঝিনুক কেনেন। তা পানিতে ধুয়ে কড়া রোদে শুকান। বড় আকারের মাটির চুলায় সেই ঝিনুক পুড়িয়ে নানা রকম প্রক্রিয়ায় বিশুদ্ধ করে তারপর সেগুলোকে চীনামাটির পাত্রে ঢেলে পানি আর শক্ত কাঠের লাঠি দিয়ে ঘুঁটে ঘুঁটে পরিণত করেন খাবার চুনে।

স্ত্রী-মা এবং ছেলেমেয়ে সবার সহযোগিতায় সেই খাবার চুন ছোট ছোট পলিথিনের প্যাকেটে ভরা হয়। কাকডাকা ভোরে মাথায় করে নিয়ে বিশু দা নিয়ে যান দূর-দূরান্তের হাট-বাজারে। কখনো চুনের সঙ্গে গোটা গোটা পান এবং সুপারিও বিক্রি করেন। এভাবেই চলে পাড়ার নিধি কাকার ছোট ছেলে বিশুদার জীবন।

অভাব-অনটনের সংসার তাতে কী? আনন্দ-প্রেম-ভালোবাসা এসব কোনোমতেই পালাতে পারেনি ওদের জীর্ণ জীবনের বেড়ার ঘরের ফাঁকফোকর দিয়ে। কী নিবিড় মায়ায় কী অপ্রতীম স্নিগ্ধতায় হেমন্তের পড়ন্ত বিকেলে রান্নাঘরের দাওয়ায় পিঁড়ি পেতে বসে প্রিয়তমা স্ত্রীর চুলে বিনুনি গেঁথে দিচ্ছিলেন বিশু দা। কী মিষ্টি দেখাচ্ছিল সিঁথিতে সিঁদুর দেওয়া বৌদিকে! ওদের ওমন প্রেম আর ভালোবাসামাখা বিকেলটা আমাকেও যেন শান্তি দিল দুদণ্ড। ছবি তুলতে চাইলেই একগাল হেসে বৌদি বলল, ‘তোলো ঠাকুরঝি, ছবি তোলো।’ বিশুদা চাপা হাসি দিয়ে বলল, ‘জানি তো বুনু, এসব তোরা ফেসবুকে দিবি।’

বললাম, ‘বিশুদা, আপনাদের এমন ভালোবাসা সারা পাড়া ঘুরে আর একটাও পাব বলে তো মনে হয় না। এ রকম মধুর প্রেমের আড়াল থাকতে নেই, লোকে জানুক এমন ভালোবাসাবাসির কথা।’ বলেই আমি বেরিয়ে এলাম।

গোধূলির গাঢ়-গভীর রক্তিম সূর্যের মতো বৌদির সিঁথির সিঁদুর যেন দুঃখ নয়, বেদনা নয়, পরম তৃষিত শ্রান্তি হয়ে জ্বলজ্বল করছিল। চকলেট-গোলাপ-দামি উপহার—এসব নয়, কোনো এক অবসরের বিকেলে খুব নিবিড় হয়ে পাশাপাশি বসে ওরা ছুঁয়ে যাচ্ছিল জীবনের সমস্তটা গল্প। ওদের কাছে ভালোবাসা দিবস কিংবা ভ্যালেন্টাইন অজানা শব্দ হলেও ওরা নিজেরাই বিস্তর এক ভালোবাসার জন্ম দিতে জানে।

তাই আবারও বলি,
‘সমস্ত দিনের শেষে-শিশিরের শব্দের মতন সন্ধ্যা আসে
ডানার রোদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল
পৃথিবীর সব রং নিভে গেলে-পাণ্ডুলিপি করে আয়োজন
তখন গল্পের তরে জোনাকির রং ঝিলমিল
সব পাখি ঘরে আসে-সব নদী ফুরায়-এ জীবনের লেনদেন
থাকে শুধু অন্ধকার-মুখোমুখি বসিবার
বনলতা সেন...”
সেই অন্ধকারের নিভৃত আলোয় বনলতায় বুঁদ হয়ে থাক আমাদের বিশুদা...।