ঢাকার লাভ রোড

ভালোবাসা দিবসে এমন ফুল হাতে ও খোঁপায় শোভা পায়। ছবি: আবীর আব্দুল্লাহ
ভালোবাসা দিবসে এমন ফুল হাতে ও খোঁপায় শোভা পায়। ছবি: আবীর আব্দুল্লাহ

সবুজ শ্যামল রূপসী (মানচিত্রের দাগ কাটা এপার–ওপার) বাংলার হাজারো জনপথের ভিড়ে কয়টা পথের নাম ভালোবাসা সড়ক (লাভ রোড) আমার জানা নেই। ঢাকার একটি সড়ক লাভ রোড। সেটি তেজগাঁওয়ের লাভ রোড। একসময়ের জনপ্রিয় বেইলি রোড লাভ রোড নামকরণ পায়নি।

ঢাকার নাটকপাড়াখ্যাত বেইলি রোড তারুণ্যের প্রাণ কেন্দ্র ছিল, এখনো ফুরিয়ে যায়নি। এটাও লাভ রোডের নামকরণে সিক্ত হতে পারত অঘোষিতভাবে। জোড়া তরুণ–তরুণীর দুদণ্ড প্রাণভরে আড্ডার এক ঐতিহাসিক ও জনপ্রিয় স্থান বেইলি রোড। নাট্যকর্মীদের ও সম্মানিত নাটকের দর্শকদের আনাগোনায় যে বেইলি রোড একসময় সরব থাকত, তা এখন আর ততটা অবশিষ্ট নেই। জনপ্রিয় নাটকপাড়া বেইলি রোড অনেকটাই নিষ্প্রাণ। কিন্তু বেইলি রোডকে বাঁচিয়ে রেখেছে জোড়া তারুণ্য। ঢাকা শহরের আসল লাভ রোড আসলেই বেইলি রোড। লাভ রোড হিসেবে তার স্বীকৃতি থাক বা না থাক।

পয়লা ফাল্গুন ও ভালোবাসা দিবসে গোলাপ ফুলের চাহিদা বাড়ে। ছবি: আবীর আব্দুল্লাহ
পয়লা ফাল্গুন ও ভালোবাসা দিবসে গোলাপ ফুলের চাহিদা বাড়ে। ছবি: আবীর আব্দুল্লাহ

কাগজে–কলমে বাংলাদেশে একটিই প্রতিষ্ঠিত লাভ রোড। ঠিকানা লিখতে গেলে লিখতেই হয়। তেজগাঁওয়ের লাভ রোড। অন্তত একটা স্বীকৃত লাভ রোড তো আছে। এটাও কম কথা নয়। আমি তো মনে করি আমাদের কিশোর তারুণ্য জোড়ায় জোড়ায় বাংলার যে সড়কের পাশেই অবলীলায় আড্ডায় মেতে উঠবে নিঃসংকোচে। বসে পড়বে স্বাধীন প্রেমময় ভাবাবেগে তাড়িত হয়ে। একটু সময় দুজনের মাঝে সেজেছে সুন্দরের সুনিপুণ তারুণ্য আলোছায়ায়। সড়কের পাশে এই নিশ্চিত বসে পড়া। যেন তারা মুক্ত বিহঙ্গ। কোনো শাসন–বারণ স্পর্শ করছে না স্বাধীন এই একান্ত অনুভূতি প্রকাশে। এই জোড়া তারুণ্য ভরপুর সব সড়কই লাভ রোড। আমরা তাঁর নাম দিই আর না দিই।
ঢাকার উত্তরায় একটি লাভ রোডের সন্ধান পেলাম। অঘোষিত লাভ রোড এটি। তার কোনো প্রতিষ্ঠিত স্বীকৃতি নেই। নেই ঠিকানায় লিখতে পারার উপস্থিতি। তারপরও সেটি লাভ রোডের খেতাবে পরিচিত। অধিবাসীরা ব্যঙ্গ করেই নামকরণ করেছেন এবং এই নামে সড়কটিকে চিনতে পারার চেষ্টা করছেন। উত্তরা ৬ নম্বর সেক্টরের ঈসা খাঁ অ্যাভিনিউ সড়কটিই উত্তরার লাভ রোড। কিছু মানুষ যদিও অসুন্দর মানসিকতা নিয়ে এ সড়কটির বিকৃত নাম উপস্থাপনের উদ্দেশে এই নামটির প্রকাশ ঘটিয়েছে। আসলেই তা সৌন্দর্যের মাধুরীতে সাজিয়েছে নির্জন সড়কটির অবয়ব অনেকটা অংশজুড়ে।

উত্তরার লাভ রোড নামে পরিচিত সড়কটিতে কিছু তারুণ্যের জোড়া আড্ডার অনেকেই হয়তো সুন্দর উপলব্ধি করতে অসমর্থ হয়েই লাভ রোডের খেতাব দিয়েছিলেন মানসিক বৈকল্য ও দৈন্যদশা থেকে। সেই ধিক্কার দেওয়া নামটাকে আরও প্রস্ফুটিত করেছে আমাদের তারুণ্য—তাদের আড্ডাকে উজ্জীবিত রেখে।
উত্তরার ৮ নম্বর সেক্টরের একটি নির্জন সড়ক এমনকি ৬ নম্বর সেক্টরের আলাওল অ্যাভিনিউতেও কিংবা আরও দু–একটি সড়কেও দেখা মেলে মাঝেমধ্যেই তারুণ্যর জোড়া আড্ডা।
আসলেই সুন্দরের স্বরূপ হচ্ছে এমন সব আড্ডা। যে যা–ই বলুক তারুণ্যের এমন উন্মুক্ত আড্ডা আমার কাছে সবুজ–সতেজ সুন্দরেরই বহিঃপ্রকাশ। এটা জাগ্রত থাকাই চাই অবশ্যই থাকা চাই। এটা মন্দ কিছুই নয়। দৃষ্টিভঙ্গির বিষয়মাত্র। জোড়া তারুণ্য আমার দারুণ পছন্দ। আমি তাদের এই সৌন্দর্যযাত্রা আন্তরিকভাবে সমর্থন করি। ওদের আড্ডা দেওয়া বাংলার প্রতিটি সড়কই অঘোষিত লাভ রোড।

লাভ রোডে আড্ডায় মেতে ওঠে তরুণেরা। ছবি: সংগৃহীত
লাভ রোডে আড্ডায় মেতে ওঠে তরুণেরা। ছবি: সংগৃহীত

তারুণ্যনির্ভর আমাদের প্রকৃতি সাজে তারুণ্যরূপে। তারুণ্যের উন্মাদনায় জেগে ওঠে প্রকৃতির সৌন্দর্যরূপ। সে রূপ অস্বীকারের সাধ্য আমার নেই। আমার কলমেরও নেই। তারুণ্যের প্রেম–ভালোবাসা, মান–অভিমান, হাসি–কান্না, আনন্দ–বেদনা ছড়িয়েছে বলে তো বাংলার রূপ এতটা মোহময়, এতটা সরল। এ সরলতায় উজ্জীবিত হয়ে আমি ভেসে বেড়াই। আমার উচ্ছ্বসিত অনুভূতি তাদের জন্যই। তাদের প্রতিটি অনুভূতি আমাকে স্পর্শ করে চিন্তায়–চেতনায়। ওরা লাভ রোডে ভরে দিক বাংলার শ্যামল মাটিতে গড়া নীরব সড়কের অস্তিত্ব। যে সড়ক শুধুই শান্ত, নিশ্চুপ দুই প্রান্ত। কালেভদ্রে দু–চারটা গাড়ি করে হইচই।
আমাদের তারুণ্যজোড়া ফুল ফুটুক সেখানেই নিত্যনতুনরূপে। এমন সুন্দর দৃশ্য ভালোই তো। মন্দ কোথায় তাতে। মন্দ তো সব অন্ধের কাছে, যারা ভুল দেখে ভুল শোনে। সারাক্ষণ শুধু ভুল গোনে।
কী সুন্দর ছিল বেইলি রোডের জমজমাট সেসব দিন। নাটকপাগল নাট্যকর্মী আর দর্শকে ঠাসাঠাসি বেইলি রোড তারুণ্যনির্ভর আড্ডারও প্রাণকেন্দ্র ছিল। নাটকপ্রেমীমাত্রই চোখ বন্ধ করলে সেই স্মৃতি সামনে চলে আসবে অনায়াসে। তারুণ্যের আড্ডাটা স্বল্প পরিসরে হলেও টিকে আছে সেটাই যে স্মৃতির উত্তরসূরি। আমাদের জানান দিচ্ছে অতীতের প্রাণভ্রোমরা এখনো নিঃশেষ নয়। তাকে নিঃশেষ হতে দিচ্ছি না আমরা। আমরা তারুণ্য নিঃশেষ হই না।

তেজগাঁওয়ের প্রতিষ্ঠিত লাভ রোড বেঁচে থাকুক মানুষের অস্তিত্ব ছুঁয়ে। অপ্রতিষ্ঠিত লাভ রোডেরও সংখ্যা বেড়ে উঠুক মানুষের অন্তরের উপলব্ধি ও সৌন্দর্য মেখে। ঘৃণা ধিক্কার নিয়ে নয়। ভালোবাসা নিয়ে নামকরণ হোক নতুন নতুন লাভ রোডের।
তারুণ্যের ঝাঁক যেখানেই ছুঁয়ে যায় জোড়ায় জোড়ায় সেখানেই যেন লাভ রোড হয়। অঘোষিত লাভ রোড, রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির দরকার নেই। ভালোবাসা জেগে উঠুক, ভালোবাসা ছড়িয়ে যাক তারুণ্যে তারুণ্যে।
আউলা বাতাসে ফাগুন আসে বাংলার পথে–প্রান্তরে। সূর্যের আগুনরাঙা দুপুর আমি দেখিয়াছি। হলুদ আভায় সাজে প্রকৃতির রূপ। আহা বসন্ত উদাস মনের স্মৃতি যেন পাঠ করে। ঝরে পড়ে পাতারা মর্মর করে টানে। পেছনে কি ফেলে এলাম কিছু? কিছু কি হারিয়েছি? এই মন, এই প্রকৃতি কেন এত উদাস। ওরে প্রেম যাসনে পালিয়ে। কোথায় পালিয়ে সেই দুরন্ত ফাগুন দুপুর—তার কথা মনে পড়ে। কেউ জানে না কাকে খুঁজে ফেরে ফাগুনের এই উদাস প্রেম। তাহলে কি আমরা উড়ন্ত, আমরা দুরন্ত, আমরা এলোমেলো বাতাসের হৃদয়। বসন্ত আমার সর্বনাশের হয়তোবা। হয়তোবা স্বপ্নডানায় উড়িয়ে নেবে এই অন্তরের সবটুকু।

বেইলের রোডের লাভ রোড তারুণ্যের প্রাণকেন্দ্র। ছবি: সংগৃহীত
বেইলের রোডের লাভ রোড তারুণ্যের প্রাণকেন্দ্র। ছবি: সংগৃহীত

আসছে ভালোবাসারও বসন্ত। প্রেমরাঙা বসন্ত সূর্য এখন যৌবন তার। তেজ তার গতরে উতরায়। মিছিমিছি খেলে সে রূপ ফাগুনের আগুনরাঙা প্রকৃতি। মানুষের মন পুড়ছে ধোঁয়া উড়ছে। ভালোবাসা এসেছে আঙিনায়। ভালোবাসার রাস্তাঘাটে বাঙালির প্রেমের হাটে এখন ফাগুন। এখন বসন্ত দুয়ারে। প্রেম নেবে গো প্রেম, প্রেম দেবে গো প্রেম। আমাদের মনে এখন প্রেমের মেলা। মেলায় হবে কেনাবেচা প্রেম নকল প্রেম সাচ্চা।
তারুণ্য এখন প্রকৃতি রচনায় ছুটছে, ওদের ছুটতে দাও। ভালোবাসা সড়কে নামতে দাও। দেখবা বাংলার বসন্তরাঙা দুরন্ত দুপুর কতটা সুন্দরে টলমল করে। ওরে শ্যামল তারুণ্য ঝাঁপিয়ে পড়ো এই ফাগুনের ভালোবাসার আগুনে। ভালোবাসার ওপরে কিচ্ছু নাই, কেউ নাই। শুধুই জোনাকির মিটমিটে আলো যেন নেমেছে আঁধার, এখন অনেক রাত। আজ বাংলার আকাশে–বাতাসে, অলিতে–গলিতে একেকটা ভালোবাসা সড়ক। সমস্ত বাংলায় ভালোবাসার রং লেগেছে। ভালোবাসা দিবস যে এসে গেছে। পুরো বাংলায় ফাগুনপোড়া গন্ধ। মন উড়ছে, মন পুড়ছে উদাস হাওয়ায়। বসছে না ঘরে মন। পথেই নামি চলো, ভালোবাসি বলো। ভালোবাসি শুধুই ভালোবাসি, তোমার টানে লাভ রোডে আসি।

ওরে লাভ রোডের পথিকেরা জেগে ওঠো। বাংলায় বসন্ত এসেছে। প্রকৃতি রূপময় হয়েছে, রূপবতী হয়েছে। এসেছে দেখো ভিনদেশি ভালোবাসার স্রোত, ভালোবাসার কোনো মানচিত্র থাকে না, দেশ থাকে না। গোটা বিশ্বই ভালোবাসার রঙে রঙিন, আজ বিশ্ব ভালোবাসা দিবস। নেমে আসো সবাই ভালোবাসা সড়কে। এই বাংলার কিশোর তারুণ্য নেমে আসো পথে। বাংলার প্রতিটি পথই ভালোবাসার অলিগলি।

* লেখক: অভিনয়শিল্পী, কবি ও লেখক