শওকত ওসমানের 'ক্রীতদাসের হাসি' এবং পূর্ব বাংলার চিত্রপট

শওকত ওসমানের ‘ক্রীতদাসের হাসি’ বইয়ের প্রচ্ছদ।
শওকত ওসমানের ‘ক্রীতদাসের হাসি’ বইয়ের প্রচ্ছদ।

বাক্যের প্রাণ তার শব্দমালা। কিন্তু কখনো কখনো এই শব্দ বড় নিষ্ঠুরভাবে রক্তাক্ত হয়। পড়ে থাকে স্মৃতির পাতার ছোট্ট কোণে। যদিও এই শব্দগুলোর অর্থ আবার আরও অসহায়। কারণ, সামাজিক ও ব্যাকরণগত দিক থেকে একটি শব্দ তার ‘সমার্থক শব্দ পায়, বিপরীত শব্দ’ পায়। কিন্তু হাজার চেষ্টা করেও ‘মানুষের ব্যবহৃত শব্দের অর্থ গণ্ডি’ থেকে বেরোতে পারে না। হোক সেটা ভাবার্থ কিংবা শাব্দিক দিক থেকেই।

সমাজ-রাষ্ট্র এবং বাংলা অভিধানে ‘ক্রীতদাস’ শব্দটিও তেমনি। যা তার নিজের ‘ভাবগত এবং বোধগত’ অর্থ জানার কারণে সৃষ্টি থেকে আজ অবধি সশরীর মুক্ত হওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছে। কিন্তু বিনিময়ে তা হয়েছে আরও শৃঙ্খলিত এবং রক্তাক্ত। যদিও আজও তার ‘শৃঙ্খল ভাঙার’ আকুতি প্রবল। বলা যায়, সেই আকুতিরই একটা প্রাপ্তবয়স্ক প্রজনন শওকত ওসমানের ‘ক্রীতদাসের হাসি’। যেখানে সাবলীল সংলাপ সঙ্গমে তিনি তুলে ধরেছেন সময়ের বর্ণচোরা স্রোতকে। যা শুধু সময়ের কান্ধে সওয়ার করে ক্ষমতাসীনের চরিত্রকে নয়, বরং প্রকাশ করে তার তাবৎ মানসিকতার ফাঁকফোকরকেও।

প্লট বা গল্পকাঠামোর ইঙ্গিত
রাজমহলের অদূরে স্ত্রীর সঙ্গে ক্রীতদাস ‘তাতারির’ উদ্দাম সুখ-হাসি চঞ্চল করে তোলে সম্রাট হারুনকে। অধরা সেই হাসিকে বারবার শুনতে এবং নিজের করে নিতে ক্রীতদাস তাতারিকে নিজের ধন-সম্পদের প্রাচুর্য বলয়ে বন্দী করেন সম্রাট। কিন্তু বিধি বাম! শৃঙ্খলের আদলে বন্দী তাতারি হাসতে ভুলে যান, আনন্দের সীমানা ভাসার স্রোত হারিয়ে ফেলেন। এমনকি সম্রাটের প্রবল হুকুমেও সেই অমৃত সুখ-হাসি আর জাগ্রত হয়ে ওঠে না। ফলাফল ক্রুদ্ধ সম্রাটের নির্দেশে তাতারির বিচ্ছিন্ন গর্দান মাটিতে পড়ে যায়।

তত্ত্বের ছোঁয়ায় উপন্যাসের শরীর
• ‘কাঠামোবাদ’ তত্ত্বের মূল নির্যাস হলো, এটা সময়ের ক্যানভাসে ওই সমাজের সামগ্রিক ঘটনাপ্রবাহের ফল নির্দেশ করে। অর্থাৎ, একটা জীবন বা সময়কে বুঝতে তার পারিপার্শ্বিক সময়ের সমগ্রতাকে জানা জরুরি। সে হিসাবে এ উপন্যাসের প্লটকাঠামো যে বিভক্ত ভারতের বাঙালিদের ওপর পশ্চিম পাকিস্তানিদের শোষণ–বঞ্চনার ইঙ্গিত, তা বেশ সুস্পষ্ট। আর আরেকটু খোলামেলা বললে, ‘উপন্যাসের তাতারি চরিত্র মূলত তৎকালীন পূর্ব বাংলার জনগণের প্রতিনিধি এবং সম্রাট চরিত্র ‘পশ্চিম পাকিস্তানি শাসক চক্রের’।

• শাসন-শোষণের তোপকোপে পূর্ব বাংলার জনগণের মৌলিক চাহিদা থেকে শুরু করে জীবনের স্বপ্ন যেমন পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী কবজা করে রেখেছিল। উপন্যাসেও দেখা যায় সম্রাট চরিত্র প্রলেতারিয়েত বা নিম্নবর্গীয় শ্রেণি ‘ভৃত্য তাতারি’কে আড়ষ্ট এবং দাবায়ে রাখতে চেয়েছিল। কবজা করে রাখতে চেয়েছিল তার মৌলিক চাহিদাসম্পন্ন স্বপ্ন বাস্তবতাগুলোকে।

• পাশাপাশি ’৭১–এর মুক্তিযুদ্ধে পশ্চিম পাকিস্তানি শোষকগোষ্ঠী যেমন গণিমতের মাল বানিয়ে বাঙালির মা-বোনদের সম্ভ্রম সংকটের তাণ্ডব চালিয়েছিল। এখানেও সম্রাট হারুন তাঁর কর্মচারী তাতারিকে বন্দী এবং নির্যাতনের মাধ্যমে তাঁরই পরমা সুন্দরী স্ত্রীকে ভোগ সম্ভ্রমহানির সেই তাণ্ডব চালিয়েছেন।

অর্থাৎ, ১৯৬২–তে বসেই ঔপন্যাসিক ১৯৭১–এ হতে যাওয়া পূর্ব বাংলার প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানিদের চরিত্র বুঝে ফেলেছিলেন! যাকে ইঙ্গিত হিসেবে উপস্থাপন করেছিলেন তাঁর উপন্যাস ক্যানভাসে।

শিল্পের একটা স্বকীয় রাজনীতি আছে, যা সময়ের প্রয়োজনে কখনো কখনো সরাসরি বা রূপকার্থ ইঙ্গিত প্রকাশ করে। আর এটা নির্ভর করে ওই সমাজব্যবস্থার সমাজপতিদের জুলুম-নেতৃত্বের ওপর। সে হিসাবে ১৯৬২–তে এই পূর্ব বাংলাকে জুলুমের সঙ্গে শোষণ করছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানিরা। ফলাফল লেখক তাঁর দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে সমাজব্যবস্থার শোষণকে ‘ক্রীতদাসের হাসি’ উপন্যাসের মাধ্যমে রূপকার্থে প্রকাশ করেছেন। যদিও বেশ চমকপ্রদ এবং নান্দনিক কৌশলে তিনি ওই সামরিক শাসকগোষ্ঠীকে বিবস্ত্রও করে ছেড়েছেন।

শক্তিমান চিন্তক ও ঔপন্যাসিক শওকত ওসমান তাঁর ‘ক্রীতদাসের হাসি’ উপন্যাসের কান্ধে সাওয়ার করে পূর্ব বাংলার শোষিত-নিগৃহীত মানুষগুলোর মানসিক ও সামাজিক চিত্রপটকে মেটাফরিকালি শব্দছন্দে উপস্থাপন করেছেন, যা তৎকালীন মাথামোটা শোষক পশ্চিম পাকিস্তানিরা বুঝতেও পারেনি। বুঝলে হয়তো এই উপন্যাস ও ঔপন্যাসিকের অবস্থাও হতো তৎকালীন রবীন্দ্রসংগীত ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতোই।

*লেখক: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী