আরেক ফাল্গুনে আমরা আবার দ্বিগুণ হব

ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

ছেলেমেয়েদের জেলখানায় ঢোকানোর সময় নাম ডাকতে ডাকতে হাঁফিয়ে উঠেছিলেন ডেপুটি জেলার সাহেব। একসময়ে বিরক্তির স্বরে বললেন, ‘উহ্, এত ছেলেকে জায়গা দেব কোথায়!’ জেলখানা তো এমনিতেই ভর্তি হয়ে আছে। ও কথা শুনে একজন বললেন, ‘এতেই ঘাবড়ে গেলেন নাকি? আসছে ফাল্গুনে আমরা কিন্তু দ্বিগুণ হব।’

জহির রায়হানের ‘আরেক ফাল্গুন’ ১৯৫৫ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি পালনের গল্প। ভাষা আন্দোলনের শহীদদের স্মরণে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া কিছু তরুণ-তরুণী একসকালে হঠাৎ করেই খালি পায়ে বেরিয়ে পড়েন ঢাকার রাস্তায়। স্থাপন করেন কাগজ আর বাঁশের শহীদ মিনার। এই শহীদ মিনার খুব বেশি সময় টেকেনি পুলিশের তোপের মুখে।

’৫২–এর ভাষাশহীদদের আত্মত্যাগের কথা তো আমরা সবাই জানি। তাই একুশ নয় কেবল প্রভাতফেরি অথবা আবেগঘন কণ্ঠে উচ্চারিত গান, ‘আমার ভায়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি/ আমি কি ভুলিতে পারি’। একুশ বরং একটি স্বতন্ত্র ইতিহাস; একটি ভাষার পুনর্জন্ম, পৃথিবীর সব মাতৃভাষার সার্বভৌমত্ব অধিকারের সংবিধান; সভ্যতার জলজ্যান্ত সাক্ষী, কালের প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর!

ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনের ৬৮ বছর একটা জাতির জীবনে মোটেই কম সময় নয়। কিন্তু পরম পরিতাপের বিষয়, যে আদর্শ, চেতনা ও প্রত্যাশা নিয়ে এত আত্মদান ও জীবন উত্সর্গের বিনিময়ে আমরা মায়ের ভাষাকে প্রতিষ্ঠিত করেছি সে অনুপাতে বাংলা ভাষাকে এখনো আমরা কাঙ্ক্ষিত মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করতে পারিনি। একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি পেলেও স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা বাংলা হওয়া সত্ত্বেও রাষ্ট্রীয় জীবনের সর্বস্তরে তথা উচ্চশিক্ষাসহ প্রশাসনে, আদালতে মাতৃভাষা বাংলার ব্যবহার অতি সীমিত। সচিবালয়ের দাপ্তরিক কাজে এবং শিক্ষাক্ষেত্রে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে বাংলা চালু হয়েছে, এর বাইরে সর্বস্তরে ইংরেজি ভাষাই চলছে। সেই সঙ্গে দেশে অসংখ্য ইংরেজি-মাধ্যম শিক্ষায়তন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ফলে দেশের শিক্ষার্থী সমাজের বাংলা ও ইংরেজি মাধ্যমে বিভক্তি তৈরি হয়েছে। ইংরেজি মাধ্যমে শিক্ষা অত্যন্ত ব্যয়বহুল, যা সমাজের একমাত্র উচ্চ শ্রেণির সন্তানদের পক্ষে সম্ভব। মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত সন্তানদের পক্ষে সে শিক্ষা গ্রহণ সম্ভব নয়। তাই পিছিয়ে পড়েছে বাংলা মাধ্যমের শিক্ষার্থীরা এবং আর্থিকভাবে অসচ্ছল তরুণসমাজ।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শততম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে এ বছর উদ্‌যাপিত হচ্ছে মুজিববর্ষ। শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে প্রত্যক্ষভাবে অংশ নিয়েছিলেন। আসুন, আমরা বঙ্গবন্ধুর আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে মাতৃভাষার কল্যাণে সেচ্ছার হই।

ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

একুশে ফেব্রুয়ারি কেবল বাঙালিদের নয়, সারা বিশ্বের। এ দুর্লভ অর্জন যেমন আনন্দের তেমনই এর মর্মবাণী উপলব্ধি করতে না পারাটা বেদনারও। সাহিত্য, শিল্প ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে বাংলা ভাষার শুদ্ধ প্রচলন বাড়াতে হবে। তবেই যথার্থ শ্রদ্ধা জানানো হবে সেসব ভাষাশহীদের প্রতি, যাঁদের জন্য আমরা বাংলাকে পেয়েছি মাতৃভাষার রূপে। কিন্তু বর্তমান তরুণসমাজ ও শিক্ষিত সমাজের প্রতি তাকালে হতাশ হতে হয়। তাদের কাছে ইংরেজি বা হিন্দি বলতে পারা হচ্ছে স্মার্টনেস। আর শুদ্ধ ভাষা মানে বাংলার মাঝে কে কত বেশি ইংরেজি ও হিন্দি শব্দ ব্যবহার করতে পারে।

বেতার ও টেলিভিশন ভাষা শিক্ষার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এফএম রেডিওগুলোতে বাংলা ভাষাকে যেভাবে বিকৃত করছে, তা নিন্দনীয়। দেশের অর্থনৈতিক উন্নতির প্রসার ঘটানোর উদ্দেশ্যে জনসংখ্যাকে নিজের ভাষায় শিক্ষিত করে তোলা অপরিহার্য। কাজেই আমাদেরও উচিত বাংলা ভাষার বিকৃতি রক্ষায় সোচ্চার হওয়া। আরেক ফাল্গুনে আমাদের আবার দ্বিগুণ হতে হবে। সে দ্বিগুণ হবে শুদ্ধ ভাষাচর্চার জন্য, মাতৃভাষার বিকৃতি রোধের জন্য, বাংলাভাষার নির্বাসন ঠেকানোর জন্য।

*লেখক: শিক্ষার্থী, ইংরেজি বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়