বাংলাদেশ টেস্ট ম্যাচ জেতা শিখবে কবে

ভারতে গিয়ে টেস্ট খেলবে বাংলাদেশ। ফাইল ছবি
ভারতে গিয়ে টেস্ট খেলবে বাংলাদেশ। ফাইল ছবি

বাংলাদেশের টেস্টে অভিষেক হয়েছে দুই দশক হয়েছে। লম্বা সময়ের পথ চলায় টেস্টে কতটা উন্নতি করেছে বাংলাদেশ? ২০০০ সালে ভারতের সঙ্গে টেস্টে অভিষেক বাংলার টাইগারদের। গত দুই দশকে বাংলাদেশ টেস্ট খেলেছে ১১৮টি, যার মধ্যে জয় ১৩টি। ড্র ১৬টি। এর সিংহভাগ দেশের মাটিতে। ম্যাচ হেরেছে ঠিক ৮৯টি। অর্থাৎ মোট ম্যাচের ৭৫ শতাংশই হেরেছেন বাংলার বাঘেরা। হেরে যাওয়ার ম্যাচের প্রায় অর্ধেকটা (৪৩) আবার ইনিংস পরাজয়। পরিসংখ্যানই বলে দিচ্ছে টেস্ট ম্যাচ জিততে কতটা কাঁচা টিম বাংলাদেশ।

রুবেল ঠিক ব্যাটসম্যান নন। তবে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের ধারাবাহিকত দায়িত্বহীনতার প্রতীক হতে পারে এই ছবি। ছবি: ডব্লুআইসিবি
রুবেল ঠিক ব্যাটসম্যান নন। তবে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের ধারাবাহিকত দায়িত্বহীনতার প্রতীক হতে পারে এই ছবি। ছবি: ডব্লুআইসিবি

একটা দলের ভালো করার পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান ঘরোয়া লিগের। বিশ্বের যত নামীদামি খেলোয়াড়, তাঁদের ঘরোয়া লীগের পরিসংখ্যান বলে দেয় তাঁরা কেন এত প্রতিষ্ঠিত। অথচ বাংলাদেশের ঘরোয়া লিগের মান নিয়ে আছে নানান প্রশ্ন। ক্রিকেটের উচ্চ গদিতে যিনিই বসেছেন, তিনিই বলেছেন ঘরোয়া লিগ তাঁদের চিন্তায় আছে। ঘরোয়ার উন্নতি হচ্ছে। এত উন্নতির ফলাফল পাওয়া যাবে কবে?

বাংলাদেশ এ পর্যন্ত ১১৮টি টেস্ট ম্যাচ খেলেছে। এর মধ্যে অভিষেক হয়েছে ৯৬ জনের। এদের কেউ কেউ খেলা থেকে বিদায় নিয়েছেন। কেউবা দুই-এক ম্যাচ সুযোগ পেয়ে দলছাড়া হয়েছেন। যাঁরা দলছাড়া হয়েছেন, তাঁরা অনুপযুক্ত হলে কেনই বা দলে সুযোগ পেলেন? দলছাড়া হওয়ার পর কতটাই বা পরিচর্যা করেছে বিসিবি? প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।

২০০০ সালের ১০ নভেম্বর। টেস্টে অভিষেকের সেই ঐতিহাসিক মুহূর্ত। ছবি: প্রথম আলো।
২০০০ সালের ১০ নভেম্বর। টেস্টে অভিষেকের সেই ঐতিহাসিক মুহূর্ত। ছবি: প্রথম আলো।

টেস্টের পরিসংখ্যানে ১২ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান নবম। বাংলাদেশের নিচে থাকা জিম্বাবুয়ের ক্রিকেট প্রায় বিলুপ্তির পথে এবং আফগানিস্তান, আয়ারল্যান্ড নবীন সদস্য। নবাগত টিম আফগানিস্তানের সঙ্গেও কিছুদিন আগে দেশের মাটিতে হেরেছে বাংলাদেশ। পূর্ণ শক্তি নিয়েও ন্যূনতম প্রতিরোধ গড়তে পারেনি পুরো দল৷ বাংলাদেশ টেস্টের প্রথম জয় পায় ২০০৫ সালে জিম্বাবুয়ের সঙ্গে। শেষবার জিম্বাবুয়ের সঙ্গে টেস্ট সিরিজেও সিলেট মাঠে লজ্জার দাগ এঁকেছে বাংলাদেশ। ক্রিকেটে হার-জিত থাকবেই। তাই বলে নিয়মিত হারতে থাকবে? কিংবা হারতে থাকা দলটি কি কোনো দিন জিততে শিখবে না?

মুশফিকুর রহিম। গত কয়েক বছরে টেস্টে ধারাবাহিক মুশফিকুর রহিম বাংলাদেশের সবচেয়ে নির্ভরশীলতার প্রতীক। ছবি: এএফপি
মুশফিকুর রহিম। গত কয়েক বছরে টেস্টে ধারাবাহিক মুশফিকুর রহিম বাংলাদেশের সবচেয়ে নির্ভরশীলতার প্রতীক। ছবি: এএফপি

ক্রীড়া জগতে হ্যাটট্রিক শব্দটি অসাধারণ কিছুর জানান দেয়। উপমাসূচক সদ্য পাকিস্তানের নাসিম শাহের সবচেয়ে কম বয়সে হ্যাটট্রিক। পাকিস্তান ক্রিকেটের জন্য গর্বের কথা। কিন্তু টানা তিন ম্যাচ ইনিংস পরাজয়ের বেদনা কী অসাধারণ কিছুর জানান দেবে? হয়তো অসাধারণ হারের গল্প বলবে। বাংলাদেশের বিদেশের মাটিতে পরাজয়ের গল্পগুলো প্রতিপক্ষের জন্য অসাধারণ জয়ই বটে। ভিনদেশের মাটিতে এ পর্যন্ত ৫৬টি ম্যাচ খেলে জয় মাত্র ৪টি। ড্র ৩টি। অবাক করা বিষয় হলো, বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশ সর্বশেষ ম্যাচ ড্র করেছিল ২০১৩ সালে। সর্বশেষ জিতেছিল ২০১৭ সালের মার্চ মাসে শ্রীলঙ্কার সঙ্গে। তার পর থেকে বিদেশের মাটিতে যেন হারের বৃত্তের নিয়মিত বাংলাদেশ। যাবে, খেলবে, হেরে আসবে। এটা যেন নিয়ম হয়েছে। কখনো আবার ইনিংস ব্যবধানে হারবে। বিদেশের মাটিতে সর্বশেষ টানা পাঁচ ম্যাচের ইনিংস পরাজয় তার প্রামাণ্য চিত্র।

টেস্ট দলের জয়ের ক্ষুধা কি আদৌও আছে?
বর্তমান টেস্ট অধিনায়ক মুমিনুল হককে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপের এমন জয়ের পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা কী? উত্তর ছিল, জয়ের ক্ষুধা। বিসিবিপ্রধানও বলেছিলেন, জয়ের বাসনা থেকে যুবাদের বিশ্বজয়। অথচ জাতীয় দলের টেস্ট দলে এই জয়ের ক্ষুধা কি আদৌও আছে? উত্তরে ইতিবাচক থেকে নেতিবাচকের পরিমাণ বেশি হলে অবাক হওয়ার কিছুই থাকবে না। টেস্ট ম্যাচ জিততে হলে অসাধারণ ব্যাটিং, ২০ উইকেট তুলতে পারা বোলারদের পাশাপাশি দরকার অ্যাগ্রিসিভ ফিল্ডিং। বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা কখনো সফল, কখনো-বা পরাস্ত। কিন্তু প্রতিপক্ষের ২০ উইকেট তোলার বোলার কোথায়? সদ্য শেষ হওয়া পাকিস্তানের বিপক্ষে প্রথম টেস্টে কজনই অ্যাগ্রিসিভ ফিল্ডিং করেছেন? কয়টা হাফ চান্সকে ফুল চান্স বানিয়েছেন? বরং ক্যাচ ছেড়ে বাবর আজমকে সেঞ্চুরি করতে দিয়েছেন। উইকেটের পেছনে ক্যাচ ধরেও ব্যাটসম্যানকে বারবার জীবন দিয়েছেন উইকেট কিপার। খেলোয়াড়দের আগ্রাসন দেখে মনে হয়েছে, জীবনে প্রথম খেলতে নেমেছেন।

দুই দশকে ১১৮ টেস্ট ম্যাচ খেলা দেশের সঙ্গে শিশু তকমা অনেকটা বেমানান। শ-খানেক ম্যাচ অতিক্রম করা টেস্ট খেলুড়ে দলের মাত্র ১৩টি জয় বড়ই বেমানান। টেস্ট ক্রিকেটার গড়ার মূল কারিগর। টেস্টের শীর্ষ স্থানের বিরাট কোহলি ওয়ানডেরও শীর্ষের ব্যাটসম্যান। টেস্টের ধারাবাহিক বাবর আজম টি-টোয়েন্টির সেরা ব্যাটসম্যান। গত কয়েক বছরে টেস্টে ধারাবাহিক মুশফিকুর রহিম বাংলাদেশের সবচেয়ে নির্ভরশীলতার প্রতীক।

সাদা পোশাকে সাকিবের সঙ্গে মুশফিক। প্রথম আলো ফাইল ছবি
সাদা পোশাকে সাকিবের সঙ্গে মুশফিক। প্রথম আলো ফাইল ছবি

ওয়ানডে, টি-টোয়েন্টির পাশাপাশি টেস্টকেও সর্বোচ্চ প্রাধান্য দেওয়া দরকার। ঘরোয়া মাঠে অত ইঞ্চি ঘাসের মাঠের পাশাপাশি পিচের প্রতিও নজর দেওয়া দরকার। খেলোয়াড়দের ম্যাচ ফি বাড়ানোর পাশাপাশি তাঁদের খাদ্যাভ্যাস, খাদ্যের গুণগত মানের প্রতি নজর প্রয়োজন। টেস্ট দলে দ্রুত অভিষেক না করিয়ে যথেষ্ট পরখ করা প্রয়োজন আছে। দুই-এক ম্যাচ পরে ছুড়ে না ফেলে সময় নিয়ে দেখতে হবে খেলোয়াড়দের। বাজে ফর্মের জন্য বাদ পড়লেও তাঁদের (খেলোয়াড়দের) পরিচর্যা চলা উচিত। তাতে একজন সাইফুদ্দিন উঠে আসতে পারেন। ব্যাটসম্যানের পাশাপাশি টেস্টের বিশেষ বোলার বের করার চেষ্টা করে যেতে হবে বিসিবিকে। প্রয়োজন পেসার হান্ট প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা আবার শুরু করতে হবে। বোলারদের ২০ উইকেট নেওয়ার সামর্থ্য না থাকলে কোনো দলই টেস্ট ম্যাচ জিতবে না। শুরু থেকেই খেলোয়াড়দের ফিটনেস নিয়ে কাজ করে ফিল্ডিংয়ে মনোযোগী করে গড়ে তুলতে হবে। সামান্য রানআউট কিংবা অসাধারণ ক্যাচ একটি ম্যাচের মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে। খেলোয়াড়দের অভয় দিতে হবে। ম্যাচ জেতার আত্মবিশ্বাস তৈরি করতে হবে। ঘরোয়া লিগের ক্রিকেটে উন্নতির প্রাণান্তকর চেষ্টা করা উচিত বিসিবিকে। তাতে খেলোয়াড়েরা ক্রিকেটের প্রতি আগ্রহ পাবেন। দলের ক্রিকেটারদের পাইপলাইন বৃদ্ধি করতে কাজ করে যেতে হবে। এতে দেশের ক্রিকেটের উন্নতি হবে। আশা করা যায়, এতে টেস্ট ম্যাচ জয়ের শিশু বাংলাদেশ; একসময় যুবক, বয়স্কতে পরিণত হতে পারবে।
*লেখক: শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়