জীবনে বড় সংকট মানুষই, অন্য প্রাণী নয়

বিশ্বাস নিয়েই বাঁচে মানুষ। ছবি: সংগৃহীত
বিশ্বাস নিয়েই বাঁচে মানুষ। ছবি: সংগৃহীত

মানুষের বিশ্বাসের জায়গাটা অনেক বড়। মানুষ বিশ্বাস করতে ভালোবাসে। যদিও নিরঙ্কুশ বিশ্বাসের মধ্যেও মানুষ ঠকে চিরন্তন। তারপরও বিশ্বাস আঁকড়ে বাঁচে, বাঁচতে হয়। অবিশ্বাসের ছায়া যে মানুষের চারপাশে গিজগিজ করে না, তা কিন্তু নয়। মানুষ জেনেশুনেই অবিশ্বাসকেও বিশ্বাস করে। বিশ্বাস করাই মানুষের স্বভাব। বিশ্বাস বিহনে মানুষ বাঁচে না। বিশ্বাস করতেই হয়। যদি বিশ্বাসে মরতেও হয়, মানুষ যদি মানুষকে বিশ্বাসই না করবে, থেমে যাবে পৃথিবীর গতি। অচল পৃথিবীতে ফুটবে না কোনো ফুল, ছুটবে না কোনো পাখি খোলা আকাশে স্বাধীনভাবে, ডাকবে না দলে দলে কিচিরমিচির শব্দ তুলে। ফুরিয়ে যাবে প্রকৃতির নিজস্ব সুন্দরেরাও।

বিশ্বাসের পাতায় পাতায় সেজে ওঠে মানুষের জীবন। অবিশ্বাসও থাকে সমানতালে। মানুষের জীবনে বড় সংকট বর্তমানে মানুষই, অন্য কোনো প্রাণী নিশ্চয়ই নয়। এখানেই মানুষের যত ভয়, যত সংশয়। তারপরও মানুষ মানুষকেই বিশ্বাস করে বিশ্বাসের এই মানবসংসারে।

এই যে সকালে সূর্যটা হেসে ওঠে, আমরা এও বিশ্বাস করি, সন্ধ্যায় সূর্যের সেই হাসি নিবে যাবে। আমরা এও বিশ্বাস করি, আজকের মতো নিভে গেলেও কাল সকালে ঠিকই সূর্যটা হাসবে।

অন্ধকার রাত দেখে আমরা বিশ্বাস করি, চিন্তা নেই চাঁদ উঠবেই। আকাশে নিশ্চয়ই আসবে চাঁদ। পূর্ণিমার চাঁদও হাসবে খিলখিল। আসলে চাঁদ উঠলে আমরা এমনও বিশ্বাস করি, অন্ধকার রাত আসবেই সামনে। এমনও তো হতে পারে, চাঁদ আর কোনো দিনও উঠল না। কিন্তু আমাদের বিশ্বাস, চাঁদও আসে, আঁধারও আসে।

জীবনের উপস্থিতি আমরা বুঝতে পারি শিশুর জন্মের ভেতর দিয়ে। একটি উদ্ভিদের নতুন পাতায় কুঁড়ি দেওয়া দেখে। এমনও তো হতে পারে একদিন দেখা গেল জীবনের উপস্থিতিই আর নেই। শুরুই হলো না কোনো দিন। কিন্তু আমাদের বিশ্বাস জীবনের জন্ম হয়ই। জীবনকে বুঝতে পারি বলে বিশ্বাস করি মরণও আসবে।

মরণকে আমরা দেখি না। মানুষসহ সমস্ত প্রাণকেই মরে যেতে দেখি। কিন্তু বিশ্বাস করি মরণ আছে, সে আসবেই। সে আমাদের দৃষ্টিসীমার ভেতরেই আসে কোনো না কোনো প্রকৃতিসন্তান বধে। এমনও তো হতে পারে সে আর এলই না। কিন্তু আমাদের বিশ্বাস, সে আসেই আসবেই।

আমরা প্রকৃতির বাতাসকেও বিশ্বাস করি, তার নিশ্বাস নেই। কিন্তু বাতাসকে দেখতে পাই না, অনুভব করি। বাতাসেও আমাদের বিশ্বাস। সে থেমে যেতেই তো পারে। কিন্তু আমরা বিশ্বাস করি, সে আছে, থাকবে। সেই বিশ্বাসে আমাদের বেঁচে থাকা নিশ্বাস নিয়ে।

প্রকৃতির সঙ্গে আছে যুদ্ধ, আছে জীবাণুর সঙ্গেও
নিশ্বাসেও দারুণ বিশ্বাস আমাদের। আমরা নিশ্বাসের ওপর ভর করে বাঁচি।

এ জীবন বড়ই যুদ্ধময়। বিশ্বাস ও নিশ্বাসের এই জীবনযুদ্ধেরই মাঠ। সমস্ত প্রকৃতির সন্তানের জীবনেই বিশ্বাস মুখস্থ নিশ্বাসও।

বাতাসকে দেখতে পাই না, অনুভব করি। বাতাসেও আমাদের বিশ্বাস। সে থেমে যেতেই তো পারে। কিন্তু বিশ্বাস করি আছে, থাকবে, সেই বিশ্বাসে আমাদের বেঁচে থাকা নিশ্বাস নিয়ে। ছবি: সংগৃহীত
বাতাসকে দেখতে পাই না, অনুভব করি। বাতাসেও আমাদের বিশ্বাস। সে থেমে যেতেই তো পারে। কিন্তু বিশ্বাস করি আছে, থাকবে, সেই বিশ্বাসে আমাদের বেঁচে থাকা নিশ্বাস নিয়ে। ছবি: সংগৃহীত

জীবনের স্বরলিপিই তো যুদ্ধ, নিজের সঙ্গে নিজের। প্রকৃতির সঙ্গে, বিশ্বায়নের সঙ্গে, অভাব–অনটনের সঙ্গে। খ্যাতির অখ্যাতির সঙ্গে, সম্মান অসম্মানের সঙ্গে, ধনি–গরিবের পার্থক্যের সঙ্গে। হিংসা অহিংসার সঙ্গে, ন্যায় অন্যায়ের সঙ্গে। অধিকার অধিকারহীনতার সঙ্গে। নিগ্রহ নির্যাতনের সঙ্গে। নিষ্ঠুরতা নির্মমতার সঙ্গে। মানবিক অধিকারের সঙ্গে। এই যে মানুষের হাতেই মানুষের জীবনের অসুন্দর অধ্যায় রচিত। কেউ নিরীহ, কেউ শক্তিধর, এই বৈষম্য মানুষের হাতেই যে রচিত। বলছিলাম না লেখার শুরুতেই। মানুষই মানুষের জীবনের সংকট। মানুষই মানুষের সর্বনাশের চাবি। অন্য কোনো প্রাণীও নয়।

এই বিশ্বাসের নিশ্বাসের প্রকৃতি সংসারে মানুষকে তো বটেই; সমস্ত প্রকৃতির সন্তানদের যুদ্ধ করতে হয় প্রকৃতি মায়ের সঙ্গেও। কিন্তু প্রকৃতির সঙ্গে যুদ্ধটা আছে। আছে যুদ্ধ জীবাণু ও কীটপতঙ্গের সঙ্গেও। ভয়াবহ যুদ্ধ তো ভাইরাস।

এই চিরবিশ্বাসের ভেতরও তো আমরা থাকি না। থাকি না এই চিরনিশ্বাসের ভেতরও। প্রাণিকুল পালাতেই যে ভালোবাসে। হারিয়ে যেতেই আসে। এই আসে এই যায়। বিশ্বাস নিশ্বাস, এই আসা–যাওয়ার হিসাব মেলে না। মেলে না এই খেলার চূড়ান্ত এই সংখ্যাগুলো। এই জগৎসংসারে মানুষই মানুষের বিশ্বাস ভঙ্গ করে। মানুষই মানুষের নিশ্বাস চেপে ধরে। মানুষই পারে মানুষের জীবনে আনন্দ ফিরিয়ে দিতে, মানুষই মানুষের জীবনের বেদনার কারণ। মানুষই লোভে পড়ে মানুষের সব লুট করে নির্লজ্জের হাসি হাসে। মানুষই কেড়ে নেয় মানুষের অধিকার, ইচ্ছা, আকাঙ্ক্ষা, স্বপ্ন, আশা, সব।

বিশ্বে ভয়ংকর চরিত্র মানুষ, অন্য কেউ নয়
এই মসৃণ, কোমল, নির্মল নিশ্বাসের ভেতর বিষ ঢুকিয়ে দেয় মানুষই। শৈশবে আমরা ভূতের ভয়ে কতই মুখের ভেতর শুকিয়ে যেত যখন বড়রা আমাদের ভয় দেখাতে ভূতের কথা বলত। সেই অদৃশ্য বিশ্বাস অবিশ্বাসের ভূতের চেয়ে দৃশ্য মানুষই যে বিশ্ব ভয়ংকর চরিত্র। সেই বিশ্বাস–অবিশ্বাসের ভূতেরাও পালিয়েছে মানুষরূপী চরিত্রের ভয়ে, হা হা হা।

বিশ্বে ভয়ংকর চরিত্র যে এখন মানুষই অন্য কেউ নয়। মানুষই মানুষের প্রতিপক্ষ জিন–ভূত তো দূরে, বনের ভয়ংকর কোনো প্রাণীও নয়। বিশ্বময় মানুষ ফাঁদেই মানুষ আটকে। বিশ্বাসের এই নিশ্বাসের এই বাঁচার লড়াই করে।

মানুষের জীবনে বড় সংকট মানুষ, অন্য কোনো প্রাণী নয়। এখানেই মানুষের যত ভয়, যত সংশয়। তারপরও মানুষ মানুষকেই বিশ্বাস করে বিশ্বাসের এ মানবসংসারে। ছবি: সংগৃহীত
মানুষের জীবনে বড় সংকট মানুষ, অন্য কোনো প্রাণী নয়। এখানেই মানুষের যত ভয়, যত সংশয়। তারপরও মানুষ মানুষকেই বিশ্বাস করে বিশ্বাসের এ মানবসংসারে। ছবি: সংগৃহীত

তবুও বিশ্বাসকেই বিশ্বাস মানুষের। নিশ্বাসকেই বিশ্বাস মানুষের। শুধুই কি মানুষের? সমস্ত প্রাণীই যে পরাধীন মানুষের হাতে। তারপরও তারা বিশ্বাসের পথযাত্রী, নিশ্বাসের পথযাত্রী। বিশ্বাস আছে বলেই তো এই নিষ্ঠুর পৃথিবীটাও সুন্দরের, নিশ্বাস আছে বলেই তো এই অসহায় প্রাণ ও যে সুনিপুণ। কখন ফুরিয়ে যাবে সেসবের চিন্তা থামিয়ে বৈশ্বিক এই সুন্দরের রচনা মানুষের হাতে সে ও তো এই বিশ্বাসের ওপর ভর করে ও নিশ্বাসের ওপরই বিশ্বাস করে।

দিন শেষে বৈশ্বিক বিশ্লেষণে ক্ষমতাধর আর নিরীহ সব মানুষই যে অসহায়। সমস্ত প্রাণই নিঃসঙ্গ একা অসহায়। তার সমস্ত সংকট–সম্ভাবনা একান্তই নিজস্ব। কেউ নয় তার। কী সাংঘাতিক নিয়ম প্রকৃতি চরিত্রের।

সমস্ত প্রাণের প্রাণভ্রমরা যে বিশ্বাসের শক্তি ও নিশ্বাসের বিশ্বাস।

লেখক: অভিনয়শিল্পী, কবি ও লেখক