নারিকেল জিঞ্জিরায় একঝাঁক ফার্মা বার্ডসের ঘোরাঘুরি

প্রবাল, ঝুরঝুরে বালু, নীল জলের সৈকতে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাসি বিভাগের শিক্ষার্থীরা। ছবি: সংগৃহীত
প্রবাল, ঝুরঝুরে বালু, নীল জলের সৈকতে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাসি বিভাগের শিক্ষার্থীরা। ছবি: সংগৃহীত

হুমায়ূন আহমেদের ‘দারুচিনি দ্বীপ’ ছবিটি আমাদের প্রজন্মের যাঁরাই প্রথমবারের মতো যখন দেখেছেন, নিঃসন্দেহে তাঁদের ভেতরে অজান্তে হলেও জায়গাটি হাতছানি দিয়ে ডেকেছে। নীল জলরাশির সফেদ ঢেউ আছড়ে পড়ার কথা মনে দোলা দিয়েছে। প্রবালভর্তি তীর, নারকেল আর কেয়াবনের সারির অপরূপ লাবণ্যের দ্বীপটি মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে বাংলাদেশের সর্বদক্ষিণে। নাম সেন্ট মার্টিন।

কক্সবাজার জেলার টেকনাফ থেকে প্রায় ৯ কিলোমিটার দক্ষিণে নাফ নদের মোহনায় এ দ্বীপে প্রচুর পরিমাণে নারকেল পাওয়া যায় বলে একে নারিকেল জিঞ্জিরাও বলা হয়। সেন্ট মার্টিন যেন প্রাকৃতিক আর বিচ্ছিন্ন সৌন্দর্যের এক অনন্য প্রতিমা। ফলে যাঁরা প্রকৃতপক্ষেই ভ্রমণবিলাসী বা সমুদ্রপ্রেমী মানুষ কিংবা কিছুদিন চুপচাপ কাটিয়ে দিতে চান প্রকৃতির কাছাকাছি থেকে, তাঁদের কাছে সেন্ট মার্টিন একটি তুমুল আকাঙ্ক্ষিত স্থান হয়েই দাঁড়িয়েছে।

সেন্ট মার্টিনে নীল পানি আর সুবিশাল আকাশে মত্ত ছিলেন সবাই। ছবি: সংগৃহীত
সেন্ট মার্টিনে নীল পানি আর সুবিশাল আকাশে মত্ত ছিলেন সবাই। ছবি: সংগৃহীত

কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাসি বিভাগ প্রতিবছরের শুরুতেই একটি বার্ষিক ভ্রমণের আয়োজন করে থাকে। এবারের ভ্রমণে সব শিক্ষার্থীর আকাঙ্ক্ষার স্থান ছিল সেন্ট মার্টিন। সে মোতাবেক তারিখও নির্ধারিত হলো। ৬ ফেব্রুয়ারি রাত সাড়ে আটটায় ক্যাম্পাস এলাকায় জড়ো হলাম সবাই। পূর্বপ্রস্তুতি সম্পন্ন করে ১০টার দিকে বাসে রওনা হলাম সেন্ট মার্টিনের উদ্দেশে। সেন্ট মার্টিনে খাবারদাবারের দাম তুলনামূলক বেশি হয়, তা আগে থেকে জানতাম বলে কিছু কেক, চিপস, হালকা খাবার ও পানি নিয়ে নিলাম সঙ্গে।

দুটি বাসে মোট সাতটি ব্যাচের ৯৬ জন ছাত্রছাত্রী ছিলাম। এ ছাড়াও আমাদের সঙ্গে ছিলেন বিভাগের চেয়ারম্যান স্যার সৈয়দ কৌশিক আহমেদ, জয় রাজ স্যার, হালিমা ম্যাম, মাহফুজা ম্যাম এবং সাদিয়া ম্যাম। যাত্রাপথে বাসে উচ্ছ্বসিত শিক্ষার্থীরা নাচগানের মাধ্যমে এক উৎসবমুখর পরিবেশ সৃষ্টি করেন। তাতে যোগ দেন স্যার-ম্যামরাও। আনন্দমুখর এ যাত্রাপথ শেষে আমরা সবাই সকাল আটটায় পৌঁছাই টেকনাফের জাহাজঘাটে। সাড়ে নয়টায় শুরু হয় জাহাজের যাত্রাপথ। জাহাজেই সেরে ফেলি নাশতা। শত শত গাঙচিলকে জাহাজের পাশে পাশে উড়ন্ত রেখে একটার দিকেই পৌঁছে গেলাম স্বপ্নরাজ্য সেন্ট মার্টিনে।

জেটিতে পৌঁছে জাহাজ থেকে নামলাম লম্বা লাইন শেষ করে। আমাদের ট্যুর এজেন্সির মানিক ভাই সবাইকে পথ দেখিয়ে নিয়ে গেলেন জল-নুপুর আর সমুদ্র কানন নামের দুটি রিসোর্টে। সেখানে ফ্রেশ হয়ে সেরে নিলাম দুপুরের খাবার। সি ফাইন্ড রেস্টুরেন্টে খাওয়ার সময় রোদের ঝিলিকই বলে দিচ্ছিল বিচের আশপাশেই আছি আমরা। কোনোরকমে খাওয়া শেষেই ছুটে গেলাম রেস্টুরেন্ট থেকে মাত্র ৩০ সেকেন্ডের দূরত্বের জেটি-বিচে।

সমুদ্রের নীল জল তখন রোদে চিকচিক। চারপাশের উত্তাল জলরাশির দিকে তাকিয়ে থেকে লং জার্নির সব ক্লান্তি যেন কর্পূরের মতো উড়ে গেল মুহূর্তেই। যে যার মতো ছড়িয়ে পড়লাম বিচজুড়ে। ছবি তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন অনেকেই। যে পাশে প্রবাল বেশি, তিরতির করে কয়েকজন হেঁটে গেলাম সেদিকে। প্রবাল, ঝুরঝুরে বালু, নীল জলের অদ্ভুত এক সৈকত এই দ্বীপের।

সেন্ট মার্টিনে ফার্মা পাখিদের উচ্ছ্বাসের হাট বসেছিল এ মাসের প্রথম সপ্তাহে। ছবি: সংগৃহীত
সেন্ট মার্টিনে ফার্মা পাখিদের উচ্ছ্বাসের হাট বসেছিল এ মাসের প্রথম সপ্তাহে। ছবি: সংগৃহীত

রিসোর্টে ফিরে এসে বিশ্রাম শেষে এবার বের হলাম পশ্চিম বিচের উদ্দেশে। জীবনের অন্যতম সুন্দর এক সন্ধ্যা ছিল সেদিন। উপভোগ করেছি বাংলাদেশের অন্যতম সুন্দর সূর্যাস্ত। মন কেমন করা এই সন্ধ্যায় সাইক্লিং করতেও ভুল যাননি অনেকে। সেন্ট মার্টিনে সেদিন যেন ফার্মা পাখিদের উচ্ছ্বাসের হাট বসেছে। এত প্রিয় মুখ, দিগন্তজুড়ে নীল জল, সুবিশাল আকাশ ধন্য করেছে দুই চোখকে।

রাতে সবাই রিসোর্টে ফিরে আয়োজন করলাম আকর্ষণীয় এক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। টিপ পরানো, কার দৌড় কত দূরসহ আরও কতগুলো খেলায় বিজয়ী নির্ধারণের মাধ্যমে উপভোগ করেছি জমজমাটভাবে। পরের দিনটা সবাই দারুণভাবে কাটিয়েছি ট্রলারে করে মায়াবী ছেঁড়াদ্বীপ ভ্রমণের মধ্য দিয়ে। সেই রাতে ফিশ বারবিকিউয়ের পাশাপাশি অনেকক্ষণ স্বাদ নিয়েছি রাতের সেন্ট মার্টিনের।

পরদিন সন্ধ্যায় কক্সবাজার হয়ে ফিরে এসেছি ঘরে। আশরাফুল ভাইয়া, তানভীর ভাইয়া, ফাহমিদা, মাইমুনাসহ আরও অনেকের মতে—নারিকেল জিঞ্জিরা আমাদের স্মৃতির পাতাকে আরও সমৃদ্ধ করেছে, দিয়েছে নতুন এক মাত্রা।

ভ্রমণবিলাসী বা সমুদ্রপ্রেমী মানুষ কিংবা কিছুদিন চুপচাপ কাটিয়ে দিতে চান প্রকৃতির কাছাকাছি থেকে, তাঁদের কাছে সেন্ট মার্টিন তুমুল আকাঙ্ক্ষিত স্থান। ছবি: সংগৃহীত
ভ্রমণবিলাসী বা সমুদ্রপ্রেমী মানুষ কিংবা কিছুদিন চুপচাপ কাটিয়ে দিতে চান প্রকৃতির কাছাকাছি থেকে, তাঁদের কাছে সেন্ট মার্টিন তুমুল আকাঙ্ক্ষিত স্থান। ছবি: সংগৃহীত

লেখক: শিক্ষার্থী, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়