সেদিনের আন্দোলনের ফল ভোগ করছে আজকের বাংলাদেশ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের ইশতিয়াক আহমেদ। ছবি: সংগৃহীত
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের ইশতিয়াক আহমেদ। ছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশ ও বাংলা ভাষা—দুটোই শোষকের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়া অর্জন। বাঙালির কাছে আছে একটি দেশ বাংলাদেশ; একটি ভাষা, যার নাম বাংলা; আরেকটি জিনিস আছে, যার নাম আবেগ। এই তিন জিনিসের কোনোটির দাম নেই অর্থমূল্যে। ভাষা থেকে শুরু করে সব জায়গায় পাকিস্তানিরা আমাদের দমাতে চেয়েছিল কিন্তু বাঙালির অদম্য ইচ্ছাশক্তি কখনো তা হতে দেয়নি। ১৪৪ ধারা ভেঙে বুকের তাজা রক্ত দিয়ে কেনা আমাদের এই মাতৃভাষা। এই সুন্দর, শ্রুতিমধুর ভাষা নিয়ে অনেক ধরনের ভাবনা আছে তরুণসমাজে। আজ সেসব ভাবনার কথা শুনব।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের শিক্ষার্থী ইশতিয়াক আহমেদ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাসি বিভাগের তানভীর আহমেদ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের তাজিন আখন্দ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সুবর্ণা মোস্তফা, ঢাকা কলেজের অর্থনীতি বিভাগের মাহমুদুন্নবী রিসল, সাউথ ইস্ট ইউনিভার্সিটির আইন বিভাগের মাহফুজ আবদুল্লাহ জানিয়েছেন ভাষা দিবস নিয়ে নিজেদের কথা।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের তাজিন আখন্দ। ছবি: সংগৃহীত
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের তাজিন আখন্দ। ছবি: সংগৃহীত

তানভীর আহমেদ বলেন, ‘ফেব্রুয়ারি বাঙালির গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের অনন্য এক সাক্ষী। সারা বিশ্ব যখন ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালন করে, তখন সগর্ব বুক ভরে যায়। কারণ, সারা বিশ্বের বুকে আমরাই একমাত্র জাতি, যারা কিনা ভাষার জন্য সংগ্রাম করেছে, নিজের তাজা রক্ত বিলিয়ে দিয়ে রাজপথ রঞ্জিত করে মায়ের মুখের ভাষার যথার্থ মূল্য আদায় করে নিয়েছে, যা আমাদের পাশাপাশি সারা বিশ্বের মানুষ এখন শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছে। অবনতচিত্তে স্মরণ করতে ইচ্ছে করে সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারসহ বাংলা মায়ের দামাল সন্তানের প্রতি যাদের আত্মত্যাগে বাংলা আজ বিশ্বের বুকে সম্মানিত। অথচ একুশ শতকের এই যুগে এসেও আমরা আমাদের ইতিহাস ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির ধারক ও বাহক সেই বাংলা ভাষাকে আধুনিকতার ছোঁয়ার কলুষিত করছি। বাংলার সঙ্গে ইংরেজি, হিন্দি কিংবা অন্যান্য ভাষায় সংমিশ্রণে ক্ষতবিক্ষত করছি প্রিয় মাতৃভাষাকে। তাই ফেব্রুয়ারির এই ক্ষণে এসে আমাদের এমন অসুস্থ ফ্যাশন নামক আধুনিকতাকে পরিহার করে বাংলা ভাষার যথাপ্রয়োগ করে এর শ্রুতিমধুরতা রক্ষা অন্যতম নৈতিক দায়িত্ব।’

কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাসি বিভাগের তানভীর আহমেদ। ছবি: সংগৃহীত
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাসি বিভাগের তানভীর আহমেদ। ছবি: সংগৃহীত

তাজিন আখন্দের মতে, মানবজাতির সৃষ্টিলগ্ন থেকেই ভাষা যোগাযোগ এবং আবেগ প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে, সেটা হোক মুখের বুলি হয়ে, লিখিত রূপে কিংবা সংকেত আকারে। প্রতিটি জাতির কাছেই তার মাতৃভাষা অন্যতম গর্বের একটি বিষয়। তেমনি বাঙালি হিসেবে বাংলা ভাষা প্রত্যেক বাঙালির গর্বের কারণ। শুধু মাতৃভাষা হিসেবেই নয়, বরং এই বাংলা ভাষার রয়েছে এক রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের ইতিহাস। ১৯৫২ সালে বাংলার দামাল ছেলেরা মাতৃভাষার জন্য জীবন দিয়েছেন। তাঁদের এই উৎসর্গের কথা স্বরণ রেখে নিজেদের ভাষার প্রতি আরও সচেতন হওয়া জরুরি। প্রত্যেক নাগরিককে বাংলা ভাষার সঠিক ইতিহাস জানাতে পারলে ভাষা সম্পর্কে আরও সচেতন হওয়া সম্ভব। তরুণ প্রজন্মের মধ্যে বাংলা ভাষা নিয়ে উদাসীনতা দেখা যায়। তাই তরুণ প্রজন্মকে বোঝাতে হবে যে বিদেশি ভাষা কখনোই নিজের মায়ের ভাষার চেয়ে বড় হতে পারে না, এটা বুঝতে পারলেই স্বদেশি ভাষাচর্চা আরও বেড়ে যাবে।

সাউথ ইস্ট ইউনিভার্সিটির আইন বিভাগের মাহফুজ আবদুল্লাহ। ছবি: সংগৃহীত
সাউথ ইস্ট ইউনিভার্সিটির আইন বিভাগের মাহফুজ আবদুল্লাহ। ছবি: সংগৃহীত

ইশতিয়াক আহমেদ বলেন, ‘১৯৪৭ থেকে শুরু ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি সময়টা স্পষ্ট ইঙ্গিত দেয়, ধর্মের ভিত্তিতে পৃথক রাষ্ট্র করা কতটা বোকামি। এই বোকামির চরম খেসারত পূর্ব পাকিস্তানিদের (বর্তমান বাংলাদেশিদের) দিতে হয়েছে। ভাষার ক্ষেত্রে, স্বাধীনতা, নিয়োগ, অর্থনীতি; এ ছাড়া আরও অনেক ক্ষেত্রে শুধু আঘাত মিলেছে বাঙালিদের। সব আঘাতের বড় আঘাত ভাষার ওপর আঘাত। এই আঘাতে বাঙালি সেদিন ফুঁসে উঠেছিল ন্যায্য দাবির উদ্দেশে। সেদিনকার আন্দোলনের ফল ভোগ করছে আজকের বাংলাদেশ। আমাদের কথা বলার সময় উচিত যতটা পারা যায় শুদ্ধভাবে কথা বলা এবং বাংলা ভাষার সঙ্গে অন্য ভাষা মিশিয়ে ভাষার জগাখিচুড়ি না করা।’

ঢাকা কলেজের অর্থনীতি বিভাগের মাহমুদুন্নবী রিসল। ছবিধ সংগৃহীত
ঢাকা কলেজের অর্থনীতি বিভাগের মাহমুদুন্নবী রিসল। ছবিধ সংগৃহীত

সুবর্ণা মোস্তফা বলেন, ‘ভাষার কথা বলতে গেলে প্রথমেই মনে পড়ে বাংলা ভাষার কথা। জন্মের পর থেকেই আমরা আমাদের মায়ের কাছ থেকে বাংলা ভাষা শুনে আসছি। জীবনের এই পর্যায়ে এসেও আমরা বাংলা বলতে বা লিখতে ভুল করে থাকি, যা চূড়ান্ত লজ্জার কথা। আমাদের ভাষা বাংলা হলেও আমরা ইংরেজিসহ অন্যান্য ভাষায় বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকি। এর ফলে অন্যান্য ভাষায় আমরা ঠিক থাকলেও আমাদের আপন ভাষায় আমরা অদক্ষ, যা জাতি হিসেবে আমাদের লজ্জায় ফেলে দেয়। আমাদের উচিত শুদ্ধ বাংলা বলা, লেখা ও শেখা এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সুন্দর একটি ভাষা উপহার দেওয়ার চেষ্টা করা।’

কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সুবর্ণা মোস্তফা। ছবি: সংগৃহীত
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সুবর্ণা মোস্তফা। ছবি: সংগৃহীত

মাহমুদুন্নবী বলেন, ‘বাংলাদেশি এবং বাঙালির গর্ব করার মতো বিষয়গুলোর মধ্যে ভাষা অন্যতম। যদিও বিষয়টা কতটুকু অনুভব করি, তা ভাবার বিষয়। অনুভব করলে হয়তো নিজের মুখের ভাষা, মায়ের ভাষাকে যথাযথ সম্মানের সঙ্গে বলার চেষ্টা করতাম। বাংলায় কথা বলার সঙ্গে যে কতটা আবেগ জড়িত, সেটা বুঝতে একটি শব্দই যথেষ্ট, সেটি হলো মা। মা, মাটি, বাংলা ভাষা—সব একসুতোয় গাঁথা। ভালো থাকুক আমাদের মা, মাতৃভূমি সর্বোপরি প্রাণের বাংলা ভাষা।’

মাহফুজ আব্দুল্লাহর মতে, ‘মাতৃভাষা তথা বাংলায় শুদ্ধ ও প্রমিত উচ্চারণে কথা বলাও যে একটা শিল্পকর্ম, এটি উপলব্ধি করতে হলে হৃদয়ে মাতৃভাষার প্রতি ভালোবাসাকে লালন ও ধারণ করতে হবে। শুধু উৎসব বা দিবস পালন নয় বরং মাতৃভাষা চর্চায় ও ব্যবহারিক ক্ষেত্রে প্রয়োগে সবার আন্তরিকতা ও মমত্ববোধ প্রয়োজন।’

লেখক: শিক্ষার্থী, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়