আপা, গরিব মানুষগো জীবনটা আসলেই অদ্ভুত

পান, বাসের হেডলাইট পরিষ্কারের ব্রাশ বেঁচে কোনো রকমে দিন চলে যায় আবদুল কাদেরের। ছবি: লেখক
পান, বাসের হেডলাইট পরিষ্কারের ব্রাশ বেঁচে কোনো রকমে দিন চলে যায় আবদুল কাদেরের। ছবি: লেখক

ঘটনাটা লাল-নীল রাজধানী ঢাকার। আজিমপুর ম্যাটারনিটি হাসপাতাল পেরিয়ে এতিমখানা মোড় ঘুরে ঢাকেশ্বরী মন্দির যেতে হাতের বাঁয়ে পড়ে জায়গাটা। লোকটি ৮ থেকে ১০ বছর ধরে অবহেলায় দিনাতিপাত করছেন। নাগরিক সভ্যতায় মানবিক জীবন কি তিনি পেতে পারেন না?

ওই পথ দিয়ে দীর্ঘ সময় ধরেই যাতায়াত। চেনা পথের মোড়ে দিনের পর দিন লোকটিকে ঘাপটি মেরে রোদ-বৃষ্টি, ঝড়ঝঞ্ঝা, শীত-গ্রীষ্ম উপেক্ষা করে ফুটপাতের পচা নোংরা গন্ধভরা ড্রেনের ওপর বসে থাকতে দেখি। কৌতূহল হলে একদিন অনেকটা মায়া নিয়েই বৃষ্টির মধ্যে ওনার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। বললাম, চাচা, আপনি তো ভিজে যাচ্ছেন। নির্বিকার। আবার প্রশ্ন, এখানেই থাকেন রাতে? মাথা নেড়ে উত্তর দিলেন, হ্যাঁ, এখানেই থাকি।

রাস্তার ওপাশে দাঁড়িয়ে থাকা বাসচালকের এক সহকারীকে বললাম, ভাই, ওই দেয়ালের সঙ্গে যে পলিথিন, ওটা একটু ওনার মাথার ওপর টানিয়ে দিন না। লোকটি বললেন, আপা, আপনি চলে যান, আমি দিয়ে দেব। মনে মনে ভাবলাম, এ কেমন জীবন!

ভাবলাম, ওনার কি কেউ নেই? একদিন সময় করে বিস্তারিত কথা বলা দরকার। তা ছাড়া রোজ এমন লোকেদের রাস্তাঘাটে দেখে দেখে আমাদের চোখও তো ক্লান্ত। তবু গেলাম। পাশেই আমাকে বসবার জন্য একটু জায়গা করে দিলেন। বললেন, বসেন মা। বললাম, না থাক, দাঁড়িয়েই কথা বলি। কেউ বসলে, একটু গল্প করলে ভালো লাগে, বসেন। পাশে রাখা পিঁড়ির মতো তক্তপোশ নিজ হাতে ঝেড়ে দিলেন। বসলাম, গল্প করলাম খানিকক্ষণ। ওই ব্যক্তির নাম আবদুল কাদের। রাজধানীতে একসময় রিকশা চালাতেন। রিকশা চালাতে চালাতে হঠাৎ একদিন তাঁর দুই পা অবশ হয়ে যায়। তারপর থেকে আর কাজকর্ম করতে পারেন না।

পরিবারের আর কে কে আছেন—জানতে চাইলেই বললেন, স্ত্রী নেই মারা গেছেন। দুই ছেলে, এক মেয়ে। ছেলে নাকি হেরোইনের ব্যবসা করত। নারায়ণগঞ্জে বন্দুকযুদ্ধে মারা গেছে। আরেক ছেলে আছেন না নেই, বলতে পারলেন না। একবার বলেন সোনারগাঁও হোটেলের সামনে রিকশার ওপর ঘুমিয়ে ছিলেন। গাড়ি এসে চাপা দেওয়ায় মারা গেছেন। এক মেয়ে আছেন। পোশাক কারখানায় কাজ করেন। কিন্তু মেয়ের জামাই রাগারাগি করেন বলে মেয়েও আর বাবার খোঁজ নেন না। কী খান, খাবার কোথায় পান। বললেন, দিয়ে যায়। কে দিয়ে যায়? এসব আশপাশের দোকানদাররা দিয়ে যায় আর টাকা নিয়ে যায়। টাকা, সে কোথায় পান? এই যে পান বেচি, গাড়ির হেডলাইট, আবার বিরাশও (ব্রাশ) বেচি। এগুলো কীভাবে আনেন? আপনি তো চলাফেরা করতে পারেন না। হেরাই দিয়া যায়।

আগে বাটি নিয়ে বইসা থাকতাম। বাটি কি চাচা? চাচা মিটমিট করে হাসেন আর পাশে বসে থাকা নারীদের দিকে তাকান। নারীর বয়স ৫০ থেকে ৫৫ হবে। বললাম, আপনি চাচার কী হন? উত্তর এল ভাতিজি হই। খাবার কি আপনি এনে দেন? আমিও দিই আবার এহানকার (এখানকার) লোকজনরে কইলে তারাও আইনা দেয়। সেদিনের মতো কথা বলে চলে এলাম। আসার সময় বললাম, চাচা, আপনার একটা ছবি তুলতে পারি? একবাক্যে রাজি হয়ে গেলেন। তবে বললেন, জানেন মা, এর আগেও একজন ছবি তুইলা নিয়া গেছিল। আর কইছিল পেপারে দেব, কিন্তু আর আসেনি ওই লোক। আচ্ছা চাচা, আজ তাহলে আসি। এই বলেই হাঁটছিলাম ফুটপাতের ঠিক মাঝখান দিয়ে আর মনে মনে ভাবছিলাম, জীবন কত নিরুত্তাপ হয়, হয় কত অর্থহীন।

রাজধানী আজিমপুরের এতিমখানা মোড়ের এই জায়গায় বসবাস আবদুল কাদেরের। ছবি: লেখক
রাজধানী আজিমপুরের এতিমখানা মোড়ের এই জায়গায় বসবাস আবদুল কাদেরের। ছবি: লেখক

কয়েক দিন পর মনে হলো কী হবে কাদের চাচার পঙ্গুত্ব নিয়ে লিখে? কী হবে ওনার ফুটপাতের জীবনের গল্প লিখে? বদলে যাবে কি ওনার জীবন? ফিরে পাবেন কি হারানো সব। জানি কিছুই হবে না, তবু লিখতে ইচ্ছে করল। তাই আবার গেলাম কাদের চাচা সম্পর্কে একটু ভালো করে জানতে। ওনারই মতো বয়সী একজন বিড়ি-সিগারেট, চকলেট বিক্রি করেন আজিমপুর এতিমখানা মোড়ে। ভাবলাম, এ লোক নিশ্চয়ই ওনার (আবদুল কাদের) সম্পর্কে কিছু জেনে থাকবেন। কাজেই দোকানদার চাচার সামনে এগিয়ে গিয়ে লম্বা একটা সালাম দিয়ে বললাম, আমি কি আপনার সঙ্গে একটু কথা বলতে পারি? উনি বললেন, জি জি বলেন। আচ্ছা, ওই যে লোকটা (আবদুল কাদের চাচাকে দেখিয়ে) বসে আছেন, ওনার সম্পর্কে কি কিছু জানেন?

না, তেমন কিছু জানি না। তবে প্রায় ১০ বছর যাবৎ এখানে আছেন। আগে বসতেন এই বুথটার কাছে (হাতের ডানে দেখালেন)। তারপর ওইখান থেকে নিয়ে এলাম এখানে। যেখানে এখন আমার দোকান। কিন্তু কলোনির লোকজন অভিযোগ দেওয়া শুরু করল। কেন অভিযোগ দিল? তিনি নাকি কাজকাম সাইরা (প্রাকৃতিক কর্ম) ওই ড্রেনের মধ্যেই ফালায়। পানি ব্যবহার করে না। আর করব কেমনে। হেয় তো (তিনি তো) নড়াচড়া করতে পারে না। তারপর থেকে ওইখানে বসে। কেউ নেই ওনার? না দেহি না তো। তয় কয় পোলা–মাইয়া আছে। খোঁজখবর নেয় না। আবার কয়, পোলা মইরা গেছে। বউও নাই। তয় এক নারীরে দেখি আসে গাওগোসল (গোসল) করায়া দেয়, কিছু পয়সা নেয়। আমি বলি, সামনে তো ঝড়বৃষ্টির দিন। কেউ উনাকে দেখে না। কত রকম রাজনৈতিক মিটিং মিছিল তো এখান দিয়েই যায় বা হয়। কেউ একটু ফিরেও তাকায় না? কখনো কখনো সারা রাত বৃষ্টিতে ভেজে আবার এই কঠিন শীত এভাবেই পড়ে আছে বছরের পর বছর। কী অদ্ভুত মানুষের জীবন। দোকানদার লোকটি বলে উঠলেন, হ্যাঁ আপা, গরিব মানুষগো জীবনটা আসলেই অদ্ভুত।

কথা শেষ করে এগিয়ে এলাম কাদের চাচার দিকে। কী চাচা, শরীর ভালো। হ্যাঁ, ভালো। বলে আমার দিকে তাকিয়ে একটুখানি হাসলেন। খুব ইচ্ছে করল নিজের অজান্তেই এমন হাসি ফিরিয়ে দিতে পারতাম যদি, ভালো লাগত। কিন্তু সেই যোগ্যতা বা ক্ষমতা কোথায়, কেবল ওই ভাবনাটুকু ছাড়া। তবুও এ সমাজে উদার মানুষের একেবারে যে অভাব তা তো নয়! কেউ যদি একটুখানি উদারতার হাত বাড়ান অসহায় পঙ্গু আবদুল কাদের চাচার জন্য, তবে ক্ষতি কী!