ঢাকাকেন্দ্রিক নিয়োগ পরীক্ষায় বাড়ছে বেকারের যন্ত্রণা

ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

জীবনের নির্মমতম বাস্তবতার মুখোমুখি যৌবনের রোশনাই বঞ্চিত সংগ্রামী যুবাদের নামই হলো ‘বেকার’। প্রিয়-চেনা মুখগুলোর হঠাৎ পাল্টে যাওয়া দেখেও না দেখার ভান করা, বুকের কষ্টে পাথরচাপা দিয়ে ভালো কিছুর স্বপ্নে বিভোর হয়ে সম্মুখে ধাবমান তরুণ যুবকদের আহ্লাদী পেশার নামই হলো ‘বেকারত্ব’! আর অন্ধকার অমানিশার অতল গহ্বরে হারিয়ে যেতে যেতে জীবনপানে দুর্দান্ত রাজসিক প্রত্যাবর্তনকারী তাজা প্রাণের সমার্থক হলো তারুণ্য।

২.
বর্ণিল শিক্ষাজীবন শেষ করে আশার ভেলায় সওয়ার হয়ে যখন উন্নত ক্যারিয়ারের স্বপ্ন বা নিদেনপক্ষে একটি রুটিরুজির সন্ধানে হন্যে হয়ে ঘোরার সময় কোনো চাকরির বিজ্ঞপ্তি দেখে তখন আশার বীজ উপ্ত হওয়ার পাশাপাশি চাকরিপ্রত্যাশীদের চিন্তার ভাঁজ গ্রাস করে। কারণ একটি নিয়োগ পরীক্ষায় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা মানেই আবেদন ফি, ঢাকায় আসা-যাওয়া, খাওয়া বাবদ বাড়তি খরচের চাপ তাঁর শূন্য পকেটের অবস্থা ঋণাত্মক পকেটে রূপান্তর করে। এর ওপর চাকরি পাওয়ার নিশ্চয়তা তো নেই–ই। পরিবার যখন আশা করে তিনি কিছু আয় করবেন, তখনই তাঁর আরও বেশি কিছু খরচ করার প্রয়োজন হয়ে পড়ে। ফলে প্রায়ই পরিবারে মারাত্মকভাবে বিব্রত ও ব্রাত্য হয়ে ওঠেন। এই হতাশা কাটিয়ে ওঠা অনেকের পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠে না। হয় তিনি পথ হারায়, অথবা এমন ঘটনায় ঘটে জীবন থেকে ছুটি নেন। অথচ তাদের এই দুর্দিনে আমাদের সামান্য মানবিকবোধ, ব্যবসায়িক চিন্তা বাদ দেওয়া তাদের পক্ষে একটি বিপ্লবসম আশীর্বাদ হয়ে আসতে পারে। নিয়োগ পরীক্ষাকে কমপক্ষে বিভাগীয় শহরকেন্দ্রিক করলে এই যুবকদের পকেটটি একটু হলেও কম কাটা পড়ে। আর পরীক্ষার ফিস তো কমাতেই হবে। বেকারত্বকে পুঁজি করে রাষ্ট্র ব্যবসা করতে পারে না। এটা কল্যাণকামী রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য নয়।

৩.
বর্তমানে বিসিএস পরীক্ষার প্রিলিমিনারি ও লিখিত ধাপের পরীক্ষা বিভাগীয় শহরে নেওয়া হয়। কাজেই কর্তৃপক্ষ আন্তরিকভাবে চাইলে সব নিয়োগ পরীক্ষা বিভাগীয় শহরে আয়োজন করা অতি সহজ। এ ছাড়া ঘন ঘন নিয়োগ পরীক্ষা না নিয়ে সমন্বিত পরীক্ষা নিয়ে প্যানেল আকারে চাকরি দিলে চাকরিদাতা ও প্রার্থী উভয়েরই ঝক্কি কমে। ইদানীং যেকোনো নিয়োগ পরীক্ষায় বিশালসংখ্যক প্রার্থী অংশগ্রহণ করেন। এতে ঢাকার ওপর যেমন বাড়তি চাপ তৈরি হয়, তেমনি পরীক্ষার্থীদেরও মারাত্মক ভোগান্তি হয়। সাম্প্রতিক প্রথম আলোর এক প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে ঢাকার বায়ু পাঁচ গুণ বেশি দূষিত। এ ছাড়া অসহনীয় যানজট তো আছেই। মেগাসিটি ঢাকা ও ঢাকাবাসীদের বাঁচাতে এই শহরের ওপর অযাচিত চাপ যত কমানো যাবে, ততই ভালো।

সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষার্থীদের সুবিধার্থে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা আয়োজন কার্যক্রম গ্রহণ করা হচ্ছে। এই পদ্ধতি চাকরির পরীক্ষার ক্ষেত্রেও মডেল হতে পারে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ওয়েবসাইটে একবার নিবন্ধন করলে এর অধীন সব নিয়োগ পরীক্ষায় এক ক্লিকে আবেদন করা যায়। এভাবে চাকরিপ্রার্থীদের একটি সেন্ট্রাল ডেটাবেইস সংরক্ষণ করে সহজে আবেদনপ্রক্রিয়া সম্পাদন করা যায়। এ ছাড়া গ্রেডভিত্তিক বার্ষিক একটি নিয়োগ পরীক্ষা নিয়ে প্যানেল থেকে সারা বছর শূন্য পদে নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে।

৪.
অর্জিত জ্ঞানকে নিজ ও রাষ্ট্রের কল্যাণে কাজে লাগাতে ব্যাকুল তারুণ্যের এই তীব্র জোয়ার সৃষ্টির কারণ যে শুধুই চাকরি করার লোভ এমন নয়। অনেকে বেকারত্বের কথা উঠলেই উদ্যোক্তা হওয়ার সবক দিয়ে থাকেন। কিন্তু উদ্যোক্তা হওয়ার পথটা মসৃণ করতে কতটুকু কাজ আমরা করেছি? মুদিখানার মতো অনার্স-মাস্টার্স কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা হয়েছে। গড়পড়তা সবাইকে কর্মমুখী শিক্ষাবঞ্চিত করে মাস্টার ডিগ্রি দিয়ে চাকরির জন্য সম্পূর্ণ ভিন্ন সিলেবাস ধরিয়ে দিচ্ছি। ফলে পাঁচ বছর ধরে অর্জন করা জ্ঞান তেমন কাজে আসছে না। চাকরির জন্য নতুন করে প্রস্তুতি নেওয়া ও তাতে অংশগ্রহণ করা দুটোই সময়সাধ্য ও আর্থিক ক্ষতিযুক্ত। বাস্তবজ্ঞানভিত্তিক কর্মমুখী শিক্ষাব্যবস্থা প্রণীত না হওয়া পর্যন্ত বেকারদের সবক নয়, বরং কর্মের খোঁজ দিলেই তাঁরা বেশি খুশি হবেন।

বেলা ফোরানোর আগেই বৃদ্ধ বাবার কষ্টের ভার লাগবের প্রাণান্ত চেষ্টা করা যুবকের শ্রম ও ঘামের দাম দিতেই হবে। অথবা জন্মদাত্রী মা-জননীর মলিন মুখে শান্তির আভা এনে নিশ্চিন্তে দুবেলা মাছ-ভাতের স্বপ্ন দেখা যুবকের প্রাণচাঞ্চল্য ফুরিয়ে আসার আগেই তাঁর পাশে দাঁড়াতে হবে। একটু মায়াবী বাক্যবিনিময়, সহানুভূতিশীল দৃষ্টিভঙ্গি আর প্রাপ্য মর্যাদার দৃষ্টিপাত আজকের বেকার যুবকদের কালকের স্বর্ণমানবে পরিণত করতে পারে। তাঁদের সৃষ্টিশীলতা ও দেশপ্রেমের দ্যুতিতে বিদ্যমান অসাড় কাঠামোয় আনতে পারে গতির জোয়ার। জীবনপথের চরম দুর্দিনে চলমান পদ্ধতিতে সামান্য পরিবর্তন চাওয়া তাঁদের দাবি নয়, বরং অধিকার।

লেখক: আইন কর্মকর্তা, অগ্রণী ব্যাংক লিমিটেড। bellal. sincere@gmail. com