একটি আংটির না বলা গল্প

আমার জন্ম দুর্গম আফ্রিকার কোনো এক খনিতে। শত শত শ্রমিকের দুঃখ, দুর্দশা ও কষ্টের ঘর্মাক্ত স্পর্শ আর অজস্র মানুষের লোভ–লালসা যেন এখনো আমার গায়ে লেগে আছে। নাকি পুরাটাই অনুভূতির ব্যাপার, কে জানে? জন্মের সময় আমি পুরোপুরি বাইশ ক্যারেটের ছিলাম। কিন্তু মানুষের হাতে পড়ার পর আমাতে খাঁদ মেশে, বারবার হই কলুষিত, দেহের আকার বদলে যায়, আর শেষে এসে পরিণত হই আঙুলের সামান্য এক আংটিতে। কত গহনার দোকানের কাচঘেরা আঙিনায় আমার স্থান হয় তার ইয়ত্তা নেই। কত রকম মানুষ আমাকে রোজ দেখতে আসে, নানা বর্ণের, কেউ একা আসে, কেউ আসে তার ভালোবাসার মানুষকে নিয়ে, আমাকে দেখে আকর্ষিত হয়, পুলকিত হয়, কারও চোখে ভালোবাসা দেখতে পাই তো কারও চোখে আমার জন্য লোভ ঝরে পড়ে। তবে এই মানুষের সমাজে আমার অনেক দাম, অনেক আধিপত্য—সেটা বুঝতেও আমার দেরি হয় না।

এক সকালের কথা। জহুরি তার দোকান খুলে আমার ঝাড়পোছ করছে, ঠিক সে সময় হাত ধরাধরি করে এক জোড়া ছেলে আর মেয়ের প্রবেশ। তারা দোকান ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগল। আমার চোখের ঘুম তখনো কাটেনি, বেশি পাত্তা দিলাম না, কত মানুষই তো রোজ আসে।

‘আমরা আসলে একটা আংটি খুঁজছি, বিয়ের আংটি’—ছেলেটাকে বলতে শুনে আমি আড়মোড়া ভেঙে তাকালাম, মেয়েটার চোখে স্পষ্ট লজ্জা দেখতে পেলাম যেন। জহুরি তাদের নানা রকম আংটি দেখাতে লাগল, শেষে এসে তিন জোড়া চোখ আমার ওপর স্থির হলো। জহুরি আমার রূপ–গুণ ও আকার–আকৃতি বর্ণনা করতে লাগলেন। আমি আগন্তুকের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। ছেলেটা ধনী আর মেয়েটা সুন্দরী। আমাকে দেখে মেয়েটার চোখে লজ্জা যেন আরও একটু বাড়ল। লজ্জার সঙ্গে আর একটা অনুভূতিও আছে নাকি? ঠিক বুঝতে পারলাম না। মেয়েটার সেই লজ্জা ছেলেটার চোখে পড়ল। ‘আমরা এটাই নেব’—ছেলেটা জহুরিকে বলল।

এরপর আর কী? বিপুল পরিমাণ অর্থের বিনিময়ে জহুরি আমাকে ছেলেটার হাতে তুলে দিলেন। এই অনুভূতিটা আমার বড় ভালো লাগে। আমাকে ছেড়ে প্রচুর টাকা পেয়ে জহুরি খুশি, আবার আমাকে পেয়ে প্রেয়সীর মন পেয়েছে ভেবে ছেলেটাও খুশি। সে সঙ্গে সঙ্গেই মেয়েটাকে আংটিটা পরিয়ে দিল। ‘ওমা, এখনই কেন? মেয়েটা অবাক হয়। থাক, তোমার কাছেই, আকদের আগে একদিন নিয়ে নিলেই হবে—ছেলেটা হেসে বলে। আর আমিও খুশি ক্রেতা–বিক্রেতা দুজনকেই খুশি করতে পেরে।

এরপর? এরপর আর কী? দুজনের বিয়ে হয়ে গেল একদিন। চারদিকে অজস্র আলোর ঝলকানি, আতশবাজি, খাওয়াদাওয়া আর এর মধ্যেই মেয়েটার অনামিকায় স্থায়ী হয়ে গেলাম। এরপর বাসররাত, খুনসুটি, হানিমুন, অনেক প্রেম–ভালোবাসা, মিলন আর শেষে ক্লান্তি—এই সবকিছুর সাক্ষী আমি। ছেলেটা ধনী আর মেয়েটা সুন্দরী। টাকা থাকলে সৌন্দর্য পাওয়া যায় আর সৌন্দর্য থাকলে টাকা—একটা তো আরেকটারই পরিপূরক। মানুষ এই নববিবাহিতাকে দেখে প্রশংসার দৃষ্টিতে তাকায়। আর এরাও অনেক সুখী একে অপরকে পেয়ে। সবকিছু সুন্দর, পরিপাটি আর ভালোবাসায় ভরপুর।

কিন্তু একদিন ঝড় আসে। শুরু হয় মনোমালিন্য, এরপর ঝগড়াঝাঁটি, ছেলেটা রেগে মেয়েটার গালে প্রচণ্ড এক থাপ্পড় বসিয়ে অফিসের পথে বেরিয়ে যায়। মেয়েটা কাঁদতে থাকে। আমি ঠিক বুঝতে পারি না কী থেকে কী হয়ে গেল? সব তো ভালোবাসায় পরিপূর্ণ ছিল। অবশ্য সব জানার কথাও না আমার এখন। কারণ, অনামিকা থেকে আমার স্থান এখন খাটের পাশের ড্রেসিং টেবিলে হয়েছে অল্প কিছুদিন আগে। হঠাৎ দরজায় ঠক ঠক। কে যেন এসেছে? বোধ হয় স্বামী বেচারাই, ক্ষমা চাইতে ফিরে এসেছে। মেয়েটা দরজা খুলে দিল, দুজন কিছুক্ষণ হাসাহাসি। যাক সব ঠিক হয়ে গেল তাহলে। আমি খুশি হই। কিন্তু ছেলেটার গলার আওয়াজ এমন লাগছে কেন? কেমন যেন অপরিচিত?

ছেলেটা এগিয়ে এসে বলে, ‘তোমার স্বামী শেষ পর্যন্ত সব জেনে গেল?’

‘সবটা জানে না এখন, তবে সন্দেহ করে অনেক, আমাদের আরও সতর্ক হওয়া উচিত।’ মেয়েটা জবাব দেয়।
‘আমার কিছু টাকা দরকার, ম্যানেজ করে দাও না একটু—তোমার স্বামীর তো অনেক টাকা।’
‘টাকা আছে ঠিকই, কিন্তু একটা পয়সাও আমাকে দেয় না, এমনকি বিয়ের সব গয়নাও তার মা রেখে দিয়েছে।’
‘তুমি দিলে কেন? শাশুড়ির কাছ থেকে কৌশলে নিয়ে নাও না।’
‘চেষ্টা তো করছি, শাশুড়ি আমাকে সন্দেহ করে, তাই দিতে চায় না কিছুই। চিন্তা করো না তুমি, যেদিন আমরা পালিয়ে যাব, সব নিয়ে যাব।’
‘সেটা তো বুঝলাম, কিন্তু এখন আমার কিছু টাকার খুব দরকার। এই আংটিটা সুন্দর তো, এটা নিয়ে যাই?’ বলেই ছেলেটা আমাকে তুলে নেয়, ঘুরিয়ে দেখতে থাকে আমাকে, কেমন অপরিচিত স্পর্শ, আমার অস্বস্তি লাগে।
‘কী বলো? এটা আমার বিয়ের আংটি? অনেক শখ করে কিনে দিয়েছে সে, এটা নিয়ে গেলে আমি তাকে কী বলব?’ মেয়েটা জবাব দেয়।
‘তোমার স্বামীর এত সময় কোথায় যে সে এসব দেখবে? আমার টাকা দরকার, এটা বেচে ভালোই টাকা পাওয়া যাবে মনে হচ্ছে।’
‘এটা আমি দিতে পারব না, এটা ছাড়া অন্য কিছু চাও তুমি।’ মেয়েটার আকুতি ঝরে পড়ে।

ছেলেটা মেয়েটার মন ভোলায়, মেয়েটাও তার ফাঁদে পা দেয়। আংটিটা ছেলেটার হাতে তুলে দেয়। আর আমি দীর্ঘশ্বাস ছাড়ি। বোকা মেয়ে, ছেলেদের কথায় কি এত সহজে ভুলতে হয়? অবশ্য মানুষ চিরন্তনই এমন, তাদের কত লোভ, লালসা, স্বার্থ, পাপ দেখলাম আমার এই জীবনে। হঠাৎ মনে পড়ে, আমাকে কেনার সময় মেয়েটার চোখে লজ্জার পাশাপাশি আরও একটা অনুভূতি ছিল। সেটা ছিল লোভ, আজ বুঝতে পারলাম।

এরপর? এরপর আবার কিছু অর্থের বিনিময়ে নতুন এক জহুরির কাচঘেরা দোকানে আমার স্থান হয়। আর আমি অপেক্ষা করতে থাকি, কেউ আসবে, আমাকে আবার নিয়ে যাবে নতুন কোথাও—নতুন কিছু দেখার অপেক্ষায় আমার দিন কাটতে থাকে।