সাজেকের যে স্মৃতি সহজে হারানোর নয়

সাজেকে শুভ্র মেঘেদের ভেলা। ছবি: লেখক
সাজেকে শুভ্র মেঘেদের ভেলা। ছবি: লেখক

প্রকৃতির সৌন্দর্যের মোহে মানুষ বরাবরই নেশাগ্রস্ত। ব্যস্ততা, পড়াশোনা, হতাশা, চাপ, দৈনন্দিন কাজকর্ম থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে মনের প্রশান্তি, সজীবতার জন্য ভ্রমণের বিকল্প অন্য কিছু হতে পারে না। পায়ের নিচে মেঘ আর সবুজের চাদর বিছানো গল্প শুনেছি, ছবিতে দেখেছি অনেক। কিন্তু সামনাসামনি দেখার সৌভাগ্য হয়নি। তাই এবার আর সেই সুযোগ হারাতে চাইনি। ঢুঁ মেরে এসেছি সেই ধবধবে সাদা মেঘেদের রাজ্য থেকে। যেখানে পাহাড়ের গায়ে হেলান দিয়ে মেঘেরা ঘুমায়। মনের পাতাহীন স্মৃতির ডায়েরিতে যুক্ত হয়েছে আরও কিছুটা বাস্তব অভিজ্ঞতা।

পাহাড়ের পাশ ঘেঁষে যখন আমাদের বাসটা শোঁ শোঁ করে দীঘিনালার দিকে এগিয়ে চলছে, তখন থেকেই প্রকৃতির অভ্যর্থনা বুঝতে পেরেছি। সাপের মতন আঁকাবাঁকা রাস্তাগুলো সাপের মতনই ভয়ংকর। একটু অসাবধানতা কিংবা দুর্ঘটনা মুহূর্তেই খাদে ফেলে চিরতরে ঘুম পারিয়ে দেবে। যেটা নিয়ে অনেকটা ভয় কাজ করছিল মনে। তবু চাপা উত্তেজনা।

খাগড়াছড়ির দীঘিনালা নেমে সেখান থেকে চান্দের গাড়িতে উঠে সাজেকের উদ্দেশে যাত্রা। বসেছিলাম চান্দের গাড়ির পেছনের সিটে, ছাদের ওপরে। যে কারণে বাইরের প্রকৃতিটা পুরোপুরি চোখের সামনে ভেসে উঠেছিল। চারদিকে উঁচুনিচু পাহাড় আর সবুজ মিলে একটা মনোমুগ্ধকর দৃশ্য। গাড়িটা কখনো সোজা খাড়াভাবে ধোঁয়া ছেড়ে ওপরের দিকে উঠছে, আবার কখনো খাড়াভাবে নিচের দিকে নেমে এক দম বন্ধকরা পরিস্থিতির সৃষ্টি করে রেখেছে দুর্গম পাহাড়ি রাস্তায়। দূরের উঁচু পাহাড়গুলো মনে হচ্ছিল যেন কাছে চলে আসছে, এমন একটা ভ্রম তৈরি হয়েছিল চোখে।

সাজেক যাওয়ার পথে চারদিকে উঁচুনিচু পাহাড় আর সবুজ মিলে মনোমুগ্ধকর দৃশ্যের দেখা মেলে। ছবি: লেখক
সাজেক যাওয়ার পথে চারদিকে উঁচুনিচু পাহাড় আর সবুজ মিলে মনোমুগ্ধকর দৃশ্যের দেখা মেলে। ছবি: লেখক

চলার পথে রাস্তায় সেখানকার স্থানীয় উপজাতি বাচ্চাগুলো হাসিমুখে হাত নাড়িয়ে উষ্ণ অভিবাদন জানাচ্ছিল সবাইকে। বিরতির সময় নিজেদের চাষ করা কমলা, আখ, পেঁপে, বাদাম ইত্যাদি নিয়ে ছুটে আসছিলেন অনেকেই। প্রয়োজনের তাগিদে শেখা ভাঙা বাংলায় ডেকে ডেকে বলছে ‘বিছ টাকা, পচিছ টাকা...।’

সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১ হাজার ৮০০ ফুট উঁচু সাজেক ভ্যালিতে পৌঁছে একটু জিরিয়ে খাওয়াদাওয়া শেষ করে সাজেকের সবচেয়ে উঁচু কংলাক পাহাড়ের উদ্দেশে বের হই। পাহাড়ে উঠে প্রচণ্ডভাবে ক্লান্ত হলেও প্রকৃতি সেটা বেশিক্ষণ থাকতে দেয়নি। আশপাশের সুন্দরের মোহে আকর্ষিত হয়ে সব ভুলে প্রকৃতি উপভোগ করতে থাকি। কেউ এক মনে দূরের আকাশের দিকে তাকিয়ে, কেউবা নিজে মোবাইল–ক্যামেরায় প্রকৃতির সৌন্দর্যবন্দীতে ব্যস্ত। চারপাশে তাকিয়ে উঁচুনিচু পাহাড়গুলোকে মনে হচ্ছিল সবুজ ঘাসের চাদরে ঢাকা সব। আকাশটা যেন অনেকটা মাথার কাছে চলে এসেছে। তারপর যখন ধীরে ধীরে সূর্য ডোবা শুরু হলো, তখন যেন অন্য রকম এক রূপ ধারণ করল। যেন আরও ভয়ংকর সুন্দর হতে লাগল চারপাশ। সময়ের স্বল্পতার কারণে মোহ কাটিয়ে ফিরতে হলো সেখান থেকে। তারপর জ্যোৎস্নাবিহীন ঘুটঘুটে অন্ধকার রাতে সাজেকের আকাশে দেখা মিলল অজস্র তারার সঙ্গে। মনে হচ্ছিল তারা নিজেদের সঙ্গে নিজেদের ভাষায় কথা বলছে, গল্প করছে। সেখানকার হেলিপ্যাডে কিংবা অন্য কোথাও খোলা আকাশের নিচে বসে আকাশভরা তারাদের এমন মনোরম দৃশ্য দেখে যেকেউ নিজেকে সৌরমণ্ডলের ভিন গ্রহে আছি বলে দাবি করতেই পারেন।

পাহাড়ে সূর্যোদয় দেখার মজাই আলাদা। ছবি: লেখক
পাহাড়ে সূর্যোদয় দেখার মজাই আলাদা। ছবি: লেখক

তখন রাত প্রায় তিনটা। চারদিকে সুনসান নীরবতা, কোনো যান্ত্রিকতা নেই। রিসোর্টের জানালা খুলে বাইরে তাকিয়ে অনেকটা অবাক বনে গেলাম। যেখানে দিনের বেলায় বড় বড় গাছের মনে হচ্ছিল সবুজ ঘাসের চাদর, সেখানটা নদীর মতো দেখাচ্ছে। এক অদ্ভুত রকমের সুন্দর সৃষ্টি হয়ে আছে বাইরে। অতিরিক্ত ঠান্ডার কারণে বেশিক্ষণ দাঁড়ানো সম্ভব হয়নি জানালার পাশে। যদিও জানালা দিয়ে মেঘেরা ঘরে ঢুকে ঘুম ভাঙানোর অনেক কাহিনি আছে কিন্তু আমাদের সেটা অনুভব করার সৌভাগ্য হয়নি। তারপর ভোর পাঁচটার দিকে রিসোর্ট ছেড়ে মেঘ আর সূর্যোদয় দেখার উদ্দেশ্যে হ্যালিপ্যাডের দিকে সবাই মিলে পদযাত্রা শুরু। খানিক বাদেই দেখা যায়, দূর পাহাড়ের পেছন থেকে সূর্যের রক্তিম লালচে আভা আস্তে আস্তে আলো ছড়াচ্ছে। পাহাড় আর গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে ধীরে ধীরে সূর্য মাথা ভাসাচ্ছে।

দূর পাহাড়ে সূর্যের রক্তিম লালচে আভায় আকর্ষিত হয়ে সব ভুলে প্রকৃতি উপভোগ করেন অনেকে। ছবি: লেখক
দূর পাহাড়ে সূর্যের রক্তিম লালচে আভায় আকর্ষিত হয়ে সব ভুলে প্রকৃতি উপভোগ করেন অনেকে। ছবি: লেখক

সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে সূর্যোদয় উপভোগ করছে। যদিও সূর্য প্রতিদিন ওঠে এবং সেটা আমাদের চোখে প্রায়ই পড়ে কিন্তু এখানকার সূর্যোদয় অন্য রকম এক সৌন্দর্যের মনোরম দৃশ্যের সৃষ্টি করেছে, যা অন্য সব সূর্যাস্তের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। অন্যদিকে স্পষ্টভাবে মেঘেদের দেখা যাচ্ছিল পায়ের নিচের পাহাড়গুলোয়। যেন তাদের নিজেদের সীমানা অতিক্রম করে আর ওপরে উঠতে পারছে না। তুলার মতন সাদা মেঘগুলো ভেসে ভেসে বেড়াচ্ছে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে। সে কী যে এক অপরূপ নৈসর্গিক দৃশ্য, যেটা ভাষায় প্রকাশ করা দুষ্কর। দূর আকাশের কল্পনার মেঘেরা আজ পায়ের নিচে। ইচ্ছা করছিল তাদের কাছে ছুটে গিয়ে স্পর্শ করে আসি, অনুভব করি তাদের। নিজেদের রাজ্যে নিজেদের ভাষায় কথা বলছে মেঘেরা, স্বাধীনভাবে উড়ে বেড়াচ্ছে তাদের সীমানা ঘেঁষে। শত শত মানুষ ওপর থেকে তাদের আনাগোনা দেখছে। নিজেদের ক্যামেরাবন্দী করছে মেঘেদের সঙ্গে, বান্দরবানের সাজেকের অপরূপ নৈসর্গিক সুন্দরের সঙ্গে। নির্দিষ্ট সময় পর সেখান থেকে ফিরে এসেও মেঘ দেখার লোভ সামলানো যায়নি। রিসোর্টের জানালা খুলে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে বারবার দেখতে বাধ্য হয়েছি শুভ্র মেঘেদের ভেলা। যে স্মৃতি সহজে হারানোর নয়। গল্প হয়ে গেঁথে আজীবন বেঁচে থাকবে মনের পাতাহীন স্মৃতির ডায়েরিতে।

সাজেকের রিসোর্টগুলোও ভিন্ন ভিন্ন সাজে সাজানো। কোনোটা সম্পূর্ণ বাঁশের তৈরি, কোনোটা কাঠের, আবার কোনোটা খড়ের। সবগুলোই ভিন্ন ভিন্ন দিক থেকে ভিন্নভাবে আকর্ষণীয় এবং নজরকাড়া বৈশিষ্ট্যের দাবিদার।

মুগ্ধ হতে হয় শুভ্র মেঘেদের এমন ভেলা দেখে। এমন ছবি গল্প হয়ে গেঁথে আজীবন বেঁচে থাকে পাতাহীন স্মৃতির ডায়েরিতে। ছবি: লেখক
মুগ্ধ হতে হয় শুভ্র মেঘেদের এমন ভেলা দেখে। এমন ছবি গল্প হয়ে গেঁথে আজীবন বেঁচে থাকে পাতাহীন স্মৃতির ডায়েরিতে। ছবি: লেখক

ফেরার আগে খাগড়াছড়ির আলুটিলার অন্ধকার গুহা, খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদ হর্টিকালচার পার্ক আর হাজারছড়ি ঝরনার রূপের সাক্ষাৎ মিলেছে। যাদের নিজেদের সৌন্দর্যের আলাদা বৈশিষ্ট্যের বর্ণনা রয়েছে।

সাজেকের সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ যেন বাঁশ
সাজেকে বাঁশের বহুবিধ ব্যবহারের দেখা মিলেছে, যেটা চোখে পড়ার মতনই বিষয় ছিল। বিশেষ করে খাবারে। চা থেকে শুরু করে মাংস পর্যন্ত বাঁশের ব্যবহার। তা ছাড়া সেখানকার অনেক রিসোর্টও বাঁশের তৈরি এবং অনেকগুলোর নামের আগেও ব্যাম্বো শব্দটা জুড়ে দেওয়া। যেন তাদের সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ এই বাঁশ।

সময় আর জীবনের তাগিদে আবার অপরূপ নৈসর্গিক প্রকৃতি ছেড়ে ফিরে আসতে হয়েছে যান্ত্রিক নগরীতে, পেছনে পড়ে আছে শুভ্র মেঘেদের স্মৃতি...।

লেখক: শিক্ষার্থী, ড্যাফোডিল আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়।