ভারতঘেঁষা তিস্তাপাড়ের জনজীবন

বাংলাদেশ-ভারতের কালীগঞ্জ সীমান্তে তিস্তা নদী। ছবি: লেখক
বাংলাদেশ-ভারতের কালীগঞ্জ সীমান্তে তিস্তা নদী। ছবি: লেখক

সকাল ১০টা। ফাল্গুনের ঝলমলে রৌদ্রোজ্জ্বল দিন। শ্বশুরবাড়ি নীলফামারীর ডিমলা থানার ছাতনাই কলোনি বাজারের পাশে। সেখানে গেলে প্রায় প্রতিবারই আমি কালীগঞ্জ সীমান্ত এলাকা ঘুরে আসি। এবারও তার ব্যতিক্রম হলো না।

আমি ও আমার স্ত্রী হঠাৎ করেই পরিকল্পনা করলাম, কালীগঞ্জ সীমান্তে যাব। যে কথা সেই কাজ। শ্বশুরের মোটরসাইকেলে চড়ে ছাতনাই কলোনি বাজারের ভেতর দিয়ে তিস্তার বাঁধের ওপর বেশ এবড়োখেবড়ো মাটির রাস্তা মাড়িয়ে চল্লিশ কিংবা পঁয়তাল্লিশ মিনিট পর আমরা পৌঁছে যাই কালীগঞ্জ সীমান্তে। এই বাঁধ মূলত যৌথ বাঁধ নামে এলাকার মানুষের কাছে পরিচিত।

১৯৯৮ সালের ৩ অক্টোবর, (১৮ আশ্বিন ১৪০৫ বঙ্গাব্দ) তিস্তা ডানতীর বাঁধের জিরো পয়েন্টে বাংলাদেশ-ভারতের কালীগঞ্জ সীমান্তে সংযোগ বাঁধের শুভ উদ্বোধন করেন সাবেক পানিসম্পদমন্ত্রী প্রয়াত আবদুর রাজ্জাক। মোটামুটি মাঝারি সাইজের একটি নামফলকে এ লেখা চোখে পড়বে একেবারে জিরো পয়েন্টে। এর কয়েক ফুট দূরেই তিনটি পিলার। ওই পিলারের ওপারে ভারতের কোচবিহার জেলার মেখলিগঞ্জ মহকুমার হলদিবাড়ি পৌরসভার বিভিন্ন গ্রাম। সীমান্তের সঙ্গেই লাগোয়া গ্রামের নাম দাড়িপাট্টানি। ঠিক এই গ্রামের মধ্য দিয়েই তিস্তা নদী ঢুকেছে বাংলাদেশের ভূখণ্ডে। আর এখানেই জমেছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অভিনব লীলাকীর্তন। খরস্রোতা এই নদী অগভীর, শুষ্ক মৌসুমে পানি থাকে না বললেই চলে। ধু ধু বালুচর। এসব চরে বিশেষ করে ভুট্টা চাষ হয়ে থাকে। ভারত থেকে চুয়ে আসা অল্প পানি আর চরের সবুজ ফসল এক চমৎকার সুন্দর দৃশ্যর সৃষ্টি করেছে। এই দৃশ্য শুধু আমরা নয়, যে ব্যক্তি নতুন এখানে যাবে, তাকে মুগ্ধ না করে পারবে না!

তিস্তার চরে ভুট্টা চাষ হয়ে থাকে। ভারত থেকে চুয়ে আসা পানি আর চরের সবুজ ফসল চমৎকার সুন্দর দৃশ্যের সৃষ্টি করেছে। ছবি: লেখক
তিস্তার চরে ভুট্টা চাষ হয়ে থাকে। ভারত থেকে চুয়ে আসা পানি আর চরের সবুজ ফসল চমৎকার সুন্দর দৃশ্যের সৃষ্টি করেছে। ছবি: লেখক

বাংলাদেশ সীমান্ত যেখানে শেষ ঠিক সেখানেই বিশাল বাঁশঝাড়ের নিচে বেশ বড়সড় বসার টং পাতানো আছে। সম্ভবত বর্ডার গাড বাংলাদেশের (বিজিবি) কোনো ব্যাটালিয়ন এটি তৈরি করেছে। কেননা, তারা টহলের সময় এখানে এসে মাঝেমধ্যে বসে বিশ্রাম নেয়। আমরা যখন যাই, সে সময় গ্রামবাসী ছাড়া তেমন কোনো পর্যটক সেখানে ছিলেন না। তাই আমরা বেশ আয়েশ করে সেখানে কিছুক্ষণ বসে থাকলাম। সবুজ–শান্ত পরিবেশ। শহুরে পরিবেশ থেকে কেউ গেলে তার মন আর ফিরে আসতে চাইবে না। এরপর আমরা বাঁধের নিচে সবুজ ঘাসের রাস্তা ধরে হাঁটলাম কিছুক্ষণ। মৃদুমন্দ বাতাস আমাদের শরীরে আলতোভাবে লাগতে থাকল আর হৃদয়ে অন্য রকম শিহরণ জাগিয়ে তুলেছিল। কিছুক্ষণ পরেই আমরা নদীর তীরে চলে যাই। সেখানের একটি টংঘরের সন্ধান পেলাম। ওখানেও বসে ছবি তুলতে ভুল করলাম না। এরপর আমরা নদীর পানিতে নেমে যাই, যদিও তার দ্বিমত ছিল। আমি বললাম, ওহে, নদীতে এসে নদীর জলে পা না ভেজালে নদীভ্রমণই বৃথা। যেহেতু শুষ্ক মৌসুম, তাই নদীতে হাঁটুজল। আমরা হাঁটুজল মাড়িয়ে ওপারে চলে যাই। হালকা ভেজা নদীর চরে আমরা দৌড় প্রতিযোগিতা দিই। দিয়ে ওপারের সবুজ ভুট্টাখেতের পাশে চলে যাই। সেখানে গিয়ে দেখি, নদীর আরেকটি শাখা বের হয়েছে। এই শাখাটি একটু গভীর।

ধীরে ধীরে দুপুর হয়ে আসছিল। রোদের তাপও বাড়তে থাকল। আমরা এবার ফেরার পথ ধরলাম। ফিরতেই ওই এলাকার ঐতিহ্যবাহী তরতাজা নাপা শাক (ডাকনাম) আমার বউয়ের চোখে পড়ল। এই শাক আবার বউয়ের বেশ প্রিয়। এটা শুধু তারই প্রিয় না, ওই এলাকার সবারই প্রিয় শাক। গ্রামের বউদিকে জিজ্ঞাসা করল, বউদি দেওয়া যাবে নাকি? তিনিও দ্বিমত করলেন না। তাঁর সঙ্গে আরও কয়েকজনকে ডেকে নিয়ে প্রায় এক ব্যাগ নাপা শাক তাঁকে দিয়ে দিলেন। চলে আসার সময় বললেন, আবার আসবেন। এ রকম সহমর্মী আচরণ দেখে আমার বউ বললেন, দেখেছ আমাদের এলাকার লোকজন কত অতিথিপরায়ণ। উত্তরে মাথা ঝাঁকিয়ে হুঁ বললাম। পাশেই মোটরসাইকেল পার্ক করা ছিল। দেরি না করে দুজনে মোটরসাইকেল চেপে বাড়ির পানে রওনা হলাম। আর রেখে গেলাম এক অনন্য স্মৃতি।

ভারত সীমান্তের সঙ্গেই লাগোয়া গ্রাম দাড়িপাট্টানি। ঠিক এই গ্রামের মধ্য দিয়েই তিস্তা নদী প্রবেশ করেছে বাংলাদেশের ভূখণ্ডে। ছবি: লেখক
ভারত সীমান্তের সঙ্গেই লাগোয়া গ্রাম দাড়িপাট্টানি। ঠিক এই গ্রামের মধ্য দিয়েই তিস্তা নদী প্রবেশ করেছে বাংলাদেশের ভূখণ্ডে। ছবি: লেখক

যেভাবে যাবেন
ঢাকা থেকে ডিমলা। নাবিল পরিবহন, হানিফ এন্টারপ্রাইজ, এনা পরিবহনসহ আর বেশ কিছু বাস চলাচল করে। রাজধানীর গাবতলী, মাজার রোড, কল্যাণপুর থেকে এসব বাস সরাসরি ডিমলা যায়। প্রতিদিন সকালে ও রাতে এসব বাস ডিমলার উদ্দেশে ছেড়ে যায়। ট্রেনেও যেতে পারেন, কমলাপুর থেকে নীলসাগর এক্সপ্রেসে ডোমার নামতে হবে। এরপর ডিমলা। ডিমলায় থাকার জন্য তেমন কোনো হোটেল নেই, তবে দু–একটি গেস্ট হাউস আছে। ডিমলা থেকে কালীগঞ্জ যেতে হলে প্রথমে আপনাকে যেতে হবে ছাতনাই কলোনি বাজার। সেটা ভ্যান কিংবা অটোতে যেতে পারেন। এরপর রিজার্ভ ভ্যান নিয়ে কালীগঞ্জ সীমান্ত।

যেহেতু প্রত্যন্ত এলাকা, তাই দিনে গিয়ে দিনে ফিরে আসাটাই ভালো।

লেখক: বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ডেপুটি ম্যানেজার