ব্রেক্সিট: বাংলাদেশ সরকারের আসলে কী করা উচিত

উদ্‌যাপনের মধ্য দিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে ৪৭ বছরের সম্পর্ক ছিন্ন করল যুক্তরাজ্য। গত মাসের ১ তারিখে বহুল আলোচিত ব্রেক্সিট যুক্তরাজ্য বাস্তবায়ন করল। এর মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে যুক্তরাজ্য ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বের হয়ে গেল।

যুক্তরাজ্যের নাগরিকেরা ব্রেক্সিট উদ্‌যাপন করলেও এটি সেসব রাষ্ট্রের জন্য উদ্বেগ তৈরি করেছে যারা যুক্তরাজ্যে রপ্তানি করে। বাংলাদেশ যেসব দেশে রপ্তানি করে, যুক্তরাজ্য তার মধ্যে অন্যতম। বাংলাদেশ যুক্তরাজ্যে ৪ দশমিক ১৬ বিলিয়ন ডলার সমমূল্যের পণ্য রপ্তানি করে। এটি বাংলাদেশের মোট রপ্তানির ১০ দশমিক ২৯ শতাংশ।

জার্মানির পর বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্পের তৃতীয় বৃহৎ রপ্তানি গন্তব্যস্থল হলো যুক্তরাজ্য। ব্রেক্সিট–পরবর্তী বাণিজ্য সুবিধা প্রাপ্তিতে যেকোনো পরিবর্তন বাংলাদেশের জন্য উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়াবে। যদিও এটা নিশ্চিত করেছে যে যুক্তরাজ্য ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য হিসেবে যে বাণিজ্য সুবিধা দিত, ব্রেক্সিট–পরবর্তী তা বজায় রাখবে।

বাংলাদেশ রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর মতে, চলতি অর্থবছরে প্রথম ছয় মাসে যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশের রপ্তানি আয় দশমিক ৮৪ শতাংশ কমে দাঁড়িয়েছে ২ দশমিক শূন্য ৩ বিলিয়ন ডলারে, যা গত অর্থবছরে ছিল ২ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ।

নেতিবাচক প্রবৃদ্ধির কারণ
ব্রেক্সিটের কারণে যুক্তরাজ্যের বাজারে অনিশ্চয়তা বিরাজ করছিল। যার ফলে আন্তর্জাতিক অ্যাপারেল রিটেলাররা নতুন অর্ডার দেওয়ার ক্ষেত্রে ধীরে চলার পক্ষপাতি ছিল। যা বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানির ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলতে পারে। অন্য দিকে ব্রেক্সিট অস্থিরতার কারণে ভোক্তারা তাদের ভোগ্যপণ্য ব্যয় কমিয়ে দিয়েছে।

রপ্তানি কমার ক্ষেত্রে আভ্যন্তরীণ কারণ ও উল্লেখযোগ্য—
* তৈরি পোশাক খাতে যেসব নীতিগত সহায়তা ও প্রণোদনা দেওয়ার কথা রয়েছে, তা এখনো পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি।
* দক্ষতার অভাব এবং ব্যবসার ক্ষেত্রে ব্যয় বৃদ্ধি।
* ডলারের বিপরীতে টাকার শক্তিশালী অবস্থান।
*প্রতিযোগিতার সক্ষমতা কমে যাওয়া।

এটা আশা করা যাচ্ছে, চুক্তি পরবর্তী যুক্তরাজ্য সরকারের শুল্কমুক্ত বাজার প্রবেশাধিকার বজায় রাখার আশ্বাস দেওয়ার কারণে চলতি অর্থবছরের শেষে পোশাক রপ্তানিতে ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি হবে।

তৈরি পোশাকমালিকদের পর্যবেক্ষণ
তৈরি পোশাক উৎপাদনকারীরা যুক্তরাজ্যের বাজারে চলমান বাণিজ্য সুবিধা অব্যাহত থাকার ব্যাপারে আশাবাদী। চীন-আমেরিকার বাণিজ্যযুদ্ধ, ইউরোপের নিম্নমুখী প্রবৃদ্ধি, ব্রেক্সিট–পরবর্তী যুক্তরাজ্যের সঙ্গে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সম্পর্ক, ভারতের হঠাৎ নিম্নমুখী প্রবৃদ্ধি বৈশ্বিক সাপ্লাই চেইনে অস্থিরতা তৈরি করবে। পোশাকশিল্পের মালিকেরা মনে করেন, বৈশ্বিক বাণিজ্যের চলমান বাস্তবতাকে মাথায় রেখে সরকারের উচিত শক্তিশালী লবি নিয়োগ করা, যা বিদ্যমান বাণিজ্য সুবিধা বজায় রাখতে যুক্তরাজ্যের নীতিকে প্রভাবিত করবে।

ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতো স্বল্পোন্নত দেশসমূহের প্রতি কোটামুক্ত ও শুল্কমুক্ত সুবিধা অব্যাহত রাখার ঘোষণা দিয়েছে যুক্তরাজ্য সরকার। বর্তমানে বাংলাদেশ অস্ত্র ব্যতীত সব পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা ভোগ করছে।

যুক্তরাজ্য সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি
বাংলাদেশে নিযুক্ত ব্রিটিশ হাইকমিশনার রবার্ট ডিকসনের মতে, যুক্তরাজ্য দীর্ঘমেয়াদে বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্য, উন্নয়ন এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে আরও বেশি অবদান রাখার সত্যিকারের সুযোগগুলো খতিয়ে দেখছে।

ব্রেক্সিট–পরবর্তী যুক্তরাজ্য ১১ মাসের ট্রানজিশন পিরিয়ডের মধ্য দিয়ে যাবে। এ সময় দেশটিকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের আইন মেনে চলতে হবে এবং দেনা পরিশোধ করতে হবে।

স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে ইউরোপীয় ইউনিয়ন প্রদত্ত জিএসপির অধীন বাংলাদেশ অস্ত্র ব্যতীত সব পণ্যের (ইবিএ) ক্ষেত্রে কোটামুক্ত ও শুল্কমুক্ত সুবিধা ভোগ করে আসছে। ইবিএ বাংলাদেশসহ ৪৮টি স্বল্পোন্নত দেশকে এই সুবিধা দিয়ে থাকে।

ব্রেক্সিটের ধারাবাহিকতায় যুক্তরাজ্য অন্যান্য দেশের সঙ্গে পণ্য ও সেবা আদান-প্রদানের নতুন নিয়ম প্রণয়নে আলোচনা শুরু করবে। ডিকসনের মতে, বাংলাদেশে ব্যবসা ও বিনিয়োগের ব্যাপক সম্ভাবনা থাকার কারণে দীর্ঘমেয়াদে যুক্তরাজ্য এখানে কাজ করে যাবে।

হাইকমিশনার তৈরি পোশাকশিল্পে বাংলাদেশের অভাবনীয় উন্নতি স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন, একটা সময় পরে প্রতিযোগীদের কারণে বাংলাদেশের প্রতিযোগিতার সক্ষমতা কমে যাবে। যার কারণে বাংলাদেশের উচিত উচ্চ মূল্য সংযোজন এবং পণ্যের বহুমুখীকরণের ওপর জোর দেওয়া।

সরকারের কী করা উচিত?
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) গবেষণা পরিচালক এম আবদুর রাজ্জাকের মতে‚ ব্রেক্সিট–পরবর্তী যুক্তরাজ্য ট্রানজিশন পিরিয়ডের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এ মুহূর্তে বাণিজ্য অগ্রাধিকারে কোনো পরিবর্তন আসবে না। বাংলাদেশের রপ্তানি আয় ইতিবাচক কিংবা নেতিবাচক যেটাই হোক না কেন, ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য হিসেবে যুক্তরাজ্যের বাজারে বাংলাদেশ যে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার পেত, তা এখনো পাবে।

এ বছরের শেষে যুক্তরাজ্য সরকার তাদের স্বাধীন বাণিজ্যনীতি ঘোষণা করবে। তখন দেখতে হবে, ব্রিটিশ সরকার বাংলাদেশের জন্য শুল্ক ও কোটামুক্ত সুবিধা রাখবে কি না। এ মুহূর্তে বলা যাচ্ছে না, ব্রিটিশ সরকারের পরবর্তী পদক্ষেপ কিংবা তাদের নতুন বাণিজ্যনীতি কী হতে পারে। বাংলাদেশের উচিত যুক্তরাজ্য সরকারের নীতিকে সতর্কতার সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করা এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া, যাতে শুল্কমুক্ত বাজার প্রবেশাধিকার বজায় থাকে।

*লেখক: বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষার্থী

আরও পড়ুন: