আইনের দুর্বলতায় পণ্যমূল্য ও 'ক্যাভিয়াট এম্পটর' মতবাদ

ধরুন, আপনি ব্যস্ততম এলাকার মাঝারি মানের একটি হোটেলে চাষের কই মাছ, ভর্তা, ডাল ও সাদা ভাত দিয়ে দুপুরের খাবার খেয়েছেন। খাওয়া শেষে ৪৮০ টাকার বিল এল। বিল দেখে আপনার দমবন্ধ অবস্থায় দাম জিজ্ঞেস করতেই ওয়েটার বলে দিলেন কই মাছ ৩০০ টাকা, আলুভর্তা ৫০ টাকা ও অন্যান্য মিলিয়ে ৪৮০ টাকা।

আপনি হতবাক হয়ে ভাবছেন, ২০ থেকে ২৫ টাকা কেজি দরের আলুর এক মুঠো ভর্তা ৫০ টাকা কীভাবে হয়! প্রশ্ন হলো এই দাম পরিশোধ করতে আপনি বাধ্য কি না? দর-কষাকষির সুযোগ থাকল কি না? আপনি মূল্যতালিকা দেখতে চাইলে তিনি ছোট অক্ষরে লেখা একটি তালিকাও দেখালেন বটে। ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে মূল্যতালিকা প্রদর্শনের আইন আছে। আইন ভঙ্গের শাস্তিও আছে। কিন্তু ২০০ থেকে ২৫০ টাকা কেজি দরের চাষের হাইব্রিড কই মাছের দাম যে ৩০০ টাকা রাখা যাবে না, তা কোনো আইনে স্পষ্ট করে লেখা নেই!

অথবা আপনি শহরতলির কোনো সেলুনে চুল কাটালেন। নরসুন্দরের ক্রমাগত উসকানিতে অথবা স্বেচ্ছায় চুলে শ্যাম্পু মাখিয়ে মাথা পরিষ্কার করালেন। সাধারণ চুল কাটার বিল ১০০ টাকা হলেও তিনি এখন আপনার কাছে দুই টাকার শ্যাম্পু খরচ বাবদ ২০০ টাকা বিল দাবি করলেন। এই পরিপ্রেক্ষিতে আপনার প্রতিকার কী?

২.
এই বিষয়ে প্রাসঙ্গিক আইনে কী লেখা আছে দেখা যাক। পণ্য বিক্রয় আইন, ‘১৯৩০–এর “দাম” অধ্যায়ের ৯ (১) ও ৯ (২) ধারায় পণ্যের মূল্য নির্ধারণ বিষয়ে বলা হয়েছে, পণ্যের মূল্য পক্ষগণের মধ্যে সম্পাদিত চুক্তি দ্বারা নির্ধারিত হতে পারে বা পক্ষগণের ইচ্ছামতো হতে পারে অথবা পক্ষগণ দ্বারা গৃহীত পদক্ষেপের মাধ্যমে মূল্য নির্ধারিত হতে পারে। যে ক্ষেত্রে, উপরিউক্ত উপায়ে মূল্য নির্ধারিত হয়নি, সে ক্ষেত্রে ক্রেতা, বিক্রেতাকে একটি যৌক্তিক মূল্য পরিশোধ করবে। তবে পরিশোধিত মূল্যটি যৌক্তিক কি না তা নির্ধারিত হবে বিদ্যমান পারিপার্শ্বিক অবস্থার প্রেক্ষিতে।’ এই যৌক্তিকতার দুয়ো তুলে ইচ্ছেমতো দাম নির্ধারণ করে দোকানে মূল্যতালিকা প্রদর্শন করেই তাঁরা আপনার পকেট কাটবে। অথচ আইনের দুর্বলতার কারণে আপনি বর্তমান সময়ের আলোচিত ও প্রশংসিত জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরে নালিশি সেবা পাবেন না।

ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন ২০০৯–এর সংশ্লিষ্ট বিধানে প্রতিষ্ঠানে মূল্যতালিকা প্রদর্শন না করার দণ্ড সম্পর্কে ৩৮ ধারায় বলা হয়েছে, ‘কোন ব্যক্তি কোন আইন বা বিধি দ্বারা আরোপিত বাধ্যবাধকতা অমান্য করে তার দোকান বা প্রতিষ্ঠানের সহজে দৃশ্যমান কোন স্থানে পণ্যের মূল্যের তালিকা লটকাইয়া প্রদর্শন না করে থাকলে তিনি অনূর্ধ্ব এক বৎসর কারাদণ্ড, বা অনধিক ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড, বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হইবেন।’ এর মানে মূল্যতালিকা দেখিয়ে দোকানি আপনার কাছ থেকে মূল্য আদায় করতে পারেন। কিন্তু আরোপিত মূল্যের যৌক্তিকতা আর যাচাই হলো না। এ লক্ষ্যে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশসহ অন্যান্য তদারকি সংস্থা ও স্থানীয় ব্যবসায়ী সমিতির কার্যকরী অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে একটি মূল্যনির্ধারণী কমিটি গঠন করে নিয়মিত বাজার তদারকির কাজ করা যেতে পারে।

মাথার ঘাম পায়ে ফেলা আমাদের কৃষক ভাইয়েরা লোভী নন, অতি মুনাফাখোরও নন। বরং তাঁরা ন্যায্যতাবঞ্চিত হতভাগ্য পেশাজীবী, যাঁদের ঘামের ওপর মসনদ গড়ছে বেনিয়া লুটেরার দল। যে লাউ আমাদের কৃষক ভাই ১০ টাকা মূল্য পান না, সেই লাউ বাজারে খুচরা ভোক্তাকে কিনতে হয় ৬০ থেকে ৮০ টাকায়। কাজেই এর রাশ টানা অতীব জরুরি।

৩.
এ পরিপ্রেক্ষিতে বাজারে প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করে পণ্যের ন্যায্যমূল্য নির্ধারণ করা হবে বলে জানিয়েছিলেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। তিনি বলেছিলেন, পণ্যের উপযুক্ত মূল্য নিশ্চিত করতে প্রতিযোগিতা কমিশন আইনের কঠোর প্রয়োগ এবং জনসচেতনতা বাড়াতে হবে। গত বছর ঢাকার সিরডাপ মিলনায়তনে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশনের উদ্যোগে আয়োজিত ‘টেকসই ও অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নে বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশনের ভূমিকা’ শীর্ষক সেমিনারে তিনি এসব কথা বলেছিলেন।

অথচ প্রতিযোগিতা আইন, ২০১২–তে মোট ৪৪টি ধারা বিদ্যমান থাকলেও তা বেশির ভাগই তত্ত্বীয় বাগাড়ম্বরপূর্ণ। সেখানে পণ্যের সর্বোচ্চ বিক্রয়মূল্য নির্ধারণের ব্যাপারে সে অর্থে তেমন স্পষ্ট করে কিছু বলা হয়নি। আইনের উদ্দেশ্য বর্ণনায় বলা হয়েছে, ‘যেহেতু দেশের ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রেক্ষাপটে ব্যবসা-বাণিজ্যে সুস্থ প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ উৎসাহিত করা, নিশ্চিত ও বজায় রাখার উদ্দেশ্যে ষড়যন্ত্রমূলক যোগসাজশ, জোটবদ্ধতা অথবা কর্তৃত্বময় অবস্থানের অপব্যবহারসংক্রান্ত প্রতিযোগিতাবিরোধী কর্মকাণ্ড প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ বা নির্মূলের লক্ষ্যে আইন প্রণয়ন করা সমীচীন ও প্রয়োজনীয়; সে লক্ষ্যে অত্র আইন প্রণয়ন করা হইল।’ এসব সভা-সেমিনার যে শুধুই তাত্ত্বিক ও চোখধাঁধানো বক্তব্যের বাহার, তা এত দিনে প্রতীয়মান হয়।

৪.
প্রতারণার আরেকটি চটকদার মাধ্যম হলো পণ্যের অভিহিত মূল্য বাড়িয়ে দিয়ে সেই পণ্যে মূল্যছাড়ের ব্যাপকভিত্তিক প্রচারণা করা। সরলমনা খদ্দের তিন হাজার টাকার পণ্য ৫০ ভাগ ছাড়ে কিনে আনন্দ পেলেও বাস্তবে পণ্যের আসল দামই ১ হাজার ৫০০ টাকার বেশি নয়। অথচ সুযোগসন্ধানীরা ঢোলসোহরতে বিজ্ঞাপন প্রচার করে ভোক্তাদের মধ্যে উন্মাদনা তৈরি করে বিক্রি বাড়িয়ে মুনাফা লুটে। এই কাজ অপরাধ। আইনেও শাস্তির বিধান আছে। মিথ্যা বিজ্ঞাপন দ্বারা ক্রেতাসাধারণকে প্রতারিত করার ব্যাপারে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন ২০০৯–এর ৪৪ ধারায় বলা হয়েছে যে, ‘কোন ব্যক্তি কোন পণ্য বা সেবা বিক্রয়ের উদ্দেশ্যে অসত্য বা মিথ্যা বিজ্ঞাপন দ্বারা ক্রেতাসাধারণকে প্রতারিত করলে তিনি অনূর্ধ্ব এক বৎসর কারাদণ্ড বা অনধিক দুই লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হইবেন।’ কিন্তু ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের লোকবলসংকটের কারণে বাজারের স্বাভাবিক আরোপিত মূল্য সংরক্ষণ করা যাচ্ছে না। সেবাগ্রহীতার চাহিদামতো সেবা দিতে না পারা অধিদপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অবহেলা নয় বরং তীব্র লোকবলসংকট।

৫.
ভোগ্যপণ্যের মূল্য কয়েকটি প্যারামিটার স্পষ্ট করে নির্দিষ্ট করে দেওয়া যায়। নিয়মিত বাজারের কাঁচামালের মূল্য যাচাই করে হোটেল-রেস্তোরাঁর তৈরি খাবারের সর্বোচ্চ দাম ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অঞ্চলভেদে সময়ে সময়ে নির্দিষ্ট করে দেওয়া যায়। উৎপাদন খরচের বাস্তবসম্মত হিসাব রাখা এবং তা যাচাই করা ইত্যাদি কাজের মাধ্যমে প্রকৃত উৎপাদন খরচ নিরূপণ করে গণশুনানির মাধ্যমে তার সঙ্গে সুনির্দিষ্ট একটি শতকরা হার মুনাফা ধরে মূল্য নির্ধারণ করলে ভোক্তা ও উদ্যোক্তা উভয়ের স্বার্থ রক্ষা হয়। নিরাপদ ও সহজলভ্য খাদ্য মানুষের মৌলিক প্রয়োজন ও মানবিক অধিকার। সব ক্ষেত্রে না পারলেও বাংলাদেশের সংবিধানের ১৫ অনুচ্ছেদে বর্ণিত মৌলিক প্রয়োজনগুলোর ক্ষেত্রে যাতে সহজলভ্য ও যৌক্তিক দাম নির্ধারণ করা যায়, সেদিকে নজর দিয়ে বাংলাদেশকে একটি কল্যাণ রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে।

মুক্তবাজার অর্থনীতিতে পণ্য ও সেবার মূল্য নির্ধারিত হয় চাহিদা ও জোগানের ভিত্তিতে। ভোক্তা যুক্তিশীলতার সঙ্গে দাম যাচাই করে সিদ্ধান্ত নেবেন, এটা অর্থনীতির মুখস্থ বুলি। কিন্তু বাস্তবিকতা হলো আমাদের দেশে কিছু কিছু পণ্য ও সেবার বিপুল জোগান থাকার পরেও অতি মুনাফাখোর কুচক্রী ব্যবসায়ীরা সুযোগ পেলেই ভোক্তাকে বোকা বানিয়ে ফায়দা লোটে।

চুক্তি আইনে ‘ক্যাভিয়াট এম্পটর’ নামে একটি মতবাদ আছে। অর্থাৎ ক্রেতা সাবধান নীতি। ক্রেতা যাতে প্রতারিত না হয়, সেদিকে তাকে নিজেই লক্ষ রাখতে হবে। কিন্তু আমাদের প্রচলিত দুর্বৃত্তায়িত অর্থনৈতিক সমাজব্যবস্থায় ভোক্তার সতর্কতা, সচেতনতা কিছুই কাজে আসে না বরং পদে পদে শুধু তাদের অসহায়ত্বই ফুটে ওঠে।

লেখক: আইন কর্মকর্তা, অগ্রণী ব্যাংক লিমিটেড। [email protected]