আহা রে জীবন-আহা জীবন

ব্রিজের ওপর দুই সন্তানসহ মা। ছবি: লেখক
ব্রিজের ওপর দুই সন্তানসহ মা। ছবি: লেখক

‘কার্নিশে ভুল অবেলা বকুল
থাকো ছুঁয়ে একুল ওকুল
থাকো ছুঁয়ে শহুরে বাতাস
ছুঁয়ে থাকো নিয়ন আকাশ’

সত্যিই তো এমন কত কত ভুল আমাদের জীবনের ভাঁজে ভাঁজে লুকিয়ে থাকে। শহরের রঙিন বাতাস আর খোলা আকাশে রাতের নিয়ন আলোয় মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় আমাদের জানা-অজানা ভুলগুলো। মাঝেমধ্যেই ফুটওভার ব্রিজটার ওপর দাঁড়িয়ে আমি আমার চলমান শহরটাকে দেখি। ব্যস্ততায় ঠাসা অস্থির মানুষের রেসের দৌড় দেখি আর মনে মনে ভাবি, আমিও তোমাদের মতো এ শহরেরই একজন। ভিড়ে ঠাসা জনপদে নিজেকে কেমন লাগে, তা-ই দেখি ওই ব্রিজটার ওপর আলগোছে দাঁড়িয়ে। সেদিনও দাঁড়াব ভেবেছিলাম। ব্রিজের ওপর উঠতেই দেখি, অসংখ্য মানুষের মাড়িয়ে যাওয়া পায়ের ধুলা আর মধ্যদুপুরে তপ্ত রোদের আলোয় শিল্পীর আঁকা ছবির মতো এক ক্লান্ত জীবনের গল্প হয়ে বিভোর ঘুমে আচ্ছন্ন অল্প বয়সী এক মা আর তার ছোট্ট মিষ্টি দুটি সন্তান। মুখ ফসকে বেড়িয়ে এল, আহা জীবন-আহা রে জীবন!

জীবনের কত রং, কত রূপ, কত গন্ধ। তবু গবেষকেরা নিরন্তর খুঁজে ফিরছেন সত্যিকারের সার্থক এক জীবনের সংজ্ঞা। বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যায় জীবনের কি কোনো সহজ-সাবলীল সংজ্ঞা হয়, নাকি কোনো বিশেষ ছাঁচে তাকে ফেলা যায়? অনেকেই বলে, জীবনকে ভোগ করতে জানতে হয়, কিন্তু এ যে চারপাশে এত এত সাদা-কালো, কখনোবা তেজপাতা রঙের মতো বর্ণিল জীবন আমরা দেখতে পাই, ভালোবাসার যেমন নানা রং হয়, এসব জীবনেরও কি বসন্তে ফোটা টকটকে শিমুল-পলাশের মতো রং হয় আদৌ? হয় না, জীবন এদের কাছে খুব পানসে এক অনুভূতি।

কাজ-অকাজের সুবাদে কত রকম মানুষের সঙ্গে এই এক জীবনে দেখা হওয়ার সুযোগ হয়েছে, তাদের সেই যাপিত জীবনে তারা কত রকমভাবেই যে জীবনকে নেড়েচেড়ে দেখছে, তা কল্পনাতীত। ভালো-মন্দ, সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, এসব নিয়েই তো জীবন। সে জীবনে মানুষ কখনো জিতে যায়, কখনোবা লড়াইয়ে হেরে যেতে হয়। ঘুমন্ত শিশু দুটির দিকে তাকিয়ে মনে হচ্ছিল, কী এক অদ্ভুত শহরে আমাদের বসবাস। উঁচু ব্রিজটাতে উঠতেই আমার দু’পা শিরশির করে কাঁপছিল অথচ একটুখানি অসাবধান হলেই ওরা গড়িয়ে পড়তে পারে ঠিক রাস্তার মাঝখানে। তারপর কী ঘটতে পারে, তা আমার-আপনার সবারই জানা। কিন্তু আশ্চর্য, ওরা না পড়ে যায় না। জীবন ওদেরকে এই কংক্রিটে মোড়া শহরের আবর্জনা আঁকড়ে ধরে বাঁচতে শেখায়। সেই বেঁচে থাকার ভেতর দিয়ে মানুষরূপী এক না-মানুষ হয়ে ওরা বড় হতে থাকে।

প্রিয়তার আঙুল ছুঁয়ে খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে রাতের রুপালি তারা দেখার অনুভূতি যেমন অনেকটাই স্বর্গীয়। তেমনি রাতের আঁধারে গলির মোড়ে দাঁড়িয়ে শরীরের অনাবৃত অংশকে পুঁজি করে দুটো ভাত আর ডালের জোগানও কিন্তু এক অপার্থিব জীবনেরই অংশ। সে জীবন বোধ হয় জলে ভাসা পদ্মপাতার জীবন। আহা জীবন!

তারাভরা রাতের নাগরিক জীবনে উঁচুতলার লোকেরা গভীর রাতের উন্মাদনা উপভোগ করতে মার্সিডিজ বেঞ্চ কিংবা বিএমডব্লিউ নিয়ে বেরিয়ে পড়েন লং ড্রাইভে—এও এক জীবন বটে। আর কেউ কেউ রাতের ওই মুগ্ধতা ভরা গোলাকার চাঁদকেও সুকান্তের ভাষায় তাচ্ছিল্যে ভরে বলে, ‘ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়, পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি।’ হয়তো বলবেন, এত সেই বিংশ শতাব্দীর পুরোনো প্যাচাল। আসলেই কি পুরোনো প্যাচাল? নাকি উন্নয়নের ধারায় অব্যাহত এই দেশে ক্ষুধা, মন্দা, দারিদ্র্য থাকলেও তা দেখাতে নেই, এভাবে ফুটপাতে কিংবা রাতের আঁধারে মাত্র কটা টাকায় নিজেকে বিক্রি করলেও তা বলতে নেই? কিন্তু এটাও তো জীবন!

দেশ এগিয়ে যাচ্ছে, বদলে যাচ্ছে সময়ের দাবিদাওয়া এবং সামাজিক প্রেক্ষাপট। আলু, পেঁয়াজ, পটোল থেকে শুরু করে চাল, ডাল, এমনকি বালিশ পর্যন্ত নিম্নমধ্যবিত্ত তো দূরে থাক উচ্চমধ্যবিত্তদেরই অনেকটা নাগালের বাইরে। তবুও হাটে, মাঠে, ঘাটে কিছু লোকেরা বলে, বর্তমানে বাংলাদেশে মানুষের জীবনযাত্রার অনেক বেশি পরিবর্তন হয়েছে। মানুষ আধুনিক হয়েছে।

ক্যামেরার ক্লিকে জেগে উঠল ছোট্ট শিশুটি। ছবি: লেখক
ক্যামেরার ক্লিকে জেগে উঠল ছোট্ট শিশুটি। ছবি: লেখক

হ্যাঁ, আধুনিক হয়েছে তো বটেই, বিশ্বায়নের এই যুগে, তবে নিম্নমধ্যবিত্ত এবং মধ্যবিত্তদের জীবনের নয়, বরং কিছুটা রুচির বদল হয়েছে উঠতি টাকাওয়ালাদের। যেমন আজকাল ঈদ, পুজো বা আরও নানা সামাজিক পার্বণের ছুটি হলেই সেগুলো উপভোগ করতে এবং পুঁজিবাদদের পুঁজি বাড়াতে পাড়ি জমান থাইল্যান্ড, ব্যাংকক, সিঙ্গাপুর, দুবাই ও মালয়েশিয়া। দেশের বাইরে যাওয়াটা হালনাগাদে বেশ ফ্যাশন হয়ে দাঁড়িয়েছে। তা না হলে যেন আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব এবং কলিগদের কাছে সম্মান টেকানো দায় হয়ে পড়ে। এটাও কিন্তু জীবনের একধরনের সংজ্ঞার ভেতরেই পড়ে। কে কীভাবে ভোগ করবে, সেটাই বড় কথা। সবাইকে গরিবের কথা ভাবতে হবে, দেশের অর্থনীতির কথা ভাবতে হবে, এমন তো নয়। এ ভাবনা কি কেবল তবে সরকারের একার?

সেদিন যখন মধ্যদুপুরে ব্রিজটা পার হচ্ছিলাম। এই শিশু দুটোর দিকে চোখ পড়তেই থেমে গেলাম, কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম ওদের পাশে। ব্যাগ থেকে মোবাইল ফোনটা বের করতে পাঁচবার ভাবলাম, কী লাভ এসব সাময়িক শৈল্পিকতা দেখিয়ে? শৈল্পিকতাই তো! গরিব মানুষগুলোই তো এই ঘুণে ধরা সদ্য আধুনিক বনে যাওয়া সমাজে একমাত্র শিল্প। ওরাই কেবল বিধাতার সৃষ্টি প্রকৃতির মতো প্রাণবন্ত ও জীবন্ত এক শিল্পকর্ম।

আমার ছবি তোলার শব্দে ছোট্ট একরত্তি মেয়েটা বিরক্ত হয়ে ওর মায়ের বুকের ভেতর থেকে আলতো করে মুখটা বের করে আনল। নাম জিজ্ঞেস করতেই অপলক চেয়ে রইল আমার দিকে, যেন প্রয়োজন বোধ করছে না। আর করবেই–বা কেন, আমি তো ছবি তুলেই বাহাদুরি দেখিয়ে পালিয়ে আসব, কিন্তু ওর মাথার নিচে একটা বালিশ দেওয়ার মতো মহান দায়িত্বটুকু তো আর নিতে যাব না! তাই কী দরকার ওর নাম বলে সময় নষ্ট করার?

ছবিগুলো যখন ফেসবুকে দিলাম, এক বন্ধু বললেন, কে এই সন্তানদের বাবা? যদি সুস্থ হয়ে বেঁচে থাকে বা অর্থের লোভে এমন কাজ করে থাকে, তবে সে একজন জঘন্য ছাড়া আর কিছু নয়। ভদ্রলোক আরও লিখলেন, বাচ্চা দুটোর জন্য বড্ড মায়া হচ্ছে তাঁর।

উনি বলার পর আমার বিবেকও প্রশ্ন করল, আসলেই তো, কে ওদের বাবা? সত্যিকার কোনো পরিচয় ওরা দাবি করতে পারে কি? এ পুরুষশাসিত সমাজ সে দাবিটুকু করবার অধিকার নারীকে দেয় কি? তাই যদি হতো, কিছুদিন আগে মিডিয়াতেই আমরা দেখেছি আজিমপুর ম্যাটারনিটি হাসপাতালের সামনে এক পাগলি মেয়ে একটি ফুটফুটে শিশুর জন্ম দিয়েছিল। যে শহরে রাতের অন্ধকারে কিংবা দিনের উলঙ্গ আলোয় একটা পাগলি মেয়েও গর্ভবতী হয়, সে সমাজে এমন হাজারো দাবিদাওয়াহীন শিশু অবাঞ্ছিত ঘুরে বেড়াবে, এতে আশ্চর্য বা অবাক হওয়ার কিছু নেই। অস্ফুট স্বরে আনমনে বলে ফেলি, আহা রে জীবন, আহা জীবন। জলে ভাসা পদ্ম–জীবন।