মাশরাফি একজন বঙ্গীয় লিওনাইদাস

মাশরাফি বিন মুর্তজা
মাশরাফি বিন মুর্তজা

খ্রিষ্টপূর্ব ৪৭৯ অব্দে থার্মোপাইলের যুদ্ধে স্পার্টান রাজা লিউনাইদাস মাত্র ৩০০ সৈন্য নিয়ে বিরাট পারস্য বাহিনীকে আটকে দিয়েছিলেন। গ্রিসে গর্ব করার মতো উপাদানের কমতি নেই। তবু গ্রিক জাতি আজও রাজা লিউনাইদাসকে নিয়ে গর্ব করেন।

৫৬ হাজার বর্গমাইলের এই বদ্বীপে হাতে গোনা যে কটা গর্ব করার মতো বিষয় আছে, নিঃসন্দেহে মাশরাফি বিন মুর্তজা তার মধ্যে একটি। তিনি আমাদের পেস বোলিং ইতিহাসের পরিশ্রমী সিসিফাস। তবু আমরা অনেকেই তাঁর বিদায়বেলায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের হাজারো মতামত ও পত্রিকার কলামে তাঁকে নিয়ে গর্ব করার পাশাপাশি তাঁর সাম্প্রতিক পারফরম্যান্স নিয়ে সূক্ষ্ম টিপ্পনী কাটতে ছাড়ছি না। কেউ তুলছি ২০১৯ সালের বিতর্কিত নির্বাচনে তাঁর অংশগ্রহণের ব্যাপারটি।

অথচ আমাদের এই ভাগ্যবিড়ম্বিত, অপুষ্টিতে ভোগা ক্ষীণকায় মানুষের জনপদে তাঁর মতো আগ্রাসী ক্রিকেটার খুব কমই এসেছেন। ২০০১ সালে অভিষেকের সময় ঘণ্টায় ১৪০ কিলোমিটার গতিতে বল করা আমাদের নড়াইল এক্সপ্রেস তখন বিশ্বের দ্রুতগতির পেসারদের মধ্যে একজন ছিলেন। আজ সেই বাঘটিকে আমরা বয়স ও গতি নিয়ে প্রশ্ন ছুড়ে দিই। ফলাফলে অভিমান নিয়ে তিনি পাল্টা জিজ্ঞাসা করেন, ‘আমি কি চোর?’

মাশরাফি বিন মুর্তজা
মাশরাফি বিন মুর্তজা

অথচ ২০০৬ সালে, ব্রেট লি, শেন বন্ড, এনটিনিদের ছাপিয়ে পুরো বছরে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি উইকেট শিকার করা এই ‘সিসিফাস’ এখনো এক দিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচে বাংলাদেশের বোলারদের মাঝে সর্বোচ্চ উইকেটের মালিক। তার বোলিং নিয়ে ক্রিকেট কিংবদন্তি ব্রায়ান লারা একবার বলেছিলেন, ‘আমার দুর্ভাগ্য, আমি মাশরাফির সঙ্গে এক টিমে খেলতে পারিনি।’ আর স্যার ভিভ রিচার্ডস একটু উল্টো করে বলেছিলেন, ‘আমার সৌভাগ্য, আমাকে কোনো দিন মাশরাফির বল মোকাবিলা করতে হয়নি।’

২০০৫ সালে কার্ডিফে সে সময়ের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে জয়লাভ। কিংবা ২০০৭ সালের ক্রিকেট বিশ্বকাপে ভারতকে কাঁদিয়ে মাঠছাড়া করা। এসব জয়ে তিনিই ছিলেন সূচনার কারিগর।

প্রতিবার হাঁটুর অস্ত্রোপচারের পর মাঠে ফিরে কলার উঁচিয়ে তিনিই আমাদের শিখিয়েছেন কীভাবে বিশ্ব ক্রিকেটের মহারথীদের হারিয়ে দেওয়াটা অভ্যাসে পরিণত করে বলতে হয়, ‘দৌড়া, বাঘ আইল!’

২০১৮ সালে এশিয়া কাপে বাংলাদেশকে কেউ গোনাতেই ধরেনি। পুরো একাদশে ইনজুরির ছড়াছড়ি। সাকিব নেই। তামিমের হাত ভাঙা। মুশফিকও পুরোপুরি ফিট নন। সে তুলনায় ভারত ও পাকিস্তান যথেষ্ট শক্তিশালী, শ্রীলঙ্কা সমীহ জাগানোর মতো দল, সঙ্গে আফগানিস্তানকেও ফেলে দেওয়া যায় না।

অথচ সেই দুর্বল দলটিকেই নেতৃত্ব দিয়ে এশিয়া কাপের ফাইনালে তুলেছিলেন মাশরাফি। ঠিক যেন স্পার্টান রাজা লিওনাইদাস।

থার্মোপাইলের যুদ্ধে লিওনাইদাস জয়লাভ করতে পারেননি। লড়ে গিয়েছেন শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে। এশিয়া কাপের ফাইনালে মাশরাফিও জয়লাভ করতে পারেননি। কিন্তু ‘বিনা যুদ্ধে নাহি দিব সূচ্যগ্র মেদিনী’র মতো করে ভারতের বিরুদ্ধে লড়ে গিয়েছেন শেষ বল পর্যন্ত। ঠিক যেন বাঙালির লিওনাইদাস!

নিউজিল্যান্ডকে হারানোর পর। সরল, প্রাণবান ও কঠিন মাশরাফি মর্তুজা
নিউজিল্যান্ডকে হারানোর পর। সরল, প্রাণবান ও কঠিন মাশরাফি মর্তুজা

এ ধরনের মানুষেরা ক্ষণজন্মা। নড়াইলের চিত্রা নদীর পাড়ের যে পেশিবহুল কৃষক–জেলেদের চিত্রকথা এস এম সুলতান এঁকেছেন, মাশরাফি বোধ হয় তাঁদেরই একজন। কখনো ঠাকুমার ঝুলিতে থাকা রূপকথার গরিব কাঠুরের সোনা-রুপার কুঠার ফিরিয়ে দেওয়ার মতো তিনি আইসিএলের কোটি টাকার প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছেন। আর কখনো আব্রাহাম লিংকনের একটি জাতিকে একত্র করার মতো করে জাতীয় দলের সব খেলোয়াড়কে এক ছাতার নিচে এনে উদ্বুদ্ধ করে বনে গিয়েছেন ওয়াল্ট হুইটম্যানের বিখ্যাত পংক্তি ‘ওহ ক্যাপ্টেন, মাই ক্যাপ্টেন!’ বনে গিয়েছেন আমাদের সবচেয়ে সফল অধিনায়ক।

মাইকেল পাঙ্কের বিখ্যাত ‘দ্য রিভেন্যান্ট’ উপন্যাসে হিউ গ্লাসের বর্ণনাতীত সার্ভাইভালের গল্পটা লিওনার্দ ডিক্যাপ্রিয়র অভিনয়ে অস্কারপ্রাপ্তির দরুন আমরা অনেকেই জানি। পুরো ক্যারিয়ারে ১০ বার ডাক্তারের ছুরির নিচে নিজেকে সঁপে দিয়ে প্রতিটি ম্যাচের শেষে ফুলে ওঠা হাঁটুতে জমে থাকা রস সিরিজ দিয়ে টেনে বের করা মাশরাফির গল্পটা হিউ গ্লাসের থেকে কোনো অংশে কম কী?

মাশরাফি বিন মুর্তজা
মাশরাফি বিন মুর্তজা

শেষটায় ইংল্যান্ডের সাবেক ক্যাপ্টেন নাসের হোসাইনের একটা মন্তব্য তুলে ধরছি। তিনি বলেছিলেন, ‘নেতা, মানুষ আর খেলোয়াড়—এ তিনটি শব্দ যোগ করে মাশরাফি এমন একজন ক্রিকেটার, যা এর আগে কোনো দিন ক্রিকেট–বিশ্ব দেখেনি।’

এ পোড়া ভূখণ্ডে মানবিক মুগ্ধতা জাগানিয়া জেদি আর আত্মগর্বী এ মানুষটির ভাঙা হাঁটুকে স্যালুট জানাতে গিয়ে নতজানু হই বারবার। বলি আপনি বারবার পুনর্জন্ম নিয়ে জীবনানন্দের মতো ফিরে আসুন এই কার্তিকের নবান্নের দেশে।

*লেখক: মুক্ত চলচ্চিত্র নির্মাতা