বসন্তের বারতা নিয়ে দিকে দিকে ফুটেছে শিমুল ফুল

গাছে ফুটে রয়েছে শিমুল ফুল। ছবি: লেখক
গাছে ফুটে রয়েছে শিমুল ফুল। ছবি: লেখক

যুগে যুগে শিমুল নিয়ে এমনি গান, গল্প কিংবা কবিতা লিখেছেন বলতে গেলে সব সাহিত্যিকই। বাংলাদেশের প্রায় সব অংশেই শিমুল ফুলের দেখা মেলে। তার মধ্যে এ বসন্তে আমাদের প্রিয় কুষ্টিয়া শহরের ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের পাশে পথে প্রায়ই দেখা মেলে শিমুল ফুলের গাছ। গাছভর্তি লাল টকটকে ফুলের কোনো সৌরভ না থাকলেও সৌন্দর্যে মুগ্ধ হন না, এমন ব্যক্তি বোধ হয় খুব কমই মেলে।

কুষ্টিয়া উপজেলা থেকে ইবি ক্যাম্পাসের দিকে আসতে রাস্তার পাশেই পরপর প্রায় ১২টি বিশাল আকারের গাছে এমনইভাবে ফুটেছে শিমুল ফুল। আর শিমুলের সে সৌন্দর্য যেকোনো পথচারীকেই দাঁড়িয়ে দেখতে বাধ্য করবে।

শিমুল আমাদের অত্যন্ত পরিচিত একটি ফুল। তাই শিমুল শব্দটা উচ্চারণ করলে সবার আগে এর রক্তরাঙা চেহারার কথাই মনে আসে। শিমুলের ইংরেজি নাম: Silk Cotton Tree. বাংলা নাম: শিমুল, রক্ত শিমুল, লাল শিমুল। বৈজ্ঞানিক নাম: B.ceiba।

Bombax গণের অন্তর্গত পাতাঝরা বৃক্ষ জাতীয় তুলা উৎপাদক উদ্ভিদ। বাংলাদেশ, ভারত, চীন, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়ায় এ গাছ প্রচুর জন্মে। লম্বায় প্রায় ১৫-২০ মিটার হয়। এর শাখা-প্রশাখা অপেক্ষাকৃত কম। সরল ও বৃত্তাকারভাবে চারদিকে বিস্তৃত। বাকলে কাঁটা থাকে। কাঁটার অগ্রভাগ সরু ও তীক্ষ্ণ এবং গোড়া বেশ মোটা।

পাতার গঠন অনেকটা বোঁটায় ছড়ানো হাতের পাঞ্জার মতো। এর পাতা ৭ থেকে ১১ সেন্টিমিটার চওড়া হয়। শীতের শেষে এই গাছের পাতা ঝরে যায়। ফাল্গুন মাসে ফুলের কুঁড়ি আসে এবং চৈত্র মাসে বড় এবং উজ্জ্বল রঙের লাল ফুল ফোটে। এরপর গাছের পাতা গজানো শুরু হয়। ফুলের পাপড়ি ১০ থেকে ১২ সেন্টিমিটার লম্বা হয়। এর পুংকেশের অনেক থাকে। এর স্ত্রীকেশর পুংকেশর অপেক্ষা লম্বায় বড় হয়।

এর মোচাকৃতি ফল হয় এবং বৈশাখ মাসে ফল পাকে এবং ফল ফেটে বীজ ও তুলা বের হয়ে আসে। বীজের রং কালো। শিমুল তুলা লেপ, তোশক ইত্যাদি তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। এগুলো হলো রেশমি শিমুল, লাল শিমুল, কাপোক শিমুল, পাহাড়ি শিমুল, মোজাম্বিক শিমুল।

শিমুল বহুবর্ষজীবী বৃক্ষ জাতীয় উদ্ভিদ। বাংলার মাঠে-ঘাটে, রাস্তার পাশে অনাদর-অবহেলায় বেড়ে ওঠে শিমুলগাছ। সাধারণত বর্ষাকালে পানি পেলে জন্মায়। দ্রুত বর্ধনশীল গাছ। মাত্র ৪ থেকে ৫ বছরের মধ্যে উচ্চতায় আশপাশের আম-কাঁঠাল জাতীয় ২০ থেকে ২৫ বছরের পূর্ণবয়স্ক বৃক্ষকে ছাড়িয়ে যেতে পারে। বছরে ছয় মাস সবুজ পাতায় সুশোভিত থাকে শিমুলগাছ।

হেমন্তের শুরুতেই সবুজ পাতা হলদেটে হয়ে যায়। শীতের শুরুতেই সব পাতা ঝরে গাছ পুরোপুরি ন্যাড়া হয়ে যায়। বসন্ত কালে অন্য বৃক্ষরা যখন নবপল্লবে সেজে ওঠে, তখন শিমুলগাছে শুধু কুঁড়ি বের হয়। সেই বোধ হয় ভালো। নইলে শিমুলের পাতার যে সৌন্দর্য, সেটা এর ফুলের কাছে একেবারে ফিকে হয়ে যেত। আবার উল্টো ঘটনায় ঘটতে পারত।

কুষ্টিয়া থেকে ইবি ক্যাম্পাস দিকে আসতে রাস্তার পাশেই প্রায় ১২টি বিশাল আকারের গাছে এমনইভাবে ফুটেছে শিমুল ফুল। ছবি: লেখক
কুষ্টিয়া থেকে ইবি ক্যাম্পাস দিকে আসতে রাস্তার পাশেই প্রায় ১২টি বিশাল আকারের গাছে এমনইভাবে ফুটেছে শিমুল ফুল। ছবি: লেখক

শিমুলের পাতার যে বাহার, যে বিপুল তাদের সংখ্যা, হয়তো তার আড়ালে কিছুটা হলেও ম্লান হয়ে যেত শিমুলের সুন্দরী পষ্পকূল। শিমুল দ্রুত বর্ধনশীল বৃক্ষ। তাই এর কাণ্ডের বৃদ্ধিটাই সবচেয়ে বেশি। শিমুলের কাণ্ডের রং ধূসর।

অল্প বয়সী শিমুলগাছে কাণ্ডের গোড়ার দিকে মোটা মোটা বেঁটে ফোঁড়ার মতো কাঁটা থাকে। কাণ্ড পেরিয়ে যতই ওপরে ওঠা যায় যায়, ততই কাঁটা কমতে থাকে। কাণ্ডের শেষ পর্যায়ে গিয়ে মোটেও কাঁটা খুঁজে পাওয়া যাবে না। আর ডালে তো নয়ই।

যা–ই হোক, কোনো গাছের বয়স ১৫ থেকে ২০ পেরিয়ে গেলে কাঁটা তখন গোড়াতেও থাকে না। শিমুলে কাণ্ড ও শাখা–প্রশাখা বেশ নরম। তবে কাণ্ড একেবারে সোজা ও খাড়া হয়ে ওপরের দিকে উঠে যায়।

শিমুলগাছের কাণ্ড খাদযুক্ত। তার মানে কাণ্ডের একেবারে গোড়ার দিকে হাঙরের ডানার মতো ৩ থেকে ৪টি পায়া বের হয়ে মাটির সঙ্গে মিশে যায়। এ কারণে বয়স্ক শিমুলগাছের কাণ্ড গোল হয় না। তবে তরুণ গাছের কাণ্ড গোলই হয়। ছোট্টকালে কাণ্ডের গোড়া থেকে ডাল বের হলেও বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সেসব নষ্ট হয়ে যায়। তাই শিমুলগাছের কাণ্ডের উচ্চতাও অনেক বেশি। মোটামুটি ২০ ফুটের ওপরে গিয়ে শিমুলের প্রথম ডালটার নাগাল পাওয়া যেতে পারে।

কাণ্ডের বেড় শেষ পর্যন্ত কত হতে পারে, তা আমার জানা নেই। তবে আমাদের গাঁয়ে সবচেয়ে পুরোনো যে গাছটা ছোটবেলায় দেখেছি, তার বেড় আমাদের গাঁয়ের ২০০ বছরের পুরোনো অশ্বত্থগাছটার বেড়ের কাছাকাছি হবে। অর্থাৎ ১০ থেকে ১৫ ফুট। শিমুল পাতার রং সবুজ। বোঁটা লম্বা, বহুপক্ষল। একেকটা বোঁটায় ৫ থেকে ৮টা পাতা থাকে। প্রতিটা পাতার যে আলাদা বোঁটা থাকে, সেটা মোটামুটি এক ইঞ্চি লম্বা। পাতা লম্বাটে, অনেকটা বর্শার ফলার মতো। পাতা ৪ থেকে ৮ ইঞ্চি লম্বা হতে পারে। মাঝ–বরাবর পাতার প্রস্থ ২ থেকে ২.৫ ইঞ্চি।

শীতের একেবারে শেষভাগে এসে ন্যাড়া শিমুলগাছের মঞ্জরিতে কুঁড়ি আসে। এর কুঁড়িগুলো দেখতে ভারি সুন্দর। ঠিক কুঁড়ি নয়, যেন সুস্বাদু ফল! শিমুলের মঞ্জরিও দেখার মতো। ছোটখাটো একট ডাল যেন। ডালটার সারা গায়ে সার বেঁধে কুঁড়ি বের হয়। তার মানে মঞ্জরি বহুপুষ্পক। ফুলের কুঁড়ি আস্ত একটা সবুজ আবরণ দিয়ে ঢাকা থাকে। ধীরে ধীর সবুজ আবরণ ফেটে বেরিয়ে আসে আসল ফুল। কিন্তু কুঁড়ির ওই সবুজ আবরণ থেকেই যায়। পরিণত হয় সবুজ পাঁপড়িতে। ফুলের বোঁটার বেড় প্রায় ১ ইঞ্চি।

শিমুল ফুলের রং গাঢ় লাল। কখনো কখনো ফিকে লাল রঙের ফুলও দেখা যায়। তবে স্টো পানির অভাবের কারণেই। আবার সোনালি ধরনের এক রকম শিমুল দেখা যায়। তবে সেটার সম্পর্কে আমার অল্পবিস্তর জানাশোনাও নেই, তার বর্ণনা এড়িয়ে যাচ্ছি। শিমুল ফুল ঘণ্টাকৃতির। পাঁচটি পাপড়ি থাকে। পাপড়ি ঘন, সুসজ্জিত। ফুলের ব্যাস ৫ থেকে ৭ ইঞ্চি হতে পারে। একটা পাপড়ি ছিঁড়ে নিয়ে মাপলে কমপক্ষে ৪ ইঞ্চি লম্বা হবে। পাপড়ি বেশ পুরু। অন্তত কাচের চায়ের কাপের মতো পুরু হবে। অতিরিক্ত পুরুত্বের কারণে শিমুল ফুলের ওজনও অনেক বেশি। একেকটা ফুলের ওজন ৩০ থেকে ৫০ গ্রাম হবে। আমি মনে করি, শিমুলই একমাত্র বৃক্ষ, যার ডাল ফুলের ভারেই নুয়ে পড়ে।

পুরোটা বিকেল অসাধারণ কিছু সময় কাটালাম! সেই ভালো লাগা যেন প্রথমবারের অপূর্ণতাকে ভরিয়ে দিল। ভালো এক অনুভূতি নিয়ে শিমুলবন ছাড়ার আগে বিড়বিড় করে বলতে থাকলাম, প্রথমবার ফুল দেখতে এসেছি, শেষবার নয়! আবার দেখা হবে!

লেখক: শিক্ষার্থী, ফোকলোর স্টাডিজ বিভাগ, ইবি